শিক্ষার বাতিঘর ড্যাফোডিলস হাই স্কুল
প্রকাশিত : ২২:৫২, ৮ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ২২:৫৬, ৮ নভেম্বর ২০১৭
দোহারের মুকসুদপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এক গ্রাম মইতপাড়া। যে গ্রামের বুকে ২০০৩ সালে মো. এরশাদ হোসেন নামে এক স্বপ্নবাজ মানুষ একটি স্বপ্ন দেখেন। তার স্বপ্নের আকাশে ঘুরপাক খায় একটি মাঠ, চারিপাশে সবুজ শ্যামল গাছপালা, বেশ কয়েকটি ভবন, যে ভবনের ভিতর থাকবে শিক্ষার্থীদের কোলাহল আর শিক্ষকের সময়মত ক্লাসে ছুটে চলায় শিক্ষার্থীদের নিস্তব্দতাসহ আরো কত-কি। স্বপ্ন কারো কারো কাছে স্বপ্নই থাকে। তবে মো. এরশাদ হোসেনের মনে স্বপ্ন বাস্তবতার এক মাইলফলক হবে তা তিনি নিজেও ভাবেননি কখনো।
কি করেই বা ভাববেন। যখন তার মনে এতসব রঙ্গিন কল্পনা দোলা দিতে থাকলো তখন সে বিষয়টি মনে চাপা না রেখে সাহস করে তার বাবা মো. বেলায়েত হোসেনকে জানালেন। তাতে তার বাবা সম্মতি দিলেন না। বাবার সম্মতি না থাকায় মা-ও জানালেন তার অপারগতার কথা। তাতেও তিনি ভেঙ্গে পরেননি কখনও। তিনি জানতেন ব্যর্থতা বলতে কিছু নেই। বিষয়টি তার ছোট ভাই মো. ইলিয়াছ হোসেনকে জানালেন। বড় ভাইয়ের সুন্দর একটি প্রস্তাবকে সাড়া দিয়ে ছোট ভাই তার বাবা মাকে বিষয়টি খুলে বললেন। দুই ছেলের এমন প্রস্তাবকে অবশেষে মেনে নিতে হলো বাবা মো. বেলায়েত হোসেন ও মা জয়নব বেগমকে। দিলেন ৭০ শতাংশের একটি জমি। শুরু হলো পথ চলা।
ভাই ইলিয়াছ হোসেন তার এক বন্ধুর কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়ে প্রথমে পোষ্টার ও লিফলেট ছাপালেন। যাতে লেখা ছিল ড্যাফোডিলস কিন্ডারগার্টেন নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তারপর গ্রামের মেঠো পথসহ আশপাশের গ্রামের অলিগলি ও গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় সেটে দেওয়া হল পোষ্টার। তাদের এই প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিকভাবে পাঠদানের জন্য শিক্ষক হিসেবে নির্দিষ্ট করা হল রেজিয়া পারভীন,ঝুমুর আক্তার,হেনা আক্তার এবং আনোয়ার হোসেনকে। ২০০৩ সালের নভেম্বর মাস। স্কুল ভবনটি তখনও তৈরি হয়নি। কেউ ইচ্ছে করে আসেনি নিজের সন্তানকে ভর্তি করতে। শুরু হল মইতপাড়া গ্রামে গ্রামে গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে শুনিয়ে শিক্ষার্থীদের ড্যাফেডিলস কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করার প্রচেষ্টা। তবে তাদের প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তির খাতাটা তখনও শূন্য। কয়েকজন অভিভাবককে রাজি করিয়ে তাদের সন্তানকে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করা হল।
তখন কিন্ডারগার্টেনটি মো. এরশাদ হোসেনের বাড়ির উঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখনও সাইনবোর্ড দিয়ে আত্মপ্রকাশ হয়নি ড্যাফোডিলস কিন্ডারগার্টেন স্কুলের। শিক্ষিকা রেজিয়া পারভিন অসুস্থ থাকায় তার স্বামী আ. হালিম, তার আত্মীয় মোফাজ্জল ভূইয়া, ওয়াহিদুর রহমান আলম ও মো. আলতাফ হোসেন ছাড়াও অন্যান্য প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন নিয়ে এ বাড়ি সে বাড়ি করে ছাত্র-ছাত্রীদের সংগ্রহ করা হল।
২০০৪ সালে জানুয়ারিতে ৭৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে রাস্তার পাশে একটি পুরনো টিনশেড ঘরে ড্যাফোডিলস কিন্ডারগার্টেন নামে বর্তমান ড্যাফোডিলস হাইস্কুলের আত্মপ্রকাশ ঘটলো। শুরু হল শিক্ষা ব্যবস্থার যাত্রা। শুরুর দিকে ক্লাস ছিল তিনটি। প্লে,নার্সারী ও ওয়ান। প্রধান শিক্ষক মো. এরশাদ হোসেনের তত্ত্বাবধানে স্কুল। অন্যদিকে শিক্ষার্থী সংগ্রহের কাজ।
২০০৫ সালে বিগত বছরের সাফল্যে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থী বাড়তে থাকে। এভাবে কেটে যায় চারটি বছর। ২০০৮ সাল ড্যাফোডিলস স্কুলের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। কারণ সে বছর-ই প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের সমাপনি পরিক্ষা শুরু হয়। তবে দুঃখের বিষয় সে বছরও ড্যাফেডিলস কিন্ডারগার্টেন প্রাথমিকভাবে তখনও সমাপনী পরিক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমোদন পায়নি। কিছু প্রতিবন্ধকতায় ড্যাফোডিলস কিন্ডারগার্টেন এর নামে তখন পরিক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাননি শিক্ষার্থীরা। তবে তার কয়েকদিন পর অনুমোদন পেলেও তাতে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে ড্যাফোডিলস্ এর নামে পরিক্ষা দিতে পারেনা তারা। সে বছর সাতভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মইতপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে ড্যাফোডিলস এর ৯ জন শিক্ষার্থী পরিক্ষা দেয়। যেখানে ৭ জন শিক্ষার্থী ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিসহ মোট ৮ জন বৃত্তি পেয়ে ড্যাফোডিলস এর সুনাম বৃদ্ধি করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে। শুধু তাই নয় সে বছরে দোহার উপজেলায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় ওই প্রতিষ্ঠানটির ২ জন শিক্ষার্থী প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। তারপর থেকে আর প্রতিষ্ঠানটিকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০০৯ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে ১৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৪ জন শিক্ষার্থী এ প্লাস ও ৯ জন শিক্ষার্থী ট্যালেন্টপুলসহ মোট ১২ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়ে সফলতায় আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। এরপর ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ড্যাফোডিলস কিন্ডারগার্টেন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরিক্ষায় দোহারে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ভালো রেজাল্ট করে সফলতার স্বাক্ষর রাখে। ২০১১ সালে এ প্রতিষ্ঠানটি তার সফলতার সিড়িকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিতে ৬ষ্ঠ শ্রেণির পাঠদান কার্যক্রম শুরু করে। পরের বছরই সপ্তম শ্রেণি চালু করা হয় এবং সে বছরের ১১ জুন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটিকে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে পাঠদানের অনুমতি প্রদান করে। ২০১৩ সালে চালু করা হয় অষ্টম শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম এবং সে বছরের ৩ এপ্রিল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড বিদ্যালয়টিকে ড্যাফোডিলস হাইস্কুল নামে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে পাঠদানের প্রাথমিক অনুমতি প্রদান করে। ওই বছরই বিদ্যালয় থেকে জেএসসি পরিক্ষায় ৩২ জন পরিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে ১৮ জন পরিক্ষার্থী গোল্ডেন এ প্লাসসহ মোট ২৩ জন এ প্লাস পেয়ে শতভাগ ও ২০১৪ সালে ৪৬ জন পরিক্ষার্থী জেএসসি পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৯ জন গোল্ডেন এ প্লাসসহ মোট ২৬ জন এ প্লাস পেয়ে শতভাগ শিক্ষার্থী কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়। এছাড়া ওই বছরেই ৭ জন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিসহ মোট ১৪ জন বৃত্তি পেয়ে থাকে। এছাড়া ২০১৫ সালে জেএসসি ৪৯ জন পরিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে ৩১ জন এ প্লাস ও ১৫ জন গোল্ডেন এ প্লাসসহ শতভাগ শিক্ষার্থী কৃতিত্বের সাথে পাশ করে থাকে। এছাড়া বৃত্তিপ্রাপ্ত ২৯ জন শিক্ষার্থী যার মধ্যে ট্যালেন্টপুলে ১৪ জন ও সাধারণে ১৫ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়ে থাকে। ২০১৬ সালে জেএসসিতে ৬৪ জন পরিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে ৬৪ জনই কৃতিত্বের সাথে পাশ করে। যার মধ্যে এ প্লাস পেয়েছে ৩৯ জন, গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে ১৭ জন এবং এ গ্রেড পেয়েছে ৮ জন। এছাড়া পিএসসিতে ৭১ জন পরিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে ৭১ জনই পাশ করেছে। যার মধ্যে এ প্লাস পেয়েছে ৫৭ জন ও এ গ্রেড পেয়েছে ১৪ জন শিক্ষার্থী। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ৫০ জন শিক্ষার্থী তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বিদ্যালয়টির শুধু শিক্ষার্থী নয় বিদ্যালয়টিকে সারা দোহার নবাবগঞ্জ কেরানীগঞ্জের মধ্যে সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছে।
আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, খেলাধুলা,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের মনকে সতেজ করতে বাৎসরিক বনভোজনসহ প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকদের সাথে অভিভাবক সমাবেশ করে থাকেন। একটি গঠনমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই বিদ্যালয়টি।
এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক মো. এরশাদ হোসেন বলেন, প্রত্যেকটি মানুষই কোনো না কোনো স্বপ্ন দেখেন। তবে আমার একটি স্বপ্ন ছিল একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবো। আল্লাহ সে স্বপ্ন আমার পূরণ করেছে। তাই যতদিন বেঁচে থাকবো এই বিদ্যালয় থেকে যাতে করে প্রতিবছর মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরি হয় সেই লক্ষে কাজ করে যাব। আল্লাহ যেন সেই তৌফিক আমাকে দান করে সেজন্য আপনারা আমার ও আমার শিক্ষকদের জন্য দোয়া করবেন।
এসএ/ডব্লিউএন
আরও পড়ুন