ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

অনলাইন গেম ও এ প্রজন্ম

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

প্রকাশিত : ১২:৫১, ১ জুন ২০২১ | আপডেট: ১৬:৩৯, ১ জুন ২০২১

এক বন্ধুর মন খারাপ। তার কিশোর ছেলেটা সারাদিন ঘুমায়। আর সারারাত জেগে গেম খেলে। প্রায়ই দরজা বন্ধ করে রাখে সে। কিছু বলতে গেলেই চিৎকার করে ওঠে। মেজাজ দেখায়, উদভ্রান্তের মতো আচরণ করে। ঠিকমতো খায় না। কখনো চুল বড় রাখে, কখনো ছোট। সবার সাথে রুঢ় আচরণ করে। ছেলের এ ধরণের অভ্যাস তিনি মেনে নিতে পারছেন না। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরছেন। 

আরেক সহকর্মী জানান, তার ভাই-বোনদের ছেলেমেয়েরা মিলে একটি গ্রুপ করেছে। সেখানে তারা সবাই একসাথে মিলে গেম খেলে। একদিন তিনি শুনতে পান তার বোনের ৫ বছরের মেয়েটা বলছে, রিমি আপুকে মেরে ফেলো। ঝুমা আপুকে গুলি করো। এসব শুনে তিনি খুবই অবাক হন। এতো ছোট ছোট শিশুরা কি অবলীলায় বলছে মেরে ফেলার কথা। যে ৪ জন মিলে গেম খেলছে তাদের বয়স ৪ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে।

ঢাকা শহর থেকে সারাদেশ। সবখানেই আজ বেশীরভাগ অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে পরেছেন বিপাকে। ফ্রি ফায়ার, কল অফ ডিউটি, পাবজি গেমসহ নানা গেমের নেশায় শিশু, কিশোর, তরুনরা আজ বুদ হয়ে আছে। সমাজ বা জাগতিক কোনো কিছু আজ তাদের স্পর্শ করছেনা। তারা আশ্রয় নিয়েছে যেন ভার্চুয়াল জগতে। সেখানেই তাদের স্বচ্ছন্দে বসবাস। এরা কোন রকমে খাবার খায়। দু’একটা কথা বলে বাবা মার সাথে। সহজে হাসে না। পরিবারের সাথে পারস্পরিক যোগাযোগ তেমন নেই বললেই চলে। বাবা মা কিছু বললেই বিরুপ আচরণ করে। তাদের চোখ হাত সব যেন ব্যস্ত শুধু মোবাইল/কম্পিউটারে।
 
এরমধ্যে পাবজি! প্লেয়ার্স আননোন ব্যাটেল গ্রাউন্ড! বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইলন গেম। মোবাইল ও কম্পিউটার দুটোতেই খেলা যায় এই গেম। তবে মোবাইলেই বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এ খেলা। 

পাবজি একটা হিংস্র গেম। এই গেমের নিয়ম হচ্ছে একজনকে প্রথমে প্লেনে করে ম্যাপের মধ্যে একটা ল্যান্ডে নামিয়ে দেয়া হয়। এরপর ১’শ জন প্রতিপক্ষের সাথে তাকে ফাইট করতে হয়। আত্মরক্ষার্থে দেয়া হয় বোমা, গুলি অস্ত্রসহ বেশ কিছু জিনিস। সবই ভাচুর্য়াল। এরপর শুরু হয় খেলা। 

একটা সেফ জোনে থেকে তাকে যুদ্ধ করতে হয় ১’শ জন শত্রুর সাথে। খেলায় একে অপরকে মেরে নিজেকে এবং নিজের দলের অন্য সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখতে হয়। যত সময় যায় তত দ্রুত সেফ জোন ছোট হতে থাকে। যত ছোট হতে থাকে তত হেরে যাওয়ার আশংকা থাকে। টেনশন বাড়তে থাকে খেলোয়ারের। এসময় চিৎকার, চেঁচামেচি, গালাগালি করতে থাকে একে অপরকে। টেনশনে এ সময় কারো কারো ঘাম হয়। আতংক হয়। বুক ধরফর করে। হেরে যাওয়ায় আতংকে প্যানিক অ্যাটাক হয় কারো কারো।

এর ভয়াবহতা তখন এত বেশি হয় যে শিশু এবং কিশোরদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষিপ্রতা তৈরী করে এই গেম। খেলার এক পর্যায়ে এসে তারা অনেকেই ভায়োলেন্ট হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত যে খেলোয়াড় বেঁচে থাকে সেই জয়ী হয় এই গেমে। গেমে জয়ী হওয়ার পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয় ‘চিকেন ডিনার’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এক গবেষণায় জানায়, ভিডিও গেমে আসক্তি এক ধরণের মানসিক রোগ। এই ভিডিও গেমগুলো একজন খেলোয়ারকে ডিপ্রেশনের রোগী বানিয়ে ফেলে। 

গেমটি যেহেতু এক জায়গাতেই আটকে থেকে খেলতে হয়, সেহেতু এই গেম খেলা মানুষটি সামাজিকভাবে খুব বেশি সংযুক্ত থাকতে পারেন না। ধীরে ধীরে তারা সামাজিক মূল্যবোধের সাথে সমাজের আচার ব্যবহার থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। অতিরিক্ত খেলার কারণে চোখের সমস্যাও হয় কারো কারো। আর সেই সাথে দেখা দেয় ঘুমের ঘাটতি। 

অতিরিক্ত হিংস্রতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে পাবজি গেম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উপমহাদেশে সর্বপ্রথম এই গেমটি নিষিদ্ধ করা হয় ভারতে। নেপালে গেমটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও পরে তা উঠে যায়। ইরাক, জর্ডান ও চায়নাতে এই গেম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশে গত ১৮ অক্টোবর এই গেম নিষিদ্ধ করা হলেও পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।

পাবজি গেম খেলে এমন কিছু কিশোর কিশোরীর সাথে কথা হয়। ফারদিন (ছদ্দনাম) নামে এক কিশোর  জানায়, সারারাত গেম খেলার জন্য শরীর দুর্বল লাগে তার। খেতে ইচ্ছে করে না। 

সে জানায়, ৩ ভাগে গেমটা খেলে ওরা। একা, কখনো দুজন, কখনো ৪ জন বন্ধু মিলে। খেলতে বসে ভীষন টেনশন হয়। তখন আব্বু বা আম্মু কিছু বললে অনেক রাগ হয়। বিরক্তিতে সব ভেঙ্গেচুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। 

রোমান জানায়, খেলতে খেলতে অনেকের সাথে পরিচয় হয়। তারাই পরেই গেম পার্টনার হয়। এটা একটা নেশার মতো। সে বলে, দিন রাত খেলার কারণে মাথা ঝিমঝিম করে। ক্লান্ত লাগে। পড়াশুনা কিছুই হয় না। আব্বু আম্মু রাগও করে। কিন্তু সরে আসতে পারছি না। 

জিসানের মতে, আসলে গেম খেলার সময় বুঝি না এতো সময় চলে যায়। একটা ঘোরের মতো লাগে। একটা শেষ করে আরেকটায় জাম্প করি। গোল এ্যাচিভমেন্ট করতে পারলে অনেক পুরস্কার পাওয়া যায়। সেটাও একটা নেশার মতো লাগে। দেখি না কি হয়। অনেক সময় স্বপ্নের মধ্যেও দেখি গুলি, বোমা। কখনো মেরে ফেলছি শত্রুদের। 

স্বপ্নীল জানায়, পাবজি খেলতে গিয়ে নানা রকমের অস্ত্র সর্ম্পকে তার ধারণা তৈরী হয়েছে। যা আগে ছিলো না। সে বলে, খেলতে গিয়ে হেরে গেলে জেদ তৈরী হয়। তখন বারবার খেলতে থাকে জেতার জন্য। 

জিনিয়া জানায়, অনেকটা কৌতুহল থেকেই সে গেম খেলা শুরু করে। পরে এর ভয়াবহতা বুঝে সরে আসে। সে বলে, মেয়েরা পাবজি গেম খেলে তবে কম। প্রায় ৭৫ ভাগ ছেলেরা এ গেম খেলে বলে ধারণা তার। 

অভিভাবক আজমীর হোসেন তার কিশোর ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত। তিনি জানান, প্রায়ই হাসপাতালে যেতে হয় ছেলেকে নিয়ে। মাঝরাতে ছেলে বলে, তার বুক ধরফর করে। হাত কাঁপে। ডাক্তার জানিয়েছে, অতিরিক্ত গেম খেলার কারণে তার ছেলে প্যানিক এ্যাটাকে ভুগছে। 

অভিভাবক তামান্না বলেন, আজকের এ অবস্থার জন্য আসলে আমরা বড়রাই অনেকটা দায়ী। দায়ী রাষ্ট্র ও সমাজও। আমরা আমাদের শিশুদের জন্য খেলার মাঠ দিতে পারিনি। তাদের বেড়ে উঠতে দেইনি খোলা হাওয়ায়। সবুজ মাঠে পা রাখেনি তারা। ছোট্ট এক রুমে কাটে তাদের শৈশব, কিশোর বেলা। ফলে সময় কাটাতে তাদের হাতে চলে যায় মোবাইল। আমাদের পলিসি মেকারদের বিষয়গুলো নিয়ে মনে হয় ভাবা দরকার। 

অভিভাবক নুসরাত আফরিন জানান, করোনা ভাইরাসের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি থাকলেও অনলাইনে ক্লাস চলছে। ফলে বেশীরভাগ শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাস করার নাম করে মোবাইল গেমে আসক্ত হয়ে পরছে। অনেক অভিভাবক জানতেও পারেন না তার ছেলে বা মেয়ে কি করছে ফোনে। তিনি ভাবছেন সন্তান ক্লাশ করছে। আসলে তা না। তিনি দ্রুত গেমটি নিষিদ্ধ করার দাবী জানান। 

চিকিৎসক ও মানবাধিকার কর্মী শামীম তালুকদারের মতে, গেম খেলা বা মোবাইল আসক্তি থেকে সন্তানদের দূরে রাখতে পরিবারে অভিভাবকদের বেশী বেশী সময় দেয়া দরকার। সন্তান মোবাইল ফোন নিয়ে কি করছে সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। করোনার এই সময়ে পারিবারিক আড্ডা, নির্ভরতা এসব আরো বাড়ানো প্রয়োজন। 

তিনি বলেন, আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করবো কিন্তু প্রযুক্তি যেন আমাদের এই প্রজন্মকে শেষ না করে দেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 


এসএ/
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি