ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

অনিয়মে দাঁড়িয়ে হীরক মুশফিকের নিয়োগ

আশিক আরেফীন, জাককানইবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১৭:৫০, ৮ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ১৭:৫২, ৮ জুলাই ২০২১

২০১৮ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিশেষ যোগ্যতায় নাট্যকলা ও পরিবেশনা বিদ্যা বিভাগে অস্থায়ী প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মুশফিকুর রহমান (হীরক মুশফিক)। বিজ্ঞপ্তিতে বিশেষ যোগ্যতার কথা উল্লেখ করা হয় এবং তিনি সেই বিশেষ যোগ্যতায় নিয়োগ পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির আইন ভেঙ্গে তিনি পেয়েছেন বিশেষ পদ্ধতির ছুটি।

সম্প্রতি একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সৈয়দ মামুন রেজা ৭টি ভিন্ন অভিযোগ এনে মুশফিকুর রহমানের (হীড়ক মুশফিক) বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর অভিযোগ করে।

২০১৮ সালের ২৩মে অধ্যাপক পদের বিপরীতে প্রভাষক পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিজ্ঞপ্তিতে একটি বিশেষ ধারা যুক্ত করে বলা হয় বিশেষ যোগ্যতা সম্পন্ন আবেদনকারীর ক্ষেত্রে একাডেমিক ফলাফলের যেকোন একটির আংশিক শিথিল করা যেতে পারে। বিজ্ঞপ্তির প্রেক্ষিতে পরীক্ষায় বসতে পেরেছিলো ১৫ অধিক পরীক্ষার্থী যার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির চাকুরী প্রত্যাশী ৩জন সাবেক শিক্ষার্থীও ছিলেন ।

নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করা ব্যক্তিদের মধ্যে মুশফিকুর রহমানের একাডেমিক সিজিপিএ ছিলো বিজ্ঞপ্তিতে চাওয়া সিজিপিএ ৩.৫০ (৪.০০) থেকে কম ৩.২৫(৪.০০)। কিন্তু আবেদনে বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনশিক্ষা নামক একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকায় আর্টিকেল প্রকাশিত হবে দেখিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্যে সুপারিশ করে ২০১৮ সালের নাট্যকলা বিভাগের প্ল্যানিং কমিটি। যা আবেদন জমার শেষ তারিখের মধ্যে প্রকাশিত হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে সেই সময়কার বিভাগটির প্রধান ইসমত আরা ভূইয়া ইলার ইচ্ছাতেই কম সিজিপিএ থাকা সত্ত্বেও বিশেষ যোগ্যতা দেখিয়ে পরীক্ষায় বসার সুযোগ পেয়েছিলেন মুশফিকুর রহমান। এবং সেই প্ল্যানিং কমিটির সদস্যরাও তাতে সম্মতি দিয়েছিলেন। সেসময়ের প্ল্যানিং কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বিভাগের প্রধান হিসেবে ইসমত আরা ভূইয়া ইলা, বিভাগের অন্য দুই শিক্ষক আল জাবির এবং নীলা সাহা।

পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন এবং মৌখিক পরীক্ষায় এক্সপার্ট শিক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুশফিকুর রহমানের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শাবিন শাহরিয়ার। এই শিক্ষক ইসমত আরা ভূইয়া ইলা এবং আল জাবির দুজনেরও শিক্ষক। তবে নিয়োগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. এস এম ফারুক হোসাইনের প্রভাব রয়েছে বলেও জানিয়েছেন বিভাগটির এক শিক্ষক। নিয়োগ পরীক্ষায় ভালো সিজিপিএ থাকা নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরী প্রত্যাশী সাবেক শিক্ষার্থীর কেউই পাশ করতে পারেনি। পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে এক্সপার্ট ও সেই সময়ের বিভাগ প্রধান ইসমত আরা ভূইয়া ইলা ভালো সিজিপিএ ধারীদের ফেল করিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষকের। সেই সময়ের নিয়োগ প্রাপ্তির দৌঁড়ে এগিয়ে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী সাঈফ মন্ডল। তাকে নিয়োগ দিতেও চেষ্টা করেছিলেন বিভাগটির আরেক শিক্ষক। অভিযোগ রয়েছে পরীক্ষা দিতে আসা সাঈফ মন্ডল কে নিজ উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরিতে থাকারও ব্যবস্থা করে ছিলেন তিনি।

