ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

অপপ্রচারে ব্যর্থ হলো মুনাফেকরা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৩৬, ২৩ মে ২০২০

পবিত্র কোরআন-এ আল্লাহ রব্বুল আলামীন সূরা আহজাব-এর ২১ নং আয়াতে বলেন, ‘(হে মানুষ!) নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে নবীজীবন সর্বোত্তম আদর্শ।’ নবীজীবন কোরআনের ফলিত রূপ। কোরআন বুঝতে হলে, কোরআনের গভীরে ডুব দিতে হলে নবীজীবনকে জানতে হবে। নবীজীবনকে যত গভীরভাবে অধ্যয়ন করা যায়, নবীপ্রেমে নিজের অন্তরকে যত প্লাবিত করা যায়, ততোই কোরআনের বাস্তব ও পরাবাস্তব জ্ঞানের ছটায় উপকৃত হওয়া যায়। কোরআনে ব্যক্ত ও সুপ্ত সব কথারই মর্মমূলে প্রবেশ করার ফলে; বিশ্বাসের স্তর থেকে উত্তরণ ঘটবে জানার স্তরে। 

প্রথম পর্বে আপনারা জেনেছেন নবী আগমনের পটভূমি। আইয়ামে জাহেলিয়াত। মক্কার বিবর্তন। কাবার নিয়ন্ত্রক বেনিয়া পুরোহিত চক্রের শোষণ ও ভোগবাদী সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে জেনেছেন শূন্য থেকে জীবন শুরু। অনিশ্চয়তার পর অনিশ্চয়তা। নিজ শ্রম ও মেধায় ৩৫ বছর বয়সে আসীন হলেন মক্কার সমাজে উচ্চ মর্যাদায়। তৃতীয় পর্বে আপনারা জেনেছেন জীবনের বাঁকবদল। জাহেলিয়াত থেকে উত্তরণের সূত্র লাভ। আল্লাহ এক, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। সকল মানুষ সমান। শুরু করলেন সত্যের প্রচার। প্রথমে গোপনে। তারপর প্রকাশ্যে। চতুর্থ পর্বে আপনারা জেনেছেন নির্মম নির্যাতন ও উৎপীড়নের মুখে স্বল্পসংখ্যক সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের বিশ্বাস ও অহিংসায় অটল থেকে আত্মিক তূরীয় আনন্দে অবগাহনের বিবরণ। 

পঞ্চম পর্বে জেনেছেন হিজরত- চরম অনিশ্চয়তার মুখে সোনালি সকালের পথে যাত্রার বিবরণ। ষষ্ঠ পর্বে জেনেছেন মদিনায় আগমনের পর সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে ধাপে ধাপে তার ঘর গোছানোর কাহিনী। সপ্তম পর্বে জেনেছেন- সীমিত শক্তি ও উপকরণ নিয়ে বড় বিজয়ের উপাখ্যান। অষ্টম পর্বে জেনেছেন ঘর গোছানোর সাথে সাথে ধনীর সম্পদে দরিদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যাকাতের বিধানাবলির বিবরণ। নবম পর্বে জেনেছেন নিশ্চিত বিজয় বিপর্যয়ে রূপান্তরের উপাখ্যান। দশম পর্বে আপনারা জেনেছেন বিপর্যয় থেকে বিজয়ে উত্তরণের কাহিনী। একাদশ পর্বে আপনারা জেনেছেন- হাজার বছরের শোষণের অবসান ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপনের বিবরণ। এবার দ্বাদশ পর্বে আপনারা জানবেন সাহস ও সমঝোতায় বিজয়ের বিবরণ ও মুনাফেকদের অপপ্রচারের ব্যর্থতার কাহিনী।

সপ্তম স্ত্রী বিবি জয়নব বিনতে জাহ্শ। জয়নব সম্পর্কের দিক থেকে সরাসরি নবীজীর ফুফাতো বোন। জয়নবের মায়ের নাম হচ্ছে উমায়মা বিনতে আবদুল মুত্তালিব। অর্থাৎ জয়নবের নানা এবং মুহাম্মদের দাদা একই ব্যক্তি। মক্কায় তিনি শিশুবয়স থেকে বেড়ে ওঠেন মুহাম্মদের চোখের সামনে অভিজাত পরিবারের সদস্য হিসেবে। মদিনায় হিজরত করার পর শ্রেণিহীন সমাজ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নবীজী এক এক করে পদক্ষেপ নিতে থাকেন। এরই একটি পদক্ষেপ ছিল বিয়ের ক্ষেত্রে অভিজাত ও জাতপাতের ভেদাভেদ অবসান করা।

সদ্য বিধবা জয়নব মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এলে নবীজী মনে করলেন এটা একটা চমৎকার সুযোগ। তিনি তাঁর পালকপুত্র জায়েদের সাথে জয়নবের বিয়ের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। জায়েদ নবীজীর পরিবারে আসার আগে ক্রীতদাস ছিলেন। অভিজাতদের কাছে ক্রীতদাসের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না। ক্রীতদাসকে বিয়ে করা কোনো অভিজাত নারীর জন্যে সামাজিকভাবে লজ্জাজনক বিষয়। তাই জয়নব ও তার ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাহ্শ এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু নিবেদিত বিশ্বাসী হওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত তারা নবীজীর ইচ্ছাকে সম্মান জানালেন। জায়েদের সাথে জয়নবের বিয়ে হলো। কিন্তু সমস্যা থেকেই গেল।

জয়নব দৃঢ়ভাবে মনে করতেন ক্রীতদাসের সাথে বিয়ে হওয়ায় তার সামাজিক সম্মান নষ্ট হয়েছে। ফলে তাদের দুজনের মধ্যে সবসময় দাম্পত্য কলহ লেগেই থাকত। কথায় কথায় জয়নব তার অভিজাত বংশধারার কথা জায়েদকে স্মরণ করিয়ে দিতেন। আসলে কোনো স্ত্রী যদি স্বামীকে সম্মান করতে না পারে, সমস্যা তো থাকবেই। নবীজী এ ব্যাপারে জায়েদকে সবসময়ই ধৈর্য ধরার উপদেশ দিতেন। কিন্তু কলহ জটিলতা ও দাম্পত্য অশান্তি বাড়তেই থাকল। একদিন জায়েদ ঝগড়ার একপর্যায়ে রাগের মাথায় জয়নবকে তালাক দিলেন। জায়েদ তালাক দেয়ায় জয়নব আরো অপমানিত বোধ করলেন।

প্রথমত বিয়েটাই তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি কোরাইশদের হাশেমী নীলরক্তের গর্বে। এরওপর আবার তালাক। জয়নবের মানসিক অবস্থা হলো আরো সঙিন। তিনি তার এই অপমানজনক অবস্থার জন্যে নবীজীকে (যিনি রক্তীয়ভাবে তার সাক্ষাৎ মামাতো ভাই) দায়ী করলেন। জয়নবের আত্মীয়স্বজনেরা নবীজীকে চেপে ধরলেন, এখন এ ব্যাপারে আপনাকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। জয়নবের সামাজিক মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্যে আপনিই তাকে বিয়ে করবেন।

নবীজী জয়নবকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানালেন। কারণ তখনকার প্রচলিত সংস্কার অনুসারে পালকপুত্রকে রক্তীয় পুত্র হিসেবেই গণ্য করা হতো। অবশেষে কোরআনের আয়াত নাজিল হলো: ‘স্মরণ করো! (হে নবী!) আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন ও তুমি যাকে মমতা দিয়েছ, তাকে তুমি বলেছিলে, ‘তুমি তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছে রেখো এবং আল্লাহ-সচেতন থেকো।’ তখন তুমি তোমার অন্তরে যা লুকিয়েছিলে, আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিয়েছেন। তুমি লোকনিন্দার ভয় করেছিলে, অথচ আল্লাহর (বিরাগভাজন হওয়ার) ভয় করাই ছিল তোমার জন্যে অধিক যুক্তিযুক্ত। তারপর জায়েদ যখন (জয়নবের সাথে) বিবাহ-সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে তোমার সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ করলাম। এর কারণ ছিল, ভবিষ্যতে বিশ্বাসীদের দত্তকপুত্ররা নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহ-সম্পর্ক ছিন্ন করলে, সেই রমণীকে বিয়ে করতে বিশ্বাসীদের যেন কোনো বাধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ অবশ্যই পালিত হবে। আল্লাহ নবীর জন্যে যা নির্ধারণ করেছেন, তা পূরণ করতে তার কোনো বাধা নেই। পূর্ববর্তী নবীদের জন্যেও এটাই ছিল আল্লাহর চিরায়ত বিধান। (মনে রেখো) প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুসারেই তার জন্যে আল্লাহর বিধান নির্ধারিত হয়।’ (সূরা আহজাব : ৩৭-৩৮)

পালকপুত্র কখনো রক্তীয় পুত্র হতে পারে না। আসলে এই প্রাকৃতিক সত্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যেই আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিলেন জয়নবকে বিয়ে করার। মুহাম্মদ জয়নবকে বিয়ে করলেন। তখন জয়নবের বয়স ৩৫ বছর। নবীজী জাতপাতের সংস্কার ভাঙার দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্যে, মানুষের মর্যাদাকে সমুন্নত করার জন্যে নিজে উদ্যোগী হয়ে জয়নবকে পুত্রতুল্য জায়েদের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। রূপ বা সৌন্দর্যের জন্যে যদি জয়নবকে বিয়ে করার কোনো অভিপ্রায় তাঁর থাকত, তবে তিনি প্রথমেই জয়নবকে বিয়ে করতে পারতেন। আসলে আল্লাহ নবীকে দিয়ে আরেকটি সামাজিক সংস্কার ভাঙাবেন, নতুন আইনের প্রচলন করবেন, সেজন্যেই ঘটনাক্রম এইভাবে ঘটেছে। 

বিবি জয়নব অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন নারী ছিলেন। স্বাবলম্বী ছিলেন। দাতা ছিলেন। নিজে কাপড় সেলাই ও চামড়া ট্যান করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এমনকি পরবর্তীকালে খলিফা ওমর তার জন্যে ১২ হাজার দিরহাম রাষ্ট্রীয় ভাতার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। আজীবন তিনি কারো কোনো সাহায্য গ্রহণ করেন নি। নবীজীর ওফাতের পর তাঁর বিবিদের মধ্যে প্রথম মারা যান বিবি জয়নব; হিজরি ২০ সালে। নবীজী তাঁর জীবদ্দশায় ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘তাঁর মৃত্যুর পর বিবিদের মধ্যে যার হাত লম্বা সে আগে তাঁর সাথে মিলিত হবে।’ এ কথা শোনার পর সবাই কাঠি নিয়ে হাত মাপতে শুরু করলেন। মাপে বিবি সওদার হাতই সবচেয়ে লম্বা হিসেবে প্রতীয়মান হলো। কিন্তু যখন জয়নব মারা গেলেন, তখন সবাই বুঝলেন যে, ‘লম্বা হাত’ বলতে নবীজী দাতার হাত বুঝিয়েছেন। খলিফা ওমর তার জানাজা পড়ালেন।

আল্লাহর কাছে নবীজীর মর্যাদা সম্পর্কে এসময় সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়: ‘(অতএব হে মানুষ! মনে রেখো) মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নয়। বরং সে আল্লাহর রসুল ও শেষ নবী। আল্লাহ সব বিষয়ে সবকিছু জানেন।’ (সূরা আহজাব : ৪০) 

ক্ষমা ও মহানুভবতার কারণে মুহাম্মদ সবসময়ই ছিলেন তাঁর চারপাশের মানুষের জন্যে শান্তি ও শক্তির আশ্রয়স্থল। এমনকি নবুয়তের আগেও মক্কায় বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়রা তাঁর সময় ও মনোযোগ দুটোই দাবি করত। তখন এটা তাঁর জন্যে কোনো সমস্যা ছিল না। তিনি সবসময়ই প্রত্যেককে সহযোগিতা করতেন। ওহুদের যুদ্ধের পর সর্বমুখী সামাজিক দায়িত্ব যেমন বেড়ে গেল, তেমনি ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করল নতুন সমস্যা। দেখা করতে এলে বা দাওয়াতে ঘরে এলে কেউ আর উঠতে চাইত না। তাঁর জীবন হয়ে উঠেছিল বিপন্ন।

নবীজীর ওপর এই অস্বাভাবিক চাপ কমানোর জন্যে নাজিল হলো: ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা বিনা অনুমতিতে নবীর ঘরে প্রবেশ কোরো না। দাওয়াত দেয়া হলেও এত আগে ঘরে প্রবেশ করবে না, যাতে খাবার তৈরি হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে হয়। যখন তোমাদের খাবারের জন্যে ডাকা হবে, তখন প্রবেশ করবে। তারপর খাওয়া শেষ হলে দেরি না করে উঠে পড়বে। কখনো খোশগল্পে মশগুল হয়ো না। কারণ তা নবীর জন্যে কষ্টদায়ক হতে পারে। কিন্তু সংকোচের কারণে সে তোমাদের উঠে যেতে বলতে পারবে না। কিন্তু আল্লাহ উচিত বিষয় শিক্ষা দিতে সংকোচ বোধ করেন না।

তোমরা নবীপত্নীদের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এ নিয়ম তোমাদের ও তাদের অন্তরের পবিত্রতা গভীর করবে। আল্লাহর রসুলকে কষ্ট দেয়া তোমাদের কারো জন্যেই উচিত নয়। আর নবীর মৃত্যুর পর তার পত্নীদের বিয়ে করাও তোমাদের কারো জন্যে বৈধ নয়। আল্লাহর কাছে এটি গুরুতর অপরাধ।’ (সূরা আহজাব : ৫৩) সমমর্মিতাই ছিল নবীজীর মূল শক্তি।

আর তাঁর আসল সাফল্য ছিল, দৈনন্দিন জীবনে কোরআনের শিক্ষাকে কীভাবে প্রয়োগ করতে হয় তার বাস্তব উদাহরণে পরিণত হওয়া। এটি নিঃসন্দেহে আল্লাহর সবচেয়ে বড় দয়া ও রহমত। আয়াত নাজিল হলো- ‘আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর প্রতি রহমত বর্ষণ করেন। অতএব হে বিশ্বাসীগণ! তোমরাও নবীর ওপর রহমত বর্ষণের জন্যে দোয়া করো এবং তার প্রদর্শিত পথে নিজেকে সমর্পিত করো।’ (সূরা আহজাব : ৫৬)

নবীজী যেহেতু আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত, তাই প্রত্যেক বিশ্বাসীর জন্যে তাঁর প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণ সবচেয়ে আনন্দের কাজে রূপান্তরিত হলো। শেষ নবী হওয়ার চূড়ান্ত সম্মানে ভূষিত হওয়ার পরও তিনি মুসলমানদের শিক্ষা দিয়েছেন, তোমরা কখনো আল্লাহর নবীদের মধ্যে পার্থক্য করবে না। এসময় একজন ইহুদির সাথে একজন মুসলমানের ঝগড়া বাঁধে। ঝগড়ার একপর্যায়ে ইহুদি মুসার নামে শপথ করে বক্তব্য দেয়। মুসলমান যুবকটি তখন ‘আমাদের মাঝে নবী থাকতে তুমি মুসার নাম নিচ্ছ!’ বলে ফোড়ন কাটে।

ঘটনাটি নবীজীর কাছে উপস্থাপিত হলে তিনি মুসলিম যুবককে তিরস্কার করেন নবীদের মধ্যে পার্থক্য করার জন্যে। তিনি তেলাওয়াত করেন: ‘মহান প্রতিপালকের কাছ থেকে যে বিধিবিধান নাজিল হয়েছে, রসুল এবং তার সঙ্গী বিশ্বাসীরা তাতে পুরোপুরি বিশ্বাস করে। আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর প্রেরিত কিতাব ও তাঁর রসুলগণকে তারা সকলেই বিশ্বাস করে। তারা বলে, আমরা আল্লাহর রসুলগণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না। আমরা তোমার নির্দেশ শুনেছি এবং মেনে নিয়েছি। হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত আমরা তোমার কাছেই ফিরে যাব।’ (সূরা বাকারা : ২৮৫)

গাতাফানদের বেশ কয়েকটি গোত্র মদিনা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে জানতে পেরে নবীজী জনযোদ্ধাদের ৭০০ জনের একটি দল নিয়ে রওনা হলেন নজদের উদ্দেশ্যে। অভিযাত্রার বর্ণনায় বিশিষ্ট সাহাবী আবু মুসা আল-আশয়ারী বলেন, পথ ছিল দুর্গম। আমাদের ছয় জনের জন্যে ছিল একটি উট। পালাক্রমে আমরা উটের পিঠে উঠতাম। পাথুরে পথে হাঁটতে গিয়ে আমাদের সবারই পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। আমার পায়ের আঙুলের নখ উপড়ে গিয়েছিল। মোটা কাপড় টুকরো করে পা বেঁধে আমরা হেঁটেছি। আমাদের কোনো জুতা ছিল না। টুকরো কাপড়ে পা বাঁধার কারণে এই অভিযাত্রা ইতিহাসে পরিচিত ‘জাত-আল-রিকা’ নামে।

মুসলমানরা যখন নজদের কেন্দ্রস্থল নাখালায় পৌঁছল তখন হঠাৎ করেই তারা আক্রমণের জন্যে সমবেত এক বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হলো। দুই পক্ষেই তখন তটস্থ অবস্থা। মুসলমানরা দ্বিধান্বিত সমবেত শত্রুবাহিনীর বিশাল সংখ্যাধিক্যের কারণে। আর গাতাফানরা শঙ্কিত হলো মুসলমানদের সাহসিকতা দেখে। দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয়া সত্ত্বেও তারা সরাসরি সংঘাত এড়াতে চাচ্ছিল। আর নবীজীর রণকৌশলই হচ্ছে সরাসরি সংঘাত এড়ানো। তিনি কোনোরকম সংঘর্ষ ছাড়াই জনযোদ্ধাদের নিয়ে ফিরে এলেন। যদিও কোনো সংঘর্ষ হয় নি, তবুও বিশ্বাসীরা আক্রমণ মোকাবেলার জন্যে যে এত দূর আসতে পারে, এটারও একটা বড় প্রভাব পড়ল শত্রুপক্ষের ওপর।

এই অভিযাত্রায় নবীজী প্রথম ‘সালাতুল খওফ’ অর্থাৎ ‘ভয়ভীতি দূরের নামাজ’ আদায় করলেন। এই নামাজে নবীজীর পেছনে প্রথমে একদল প্রথম রাকাত আদায় করে দ্বিতীয় রাকাত ব্যক্তিগতভাবে সম্পন্ন করল, দ্বিতীয় দল সশস্ত্র অবস্থায় পাহারায় থাকল। এরপর দ্বিতীয় রাকাতে তারা নবীজীর পেছনে জামাতে অংশ নিল। আর প্রথম দল পাহারায় নিযুক্ত থাকল। এইভাবে উভয় দলই নবীজীর পেছনে নামাজ আদায় করল। আল্লাহ-সচেতনতা ও বিশ্বাস একজন মানুষের কত গভীরে প্রবেশ করতে পারে, ‘জাত-আল-রিকা’ অভিযাত্রায় তারও দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো।

মুহারিব গোত্রের ঘাওরাথ নামে এক সাহসী যুবক গোত্রের লোকদের বলল যে, সে ইচ্ছা করলে মুহাম্মদকে হত্যা করতে পারে। তারা জিজ্ঞেস করল, কীভাবে? যুবক বলল, ‘খুব সহজ। তিনি যখন অসতর্ক অবস্থায় বিশ্রামরত থাকবেন, তখন আমি তার কাছে যাব এবং হত্যা করব।’ যুবক একা বেরিয়ে পড়ল। সুযোগ অনুসন্ধান করতে লাগল। এক দুপুরে বিশ্রাম নেয়ার জন্যে জনযোদ্ধারা থামল। নবীজী একটি গাছের ডালে তলোয়ার ঝুলিয়ে রেখে ছায়ায় বিশ্রাম নেয়ার জন্যে চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলেন। সাহাবীরা আশেপাশে বিশ্রামের জন্যে ছড়িয়ে পড়লেন। বেদুইন ঘাওরাথ দূর থেকে দেখল এই সুযোগ।

খুব সংগোপনে কাছে এসে ডাল থেকে তলোয়ার নামিয়ে খাপ খুলে উঁচিয়ে গর্জন করে উঠল, ‘মুহাম্মদ! আমার হাত থেকে এখন কে তোমাকে রক্ষা করবে?’ নবীজীর তন্দ্রা ছুটে গেল। চোখ মেলে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে যুবককে দেখে তিনি শুধু একটি শব্দই উচ্চারণ করলেন, ‘আল্লাহ!’ ধ্বনি ও বিশ্বাসের অনুরণন আততায়ীর অন্তরকে কাঁপিয়ে দিল। কাঁপতে কাঁপতে তার হাত থেকে তলোয়ার পড়ে গেল। নবীজী এবার তলোয়ার তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তলোয়ার উঁচিয়ে বললেন, ‘এখন আমার হাত থেকে কে তোমাকে রক্ষা করবে?’ বেদুইন যুবক কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আপনার দয়া। আমি শপথ করছি কখনো আপনার বিরুদ্ধে লড়ব না এবং এমন কারো সাথে যোগ দেবো না, যে আপনার বিরুদ্ধে লড়াই করবে।’ নবীজী তাকে ছেড়ে দিলেন।

সে তার গোত্রের কাছে ফিরে গিয়ে বলল, ‘আমি এইমাত্র পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষের সাথে দেখা করে এসেছি।’ গোত্রের লোকদের কাছে ঘটনা বর্ণনা করে আবার নবীজীর কাছে ফিরে এসে সে ইসলাম গ্রহণ করল। নামাজ কত তৃপ্তির হতে পারে, কত অপার্থিব আনন্দের হতে পারে ‘জাত-আল-রিকার’ আরেকটি ঘটনা থেকে তা বোঝা যায়। অভিযাত্রার একপর্যায়ে শিবির পাহারা দেয়ার জন্যে রাতের বেলায় দুজনকে দায়িত্ব দেয়া হলো। একজন হচ্ছেন আনসার আব্বাদ ইবনে বিশর। আরেকজন মোহাজের আম্মার ইবনে ইয়াসির। ঠিক হলো রাতের প্রথম অংশে আম্মার ঘুমাবে আর আব্বাদ জেগে থাকবে। দ্বিতীয় অংশে আব্বাদ ঘুমাবে, আম্মার জেগে থাকবে।

রাত শুরু হলো। আব্বাদ পাহারা দিচ্ছেন। তিনি নামাজে দাঁড়ালেন। প্রতিপক্ষ বেদুইনদের একজন দূর থেকে নজর রাখছিল শিবিরের ওপর। সে একটু কাছে এসে বুঝল একজন দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে। বেদুইন এবার তীর মারল। তীর এসে বিঁধল আব্বাদ-এর শরীরে। আব্বাদ এক হাত দিয়ে তীর বের করে ফেলে দিলেন এবং কোনোরকম বিরতি ছাড়াই নামাজে সূরা পড়তে থাকলেন। বেদুইন দ্বিতীয় তীর মারল। এটাও তার গায়ে বিঁধল, কিন্তু আব্বাদ কোনোরকম নড়াচড়া না করে এ তীরটিও টেনে বের করে ফেলে দিলেন এবং সূরা পড়া অব্যাহত রাখলেন। নামাজরত অবস্থায় তৃতীয় তীর এসে গায়ে বিঁধল। তিনি সেটাও টেনে বের করে ফেলে রুকু সেজদা দিয়ে নামাজ শেষ করলেন। তারপর সঙ্গী মোহাজেরকে ডেকে তুলে বললেন যে, তিনি আহত হয়েছেন।

তিনি আরো আগে ডাক দিলেন না কেন, আম্মার এ কথা জানতে চাইলে আব্বাদ বললেন, নামাজে সূরা পাঠ করে এত ভালো লাগছিল যে, সূরাটি মাঝপথে সমাপ্ত করার সুযোগ থাকলেও আমি কিছুতেই তা করি নি। অপার্থিব আনন্দ ভেঙে যাক, তা আমি চাচ্ছিলাম না। যদি আমার মনে না হতো যে, নবীজী আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা যথাযথভাবে পালন করা হবে না, তাহলে আমি তোমাকে ডাকতাম না। আমার গলা কেটে ফেললেও সূরা পাঠের, নামাজের আনন্দলোকেই নিজেকে নিমগ্ন রাখতাম। সাহাবীরা নামাজের অপার্থিব আনন্দলোক থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইতেন না। এ-ক্ষেত্রে তার নামাজে নিমগ্নতা বিশ্বাসীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কারণ হতে পারে বলে মনে করাতেই তিনি নামাজ দ্রুত শেষ করেছেন।

বেদুইন গোত্রগুলোকে নিবৃত্ত করার পর নবীজী (হিজরি-৪ শাবান মাস ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দ জানুয়ারি) ১৫০০ জনযোদ্ধা ১০টি ঘোড়া নিয়ে বদরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। বিশ্বাসীরা তখন ওহুদের গ্লানি পুরোপুরি ভুলে গেছে নতুন শিক্ষা নিয়ে, সর্বাবস্থায় নবীজীর সিদ্ধান্ত অনুসরণের প্রত্যয়ে। বদর যাত্রায় যাতে মুসলমানরা বিরত থাকে এজন্যে আবু সুফিয়ান গাতাফানদের অন্যতম নেতা নুয়াইম ইবনে মাসুদকে মদিনায় গুজব প্রচারের জন্যে প্রেরণ করল। সে সর্বত্র প্রচার করে বেড়াল ওহুদের চেয়েও এক বিশাল বাহিনী নিয়ে কোরাইশরা বদরে আসার প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু নবীজীর কর্মপরিকল্পনায় এর কোনো প্রভাব পড়ল না। তিনি খুব পরিষ্কারভাবে বললেন, ‘কেউ না গেলেও আমি একা বদরে যাব।’ বাস্তবে নবীজীর সঙ্গছাড়া হয় নি কেউ।

খরার বছর কোনোকিছুই কোরাইশদের অনুকূলে থাকে না। অতএব এবার আর বদরে যুদ্ধযাত্রার প্রয়োজন নেই। নবীজী মদিনা থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে সমবেত হলেন। মদিনার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-এর হাতে। আবু সুফিয়ান ২০০০ সৈন্য ও ৫০ জন অশ্বারোহী নিয়ে মক্কা থেকে যাত্রা করে ৪০ কিলোমিটার দূরে এসে শিবির স্থাপন করলেন। অর্থনৈতিক অবরোধের প্রভাব কোরাইশদের ওপর ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। আর সেইসাথে খরা। তিনি সমবেত বাহিনীকে বললেন, দেখ, খরার বছর কোনোকিছুই কোরাইশদের অনুকূলে থাকে না। অতএব এবার আর বদরে যুদ্ধযাত্রার প্রয়োজন নেই। আমরা পরে ভালো সময়ে সুযোগমতো যাব। তিনি মক্কায় ফেরতযাত্রা শুরু করলেন। তার সাথে সাথে পুরো বাহিনীও ফেরত গেল। মক্কায় তখন এই বাহিনী অভিহিত হলো কাপুরুষরূপে।

নবীজী বদরে আট দিন অবস্থান করলেন। তখন বদরে চলছিল আঞ্চলিক বাণিজ্যমেলা। যুদ্ধ করতে না পারলেও মুসলমানরা জনসংযোগ ও ব্যবসা করে লাভবান হলো সবদিক থেকেই। ওহুদের গ্লানি পুরোপুরিই ঝরে গেল এবার। মুসলমানরা আবার পুরো আরবেই এক অপ্রতিহত শক্তি হিসেবে প্রতিভাত হয়ে উঠল এবং দ্বিতীয় বদরে কোনো যুদ্ধ ছাড়াই মুসলমানরা বিজয়ী হিসেবে আরবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করল। দ্বিতীয় বদর অভিযানের কয়েক মাস পর নবীজী এবার ১০০০ জনযোদ্ধা নিয়ে উত্তর আরবে সিরীয় সীমান্তের কাছাকাছি দু’মাত-আল-জান্দালে অভিযান চালালেন। তারা রাতে চলতেন। দিনে শিবিরে অবস্থান করতেন, যাতে ওরা টের না পায়। ১৫ দিনে মদিনা থেকে ৫০০ মাইল অতিক্রম করে যখন তারা লক্ষ্যস্থলে পৌঁছলেন, তখন দেখলেন বিরোধীরা শিবিরে সকল গবাদি পশু রেখে চারদিকে পালিয়ে গেছে। 

তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্যে চারদিকে ছোট ছোট দল পাঠালেও কারো পাত্তা পাওয়া গেল না। কালব গোত্র মদিনা আক্রমণের জন্যে বেদুইনদের সমবেত করলেও তারাও মুসলমানদের উপস্থিতি টের পেয়েই পালিয়ে গেল। পরে তারা মুসলমানদের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করল। এই দুঃসাহসী যাত্রা ও যাত্রাকালীন জনযোদ্ধাদের পারস্পরিক একাত্মতা ও সন্ধির প্রশংসা করে কোরআনে বলা হয়: 

‘আর প্রতিপক্ষ যদি সন্ধি করতে চায়, তবে তুমিও সন্ধির ব্যাপারে মনোযোগী হবে এবং আল্লাহর ওপর নির্ভর করবে। নিশ্চয়ই তিনি সব শোনেন, সব জানেন। আর সন্ধি করার নামে যদি তারা তোমাকে ধোঁকা দিতে চায়, তবে তোমার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহই তোমাকে নিজে সাহায্য দিয়েছেন, সেইসাথে বিশ্বাসীদের দিয়ে তোমাকে শক্তিশালী করেছেন। তাদের মধ্যে একাত্মতা সৃষ্টি করেছেন। তুমি যদি সারা পৃথিবীর ধনসম্পত্তি তাদের পেছনে ব্যয় করতে, তাহলেও তাদের এভাবে পরস্পর একাত্ম করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের একাত্ম করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশক্তিমান ও প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা আনফাল : ৬১-৬৩)

দু’মাত-আল-জান্দাল অভিযাত্রা অন্যান্য অভিযাত্রা থেকে একেবারেই আলাদা। ওখান থেকে মদিনায় কোনো আশু আক্রমণের আশঙ্কা না থাকলেও ভবিষ্যত জটিলতা সৃষ্টি হতো। কারণ ইতোমধ্যেই তারা নিকটবর্তী বাণিজ্যপথের জন্যে হুমকি হয়ে উঠেছিল। মদিনার বাণিজ্য বিপন্ন হতে পারত। দু’মাত অভিযান সিরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত বেদুইনদের নিশ্চিত করল যে মদিনার শক্তি বলয়ের মধ্যেই তারা রয়েছে। এত বড় বাহিনী নিয়ে এত দূরে অভিযাত্রা আরব মরুতে মদিনার শক্তি সম্পর্কে নতুন আস্থার সঞ্চার করল। 

দু’মাত অভিযাত্রার সময় নবীজী মদিনার দায়িত্ব অর্পণ করে যান সিবা ইবনে আরফাতাহ আল গিফারীকে। সিবা ছিলেন গিফার গোত্রভুক্ত। আউস, খাজরাজ বা কোরাইশ গোত্রের বাইরে এই প্রথম কাউকে মদিনার দায়িত্ব দেয়া হয়। ইসলাম পূর্ব যুগে গিফার গোত্র মরু বাণিজ্যপথে ডাকাতির জন্যে কুখ্যাত ছিল। তাকে নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে নবীজী দেখতে চেয়েছিলেন, মুসলমানদের মানস। তারা গোত্রীয় সংস্কৃতি থেকে কতটা বেরিয়ে আসতে পেরেছে। তারা কি এখনো একে অপরকে আমার গোত্র বা বহিরাগত হিসেবেই বিবেচনা করে, না তারা একজন আরেকজনকে মুসলমান হিসেবে বিবেচনা করে।

গোত্র, সামাজিক মর্যাদা ও আভিজাত্য নির্বিশেষে মনোনীত নেতাকে অনুসরণ করার শিক্ষাই নবীজী সবসময় দিয়েছেন। ওহুদের পর বনু নাদির, গাতাফান, দ্বিতীয় বদর ও দু’মাত-আল-জান্দাল অভিযাত্রা-কোনো অভিযানেই কোনো রক্তপাত হয় নি। কিন্তু চারটি অভিযান মুসলমানদের শক্তিকে এক সুসংহত রূপ দিল। শোষক-বেনিয়ারা বুঝতে পারল বিক্ষিপ্তভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কিছু করে কোনো লাভ হবে না। যারা মুসলমানদের শক্তির ব্যাপারে দোদুল্যমানতায় ভুগছিল তারা নিরপেক্ষ বা সহযোগী হয়ে থাকাটাই যুক্তিসঙ্গত মনে করতে শুরু করল।

দূরযাত্রায় অনেক সময়ই পানি পাওয়া যেত না। পানি পাওয়া না গেলে পবিত্রতার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তায়াম্মুমের বিধান নাজিল হলো: ‘হে বিশ্বাসীগণ! নামাজে দাঁড়ানোর আগে তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল এবং কনুই পর্যন্ত হাত ধোবে। মাথায় ভেজা হাত বোলাবে এবং পা গোড়ালি পর্যন্ত ধোবে। অপবিত্র থাকলে গোসল করে পবিত্র হবে। তোমরা যদি অসুস্থ থাকো বা সফরে থাকো বা মলমূত্র ত্যাগ করে আসো বা স্ত্রীর সাথে সহবাস করে থাকো, তবে পানি পাওয়া না গেলে পরিষ্কার মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করবে (অর্থাৎ পরিষ্কার মাটির ওপর হাত রেখে হাতের তালু মুখে ও দুহাতে বুলিয়ে নেবে)। আল্লাহ তোমাদের কষ্ট দিতে চান না, তিনি তোমাদের পবিত্র করতে চান। তিনি তোমাদেরকে তাঁর নেয়ামত দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিতে চান, যাতে তোমরা শোকরগোজার হতে পারো। (সূরা মায়েদা: ৬)

মক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত বনু মুস্তালিক। মক্কা যেতে হলে মুসলমানদের এই পথই ব্যবহার করতে হবে। আর এরা ছিল কোরাইশদের মিত্র। বনু মুস্তালিক গোত্রপ্রধান হারিস ইবনে আবি দিরার কোরাইশদের প্ররোচনায় মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গোপন তথ্য পেয়ে মুহাম্মদ ৩০ জন অশ্বারোহী ও ৭০০ জনযোদ্ধা নিয়ে অভিযাত্রা করলেন। এই প্রথমবারের মতো যোদ্ধাদলে বিপুলসংখ্যক মুনাফেকও অংশ নিল। মুসলমানরা মুরাইসি ঝর্নার কাছে পৌঁছলে দুই পক্ষের সংঘর্ষে বনু মুস্তালিকের ২০ জন প্রাণ হারাল। মুসলিম পক্ষে একজন শহিদ হলেন।

যুদ্ধে বনু মুস্তালিক গোত্রের ৬০০ জনকে বন্দি করা হলো। ২০০০ উট ও ৫০০০ গবাদি পশু মুসলমানদের হস্তগত হলো। গোত্রপতি হারিস কিছু সদস্যসহ পালিয়ে গেলেন। বন্দিদের মধ্যে গোত্রপতি হারিস-কন্যা বারাহও ছিল। তখনকার প্রচলিত নিয়ম অনুসারে যুদ্ধবন্দি নারী বা পুরুষের পরিণতি ছিল দাসত্ব অথবা তাদের আত্মীয়েরা মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করলে ভিন্ন কথা। প্রায় একটা পুরো গোত্র দাসত্বের মুখোমুখি। নবী এসেছেন মানুষকে অন্যের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে। তিনি যুদ্ধ করেন বাধ্য হয়ে নিজের ধর্মরক্ষায়, শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মপ্রচারের পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্যে। ধনসম্পদ লুট বা মানুষকে দাস বানানোর জন্যে নয়। তিনি পুরো গোত্রকে দাসত্বমুক্ত করতে অবলম্বন করলেন অভিনব পন্থা।

অষ্টম স্ত্রী বিবি জোয়াইরিয়া বনু মুস্তালিক গোত্রপতি হারিসের কন্যা বারাহ। তার পিতা এবং স্বামী দুজনই নবীজীর ঘোর শত্রু। স্বামী মাসফাহ ইবনে সাফওয়ান যুদ্ধে নিহত হন। বারাহ বন্দি হন। দাসী হিসেবে তিনি পড়েন সাবিত ইবনে কায়েসের ভাগে। তিনি সাবিতকে অনুরোধ করেন মুক্তিপণ নিয়ে তাকে মুক্ত করে দেয়ার। সাবিত অনুরোধে সম্মত হন। যেহেতু তিনি নিশ্চিত ছিলেন তার বাবা তাকে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করবেন; তাই তিনি এ ব্যাপারে নবীজীর সহযোগিতা নেয়ার চিন্তা করলেন। এদিকে গোত্রপতি হারিস তার কন্যার মুক্তির জন্যে নবীজীর সাথে দেখা করলেন। তখন নবীজী তাকে বললেন, বিষয়টি মেয়ের হাতে ছেড়ে দিন।

বারাহ নবীজীর কাছে মুক্তিপণে সহযোগিতার জন্যে এলেন। নবীজী তাকে প্রস্তাব করলেন, তুমি কি আরো ভালো কিছু চাও? বারাহ বললেন, সেটা কী? নবীজী বললেন, আমি তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি। তুমি রাজি হলে তোমার পক্ষ থেকে আমি মুক্তিপণ শোধ করব। বারাহ আনন্দিতচিত্তে সম্মতি জানালেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। নবীজী তখন তার নাম রাখলেন জোয়াইরিয়া। জোয়াইরিয়া তখন তার বাবাকে বললেন, আমি আল্লাহর রসুলের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

নবীজীর সাথে জোয়াইরিয়ার বিয়ের সংবাদ শুনে সাথে সাথে মুসলমানরা বনু মুস্তালিকের বন্দিদের মুক্ত করে দিলেন। ফিরিয়ে দিলেন তাদের সম্পদ ও মালামাল। তাদের বক্তব্য, রসুলের আত্মীয়েরা কখনো আমাদের দাস হতে পারে না। মুক্তি লাভ করে সবাই ইসলাম গ্রহণ করলেন। গোত্রপতি হারিসও ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিলেন। বিয়ের মধ্য দিয়ে লোহিত সাগরের পথের ওপর মদিনার নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় হলো। বিবি আয়েশা সিদ্দিকা জোয়াইরিয়া সম্পর্কে বলেন যে, কোনো নারীই তার গোত্রের জন্যে এর চেয়ে বেশি সম্মান ও সৌভাগ্য কখনো বয়ে আনতে পারে নি। 

অভিযান শেষে আল মুরাইসীতে অবস্থানকালে কূপ থেকে পানি নেয়ার সময় ওমর ইবনে খাত্তাবের কর্মচারী জাহজা আল গিফারীর সাথে সিনান ইবনে ওযারর আল জুহানীর মধ্যে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতির এক পর্যায়ে জুহানী ‘হে আনসাররা!’ বলে চিৎকার করে সাহায্য চায়। অপরদিকে জাহজা ‘হে মোহাজেররা!’ বলে তার সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্যে আহ্বান জানায়। যা ছিল এক আনন্দঘন পরিবেশ, তা মুহূর্তে আনসার-মুহাজেরদের দুই পক্ষের কিছু লোকের উত্তেজিত জটলায় পরিণত হয়। মুনাফেক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আনসারদের উস্কে দেয়ার চেষ্টা করে।

নবীজী ঘটনা জানার সাথে সাথে সেখানে উপস্থিত হন। জাহেলি যুগের আচরণের জন্যে সবাইকে ভর্ৎসনা করেন এবং সবাইকে বিস্মিত করে দ্রুত শিবির তুলে ফেরত যাত্রার নির্দেশ দেন। নবীজী কখনোই দিনের এইসময়ে মরু পথে যাত্রা করতেন না। অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার এর চেয়ে চমৎকার প্রক্রিয়া আর কী হতে পারে! বাহিনী সেই প্রখর রোদেই যাত্রা শুরু করল। সারাদিন সারারাত যাত্রা চলল। পরদিন ভোরের সূর্য ওঠার অনেক পরে যাত্রাবিরতি দেয়া হলো। সবাই তখন এতই ক্লান্ত-শ্রান্ত যে, কোনোকিছু চিন্তা করার অবকাশ তাদের ছিল না। পরিশ্রান্ত তারা গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লেন।

ঘুম যখন ভাঙল তখন সবাই ভুলে গেল আগের দিনের ঘটনা। নবীজী পানির ঘটনা নিয়ে কোনোরকম চর্চা করারই সুযোগ দেন নি। এ নিয়ে কোনো কথা শুনতেও চান নি। সালিশ দরবারও করেন নি। আসলে আবর্জনা যত ঘাটা হয়, দুর্গন্ধ তত ছড়ায়। অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার এর চেয়ে চমৎকার প্রক্রিয়া আর কী হতে পারে!

মুনাফেকরা পানির ঘটনায় সুবিধা করতে না পারলেও তারা হাল ছাড়ে নি। ফেরার পথে শেষ যাত্রাবিরতি হলো মদিনার কাছাকাছি। আর এখানকার একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা লিপ্ত হলো জঘন্য অপপ্রচারে। কাফেলায় নবীজীর সফর সঙ্গীদের মধ্যে বিবি আয়েশাও ছিলেন। কাফেলা আবার যাত্রার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিবি আয়েশা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরে আসার পর খেয়াল হলো তার ওনিক্সের গলার মালাটা হারিয়ে গেছে। তিনি মালার খোঁজে পা পা করে আগের জায়গায় গেলেন। মালাটা খুঁজে পেলেন। মালা নিয়ে কাফেলার বিশ্রামস্থলে ফিরে এসে দেখলেন কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। 

অস্থির না হয়ে এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি না করে সেখানেই বসে পড়লেন তিনি। যাতে লোকজন খুঁজতে এলে তাকে এখানেই পায়। কিছুক্ষণ পর কাফেলার পেছনে আসা সাফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল বিবি আয়েশাকে চিনতে পারলেন। তিনি অত্যন্ত সম্মানের সাথে বিবি আয়েশাকে তার উটের পিঠে উঠিয়ে নিজে পেছনে পেছনে যত দ্রুত সম্ভব হেঁটে মদিনার পথে রওনা হলেন। উদ্দেশ্য, পথেই যাতে কাফেলাকে ধরা যায়। কিন্তু কাফেলা তার চেয়েও দ্রুত গতিতে মদিনায় পৌঁছে যায়। বিবি আয়েশা মদিনায় পৌঁছান সাফওয়ানের উটে প্রকাশ্য দিবালোকে। তিনি ঘরের সামনে এসে উট থেকে নামেন এবং ঘরে প্রবেশ করেন। ঘটনা এতুটুকুই।

কিন্তু এরপর শুরু হলো রটনা। বিবি আয়েশার চরিত্রহননের সর্বাত্মক প্রয়াস। শুধু যে মুনাফেকরা এ অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল, তা নয়। কিছু কিছু বিশ্বাসীও চরিত্রহননের এই অপপ্রচারে জড়িয়ে পড়লেন। আসলে সব যুগেই পুরুষদের একটা শয়তানী শ্রেণি অন্যের, বিশেষত নারীর চরিত্রহননের অপপ্রচারে একটা বিকৃত আনন্দ পায়। এ নিয়ে মদিনার সর্বত্র গুজবে সয়লাব হয়ে গেল। অপপ্রচার চলল পুরো মাস। নবীজী কয়েকজন সাহাবার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন, কিন্তু কোনো সমাধান বের হলো না। 

বিবি আয়েশা এ সময় অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থতার একপর্যায়ে তিনি কানাঘুষা শুনে আরো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি সেবাযত্নের জন্যে মায়ের কাছে যেতে চাইলে নবীজী তাকে অনুমতি দিলেন। সেখানে পুরো রটনা তার কানে এলো। মা আয়েশা এতে এতটাই শোকাহত হলেন যে, একরাত দুই দিন তিনি বিরামহীন কান্নায় ডুবে থাকলেন। কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা এমন হলো যে, তার মনে হতে লাগল যে তার কলিজা ফেটে বুক থেকে বেরিয়ে যাবে। নবীজী এ সম্পর্কে কোনো ওহীও পাচ্ছেন না। করণীয় সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট কিছু ভাবতে পারছেন না। এমনি এক সময়ে তিনি আবু বকরের বাড়িতে হাজির হলেন।

বাবা ও মায়ের সামনেই আয়েশাকে বললেন, তুমি যদি নিরাপরাধ হও, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে মুক্ত করবেন। অন্যথায় আল্লাহর কাছে তোমাকে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে। আয়েশা কান্না থামিয়ে বাবা-মাকে তার পক্ষে বলতে বললেন। বাবা-মা চুপ করে থাকলেন। আয়েশা এবার নিজেই উদ্যোগী হয়ে বললেন, ‘আমি যদি বলি যে, আমি নিরপরাধ এবং আল্লাহ জানেন যে আমি অবশ্যই নিরপরাধ, তাহলে আপনি বিশ্বাস করবেন না। আর আমি যদি এমন কিছু স্বীকার করি, যে ব্যাপারে আল্লাহ জানেন যে আমি নিরপরাধ, তাহলে আপনি তা বিশ্বাস করবেন।

তাই আমার ও আপনার মধ্যে ইউসুফ নবীর বাবার কথা ছাড়া আর কিছুই নেই। এই বলে তিনি কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করলেন- ‘অবশ্য এখন আমার পক্ষে ধৈর্যধারণ করাই শ্রেয়। আর তোমরা যা বলছ, সে ব্যাপারে আমি শুধু আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি।’ (সূরা ইউসুফ : ১৮)

একথা বলার পর মা আয়েশা বিশ্রাম নেয়ার জন্যে শুয়ে পড়লেন। এর কিছুক্ষণ পরই নবীজীর ওপর ওহী নাজিল হলো: ‘যারা চরিত্রহীনতার মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে, তারা তো তোমাদেরই একটি দল। (কিন্তু এই অপবাদে যাদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে) তারা যেন নিজেদের জন্যে বিষয়টিকে ক্ষতিকর মনে না করে। বরং এটা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। (অপবাদ রটনাকারী) প্রত্যেককেই এ পাপের জন্যে জবাবদিহি করতে হবে। এদের মধ্যে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তার জন্যে অপেক্ষা করছে কঠিন আজাব। (আফসোস!) এ অপবাদ শোনার পর বিশ্বাসী নর-নারীরা কেন নিজেদের ব্যাপারে ভালো ধারণা পোষণ করে নি? কেন তারা বলতে পারল না যে, ‘এ-তো নিছক মিথ্যাচার!’ কেন তারা এ ঘটনার চার জন সাক্ষী হাজির করে নি? সাক্ষী হাজির না করার কারণে আল্লাহর বিধানে তারা মিথ্যাবাদী। তোমাদের ওপর আল্লাহর করুণা ও দয়া না থাকলে এ পাপের জন্যে দুনিয়া ও আখেরাতে কঠিন আজাব তোমাদের গ্রাস করত। তোমরা কানাঘুষা করে মুখে মুখে এসব কথা বলে বেড়াচ্ছিলে, যে-বিষয়ে তোমরা কিছুই জানো না। তোমরা বিষয়টিকে খুব সাধারণভাবে নিয়েছিলে কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে এ ছিল গুরুতর অন্যায়। (আফসোস!) কথাগুলো শোনামাত্র তোমরা কেন বললে না, ‘এ বিষয়ে কানাঘুষা করা আমাদের উচিত নয়। আল্লাহ পবিত্র, মহান। এ-তো মিথ্যা অপবাদ!’

আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, তোমরা যদি বিশ্বাসী হও, তবে ভবিষ্যতে কখনো এ ধরনের পাপ করবে না। আল্লাহ তাঁর নির্দেশনা তোমাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে বলছেন (যাতে করে তোমরা তা সঠিকভাবে অনুসরণ করতে পারো)। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা বিশ্বাসীদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়াতে চায়, তাদের জন্যে দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে কঠিন শাস্তি। আসল সত্য আল্লাহ জানেন, যা তোমরা জানো না। তোমাদের ওপর আল্লাহর করুণা ও রহমত না থাকলে তোমরা কেউই রেহাই পেতে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরমদয়ালু, বড়ই মেহেরবান। (সূরা নূর : ১১-২০)

এই আয়াত দ্বারা শুধু মা আয়েশার সততাই প্রমাণিত হয় নি; বরং এ ধরনের মিথ্যা রটনায় অংশ না নেয়ার এবং এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিশ্বাসীদের করণীয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা দেয়া হলো। এই আয়াত শুনে আয়েশা যারপরনাই আনন্দিত হলেন এবং নবীগৃহে প্রত্যাবর্তন করে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠলেন।

ব্যভিচার ও ব্যভিচারের অপবাদ দেয়াকে এসময় কোরআনে কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করা হয়। ‘প্রত্যেক ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে (ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে) একশত বেত মারবে। আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী হয়ে থাকলে এ বিধান কার্যকর করতে গিয়ে আবেগ বা দয়া যেন তোমাদের প্রভাবিত না করে। আর ওদের শাস্তি দেয়ার সময় যেন বিশ্বাসীদের একটি দল উপস্থিত থাকে।’ (সূরা নূর : ২)

‘কোনো পূতচরিত্রা নারীর বিরুদ্ধে কেউ (ব্যভিচারের) অপবাদ দিয়ে যদি চার জন সাক্ষী উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে অপবাদ রটনাকারীকে শাস্তি হিসেবে ৮০ বেত মারবে। আর কোনোদিন তার সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না। এরা সত্যত্যাগী। তবে এরপর এরা যদি তওবা করে নিজেদের সংশোধন করে নেয়, তবে আল্লাহ তো অতীব ক্ষমাশীল, পরমদয়ালু।’ (সূরা নূর : ৪-৫)

বিশ্বাসীদের মধ্যে এই অপপ্রচারে মূল অংশগ্রহণকারী হাসান ইবনে সাবিত, মিসতাহ ইবনে আসাসা এবং হামজা বিনতে জাহ্শ প্রত্যেককে ৮০ দোররা অর্থাৎ ৮০ বার বেত্রাঘাত করে শাস্তি দেয়া হয়। আসলে কোনো নারীকে চরিত্র হননকারী মিথ্যা অপবাদ দেয়া তাকে ধর্ষণ করার মতোই কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হাসান ইবনে সাবিত তার এই গুরুতর অন্যায়ের শাস্তি পাওয়ার পর গভীরভাবে অনুতপ্ত হলেন। অনুশোচনা করে তিনি আবার নবীজীর আস্থাভাজন হয়ে উঠলেন। একবছর পর নবীজী মিসরের আর্চ বিশপ প্রেরিত উপঢৌকন শিরিনের সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি