অগ্নিঝরা ৮ মার্চ: বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলছিল দেশ
প্রকাশিত : ১৪:৪৮, ২০ মার্চ ২০২০
রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ প্রচার না করায় প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ। সেদিনই সন্ধ্যায় শাহবাগে রেডিও অফিসে বোমা হামলা চালায় কয়েক জন ক্ষুব্ধ তরুণ যুবক। তাদের মধ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক হারুন হাবীব। তিনি তার ‘জনযুদ্ধের উপাখ্যান’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা রেডিও অফিসের আশপাশ দিয়ে বার কয়েক গাড়ি নিয়ে ঘুরলাম। আমাদের গতিবিধি যে সৈন্যদের নজরে পড়েছিল তা আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। ..হঠাত্ স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের গুলির শব্দ কানে এলো। গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে ঘটনার আকস্মিকতায় মুরাদ লফিয়ে উঠল। পর পর ছোড়া হলো কয়েকটা হাতবোমা। প্রচণ্ড শব্দে সেগুলো ফাটল।.. বুলেটবিদ্ধ হলো গাড়িটা।’
৭ই মার্চের ভাষণ এভাবেই তরুণ প্রজন্মকে ঘর থেকে টেনে এনেছিল সংগ্রামের পথে। পর দিন ৮ মার্চ সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে সম্প্রচার শুরু হয়। অন্যান্য বেতার কেন্দ্র থেকেও তা রিলে করা হয়। এদিকে ক্ষুব্ধ শিল্পীরা বেতার-টেলিভিশনে শর্ত দিলেন, ‘আমরা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করব, তবে সব অনুষ্ঠান আন্দোলনের অনুকূল হতে হবে।’ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শিল্পীদের এ শর্ত মানতে বাধ্য হয়। এ ঐতিহাসিক ভাষণের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কার্যত গোটা পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেন। ৮ মার্চ থেকে ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের সব শহর-গ্রামে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, স্কুলকলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কলকারখানা জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ করে দেয়। এমনকি সরকারের পুলিশ বাহিনী ও ইপিআর বাঙালি সদস্যরা কার্যত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতোই কাজ করছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঘোষণার প্রতি ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান, বাংলা ন্যাশনাল লীগের অলি আহাদ, পিডিবির নূরুল আমিনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পূর্ণ সমর্থন দেন। এদিন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ নাম পরিবর্তন করে শুধু ‘ছাত্রলীগ’ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির একই সভায় প্রতিটি জেলা শহর থেকে প্রাথমিক শাখা পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাকিস্তানের পতাকা প্রদর্শন, জাতীয় সংগীত বাজানো এবং দেশের সব প্রেক্ষাগৃহে উর্দু ছবির প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া হয়। এদিন ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, বাংলার বর্তমান মুক্তি আন্দোলনকে ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’ ঘোষণা করে স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় যে প্রত্যক্ষ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, আমরা তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঘোষিত নির্দেশের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এতে বলা হয়—ব্যাংকসমূহ সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। বিদ্যুত্ সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় বিভাগগুলো খোলা থাকবে। সার সরবরাহ ও পাওয়ার পাম্পের ডিজেল সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। পোস্ট অফিস, সেভিংস ব্যাংক খোলা থাকবে। পানি ও গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। তাজউদ্দীন আহমদ আরেকটি পৃথক বিবৃতিতে সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত প্রেসনোটের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, প্রেসনোটে হতাহতের সংখ্যা অনেক কমিয়ে বলা হয়েছে। অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ক্ষেত্রেই গুলিবর্ষণ করা হয়েছে বলে কথিত বক্তব্য সত্যের অপলাপ। নিজেদের অধিকারের সপক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভরত নিরস্ত্র বেসামরিক অধিবাসীর ওপরই নিশ্চিতভাবে গুলি চালানো হয়েছে। পুলিশ ও ইপিআর গুলিবর্ষণ করেছে বলে যে প্রচারণা করা হয়েছে তা বাঙালির মধ্যে ভুল বোঝাঝুঝি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে।
ব্রিটেন প্রবাসী প্রায় ১০ হাজার বাঙালি লন্ডনে পাকিস্তানি হাইকমিশনের সামনে স্বাধীন বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ইসলামাবাদে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া শর্ত সম্পর্কে সাংবাদিকদের কাছে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।