তবে মুশফিকুর রহমানকে নিজের পছন্দের প্রার্থী বলতে নারাজ সেই সময়ে বিভাগটির প্রধান ইসমত আরা ভূইয়া ইলা। তিনি আরো বলেন,বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার মতো করে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছেন সেখানে বিভাগের কিছু করার নেই। নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রশাসন জানে। আমার জানা মতে সেটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হয়েছে।

নিজ বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থীদের ফেল করার কথাও স্বীকার করেছেন তিনি। পাশাপাশি বলেছেন, হীড়ক বিশেষ যোগ্যতায় নিয়োগ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিজ্ঞপ্তির সব নিয়ম মেনেই নিয়োগ হয়েছে।

জনশিক্ষা নামক ত্রৈমাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত আর্টিকেল কে বিশেষ যোগ্যতায় বিবেচনায় নিয়ে এবং লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়ে নিয়োগ পেয়েছেন মুশফিকুর রহমান। যা মানতে নারাজ অভিযোগ জমা দেয়া বিভাগটির শিক্ষক ড. সৈয়দ মামুন রেজা ।

তিনি বলেন, একটি মানহীন জার্নালে লেখা প্রকাশ হবে দেখিয়ে এবং সেটি আবেদন জমার শেষ তারিখের পর প্রকাশিত হয়েছে যা বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী অনৈতিক।

এছাড়া অস্থায়ী নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েও বিভিন্ন রাজনৈতিক সুবিধা প্রাপ্ত হয়েছেন নাট্যকলা ও পরিবেশনা বিদ্যা বিভাগের অভিযুক্ত অস্থায়ী শিক্ষক মুশফিকুর রহমান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি ছুটির আইন অনুযায়ী অস্থায়ী ভাবে চাকুরীতে যোগদানের প্রথম এক বছরের মধ্যে কোন শিক্ষাছুটি না পাওয়ার কথা থাকলেও বিশেষ সুবিধায় নিয়েছেন অসাধারণ ছুটি। নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পরও স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছিলেন কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে মামুন রেজা অভিযোগ তুলেছেন স্নাতকোত্তর শ্রেনীর পরীক্ষার কারণ উল্লেখ না করে কলকাতার রবীন্দ্র ভারতীতে ৩য় সেমিস্টার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।

বিষয়টি আলোচনায় এসে পড়লে বিশেষ ক্ষমতায় অসাধারণ ছুটি নিয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন মুশফিকুর রহমান। অসাধারণ ছুটি গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কৃষিবিদ ড. হুমায়ুন কবীর।

ছুটি প্রাপ্তি নিয়ে সহকারি রেজিস্ট্রার (আইন) মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী অস্থায়ী এবং স্থায়ী কোন ভাবেই নিয়োগের প্রথম বছরে শিক্ষা ছুটি নিতে পারেনা।

প্রক্রিয়াধীন নাট্যকলা বিভাগের আরেকটি নিয়োগে মুশফিকুর রহমানের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু সাঈফ মন্ডলের নিয়োগ প্রাপ্তির জন্যেও তদবির করার অভিযোগও রয়েছে মুশফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে। যেখানে বিভাগের সাবেক ও বর্তমান বিভাগ প্রধান আল জাবিরের নামও রয়েছে সহযোগিতায়। তবে এই অভিযোগ তিনজনই অস্বীকার করেছেন। বিজ্ঞপ্তি হওয়া এবারের নিয়োগ বোর্ডে এক্সপার্ট হিসেবে থাকার কথা রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. এস এম ফারুক হোসাইনের। মুশফিকুর রহমানকে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাইয়ে দেবার ঘটনায় এই শিক্ষকের প্রভাব থাকার কথাও উঠে এসেছে।

মুশফিকুর রহমানকে নিয়োগ এবং ছুটি প্রাপ্তি বিষয়ে কলা অনুষদ ডিন অধ্যাপক ড. আহমেদুল বারী বরেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কিছুই যে প্রশাসন মানে উপাচার্য করেন তা কিন্তু নয়। এরকম ছুটি স্বাভাবিক ভাবে পেতে পারেন না কেউ। তবে একটি শক্তিশালী কমিটি আছে প্রত্যেক বিভাগে। যেটিকে বলা হয় প্ল্যানিং কমিটি। বিভাগের সেই কমিটিই শিক্ষক সংকটের কথা বলে নতুন নিয়োগ চেয়ে চিঠি দেয় প্রশাসনকে আর সেটি প্রশাসন বাস্তবায়ন করে। আবার তারাই যদি চিঠি দিয়ে তাকে ছুটি দিতে চায় নিয়মের বাইরে গিয়ে সেখানে প্রশাসনের কিছুই করার নেই। প্রশাসন চায় বিভাগ গুলো ভালো চলুক। আর আর্টিকেল এবং সেই প্রকাশনা মানসম্পন্ন কিনা তা যাচাই করে আইনের মধ্যে থেকে কাজ করা উচিত। সেই সময়ে আমি ছিলাম না তাই এই বিষয়ে সেই বিভাগ বলতে পারবে তাদের কাছে কি মনে হয়েছে।

তার বিরুদ্ধে প্রকাশ হওয়া বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে মুশফিকুর রহমান বলেন, আমি আলাদা করে কিছু বলতে চাইনা।প্রশাসন আমাকে নিয়োগ দিয়েছে তারাই বলতে পারবে সব কিছু। আমি নিয়ম মেনেই সকল কিছু করেছি।

৭টি অভিযোগ এনে একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সৈয়দ মামুন রেজা বলেন , অনিয়মের পরিমান বেড়ে যাচ্ছিলো বিভাগে তাই অভিযোগ করেছি। আরো আগেই অভিযোগ করার দরকার ছিলো কিন্তু সকল তথ্য সংগ্রহ করতে সময় লাগায় বিলম্ব হয়েছে। আমি অভিযোগ জানিয়েছি প্রশাসন তদন্ত করে প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানাই। যেহেতু এখনো তার নিয়োগ অস্থায়ী তাই স্থায়ী ভাবে যোগ্য কাউকে নিয়োগ প্রদান করা হোক।

এমন অভিযোগ এবং ছুটি ও নিয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কৃষিবিদ ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, আমরা অভিযোগ পেয়েছি। এটি প্রথমে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখবো ঠিক আছে কিনা। যদি আমরা প্রাথমিক ভাবে না পারি তখন কমিটি করে দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। আর ২০১২ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির আইন অনুযায়ী মুশফিকুর রহমান ছুটি পেতে পারেন না তবে বিভাগের চাওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেটিকে আটকায় নি।

প্রসঙ্গত, মুশফিকুর রহমান রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার করে অস্থায়ী অবস্থাতেই দায়িত্ব পেয়েছেন অগ্নিবীণা হলের হাউজ টিউটর পদে। যদিও রাজনৈতিক ভাবে পাওয়ার ঘটনাটি তিনি অস্বীকার করেছেন।

অন্যদিকে অভিযোগকারী শিক্ষক ড. সৈয়দ মামুন রেজার বিরুদ্ধেও বিভাগটির এক শিক্ষক বলেছেন তিনিও কিন্তু কম সিজিপিএ নিয়ে বিভাগের শিক্ষক হয়েছেন, এ-ই উনিই কিভাবে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে? আরেক শিক্ষক বলেন, মামুন ভাই ছিলেন তার স্ত্রীর নিয়োগ বোর্ডে। কেবল তার স্ত্রীর পরীক্ষার সময় বাইরে বের হয়েছিলেন। কিন্তু সিদ্ধান্তের সময় তিনিই ছিলেন। এছাড়া উনি দু’বছরের জন্যে শাস্তি প্রাপ্ত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে।

এসি
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি