অশনি সংকেত
প্রকাশিত : ০১:৩৪, ২৬ এপ্রিল ২০২০
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।
প্রথম থেকেই কথাটি আমি বলেছিলাম। কারণ প্রথম থেকেই আশঙ্কাটি আমার মনে দুলছিল। করোনা সঙ্কটের আর্থ-সামাজিকপ্রভাবের কথা বলতে গিয়ে নানা কথা উঠে আসছিলো- কর্মসংস্থানের ঘাটতি, আয়ের অপ্রতুলতা, সামাজিক সেবার অনুপস্থিতি ইত্যাদি। তবে যে সমস্যা সবচেয়ে প্রকট বলে আবির্ভূত হয়েছে, তা হচ্ছে খাদ্য সঙ্কট- বিশেষত: দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্যে। তাদের কাজ নেই, আয় নেই, সঞ্চয় নেই- তাঁরা দিন এনে দিন খান। ফলে কাজ আয় ও সঞ্চয়ের অভাবে তাঁদের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এবং এটি আবির্ভূত হচ্ছে একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে।
বাংলাদশের ক্ষেত্রে এ সঙ্কটের কথা অনেকেই বলছেন। এখনই ব্যবস্থা না নিলে এ সমস্যা গুরুতর রূপ নেবে বলে অনেকেই সাবধান বাণী উচ্চারণ করছেন। ইতিমধ্যেই বলা হচ্ছে যে, দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ বা ৫ কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। আগামীতে প্রায় ১ কোটি পরিবার খাদ্য সঙ্কটের শিকার হবে। এ পরিবারগুলোর জন্য ১ মাসের খাদ্য সুরক্ষায় ৬ হাজার কোটি লাগবে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে। আগামী ৬ মাসের জন্য লাগবে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতির প্রণোদনার জন্য মোট ৭২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আমি মনে করি, এই মুহূর্তে ঐ অর্থের অংশ দিয়ে বর্তমানের খাদ্যনিরাপত্তাহীন ৫ কোটি মানুষের অন্তত: আগামী ৬ মাসের খাদ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হোক।
আমার ভয় হয় যে, সারা বিশ্বের খাদ্য সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। তবে আগামী বছর সারা বিশ্বে একটি দুর্ভিক্ষের জন্ম দিতে পারে। ইতিমধ্যেই বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছে যে করোনা সঙ্কটের ফলে আগামী বছর পৃথিবীর ২৫ কোটি মানুষ মনণ্বতরের মুখোমুখি হতে পারেন। কেউ কেউ এই সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষকে বাইবেলীয় মাত্রার হতে পারে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
এর আগে দুর্ভিক্ষ হয়েছে সহনীয়ভাবে, এলাকা-ভিত্তিক দেশজভাবে। তখন বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে ত্রাণ-সামগ্রী এসেছে, অর্থ-সাহায্য এসেছে, স্বেচ্ছাসেবকেরা এসেছেন। কিন্তু করোনা পরবর্তীকালে খাদ্যসঙ্কট হবে বৈশ্বিক- সবাই এতে আক্রান্ত হবেন। অতএব, কোন দেশই অন্য দেশের ওপরে সাহায্যের জন্য নির্ভরশীল হতে পারবে না। করোনার ভয়ঙ্কর প্রকোপের জন্য হয়ত উন্নত বিশ্বই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বর্তমান সময়ে খাদ্য ত্রাণের জন্যে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে ১০,০০০ অপেক্ষমান গাড়ীর বহর দেখলেই সঙ্কটের একটি আংশিক চিত্র পাওয়া যায়।
এই বৈশ্বিক খাদ্য সঙ্কট বা দুর্ভিক্ষের মোকাবেলায় পাঁচটি মাত্রিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেবে -খাদ্য উৎপাদন, খাদ্যের বণ্টন, খাদ্য ভোগে কৃচ্ছতা সাধন, খাদ্য ত্রাণ, যুথবদ্ধভাবে উত্তরণের প্রচেষ্টা।
প্রথমত: সাধারণ সময়ে পৃথিবীতে খাদ্যের মোট উৎপাদন পৃথিবীর সব মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। কিন্তু বর্তমান সময়টি সাধারণ নয়। করোনা সঙ্কটের ফলে বিশ্বের কৃষি ব্যবস্থায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে, ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। এর উত্তরণের জন্যে বৈশ্বিকভাবে কৃষকদের প্রণোদনা দিতে হবে কৃষি ঋণ, কৃষি উপকরণ ও কৃষি সরঞ্জাম প্রদানের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে সহায়তা প্রয়োজন হবে বাজারজাতকরণ, মূল্যস্থিতি, আন্তর্জাতিক খাদ্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও।
দ্বিতীয়ত: সাধারণ সময়ে খাদ্য লভ্যতার ক্ষেত্রে উৎপাদন নয়, বন্টনই মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অসম বন্টনের কারণেই মোট উৎপাদন পর্যাপ্ত হলেও সবার কাছে খাদ্য লভ্য হয় না। দরিদ্র মানুষেরা বুভুক্ষুই থেকে যায়। করোনা পরবর্তী পর্যায়ে এ সঙ্কটটি আরও ঘণীভূত হবে। পৃথিবীতে খাদ্যের অভাবে কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি, হয়েছে সুষম বন্টনের অভাবে। ১৯৪৩ এর মণন্বতরের সময়ে মানুষ যখন বুভুক্ষায় মারা যাচ্ছে তখনও সরকারী খাদ্য গুদামে খাদ্য মজুত ছিল।
করোনা সঙ্কটকে পুঁজি করে দেশজ ও আন্তর্জাতিক কায়েমী স্বার্থবাদীরা খাদ্য সামগ্রী মজুত করে মুনাফা সর্বোচ্চকরণে প্রয়াসী হবে। ফলে কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কট তৈরি হবে এবং আবির্ভূত হবে মানব-সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ। সুতরাং প্রকৃতিসৃষ্ট খাদ্য ঘাটতির সঙ্গে যুক্ত হবে মানুষের সৃষ্টি সঙ্কট। বলার অপেক্ষা রাখে না এ জাতীয় দুর্ভিক্ষে প্রধান বলি হবেন দরিদ্র জনগোষ্ঠী। বৈশ্বিক পর্যায়ে জাতিসংঘ সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে দেশজ আলোচনা এখনই শুরু হওয়া উচিত কী করে আন্তর্জাতিক বন্টন ব্যবস্থাকে সংহত করা যায়। সেই সঙ্গে দেশজ পর্যায়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থাও প্রণীত হওয়া দরকার।
তৃতীয়ত: খাদ্য গ্রহণে আমাদের সবার কৃচ্ছতা সাধন আমাদের অস্তিত্ব রেখার জন্য একান্ত প্রয়োজন। খাদ্য অপচয় নয়, লোক দেখানো ভোগ নয় - এগুলোই আমাদের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত। এখন রমজান মাস চলছে। ইফতারির সময়ে আমরা অমিতব্যয়ী যেন না হই। রমজানে আসল মাত্রিকতা যদি হয় সংযম, তাহলে খাদ্য-সংযম থেকে আমরা যেন বিচ্যুত না হই।’রমজান শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পোড়ানো’, এই রমজানে আমরা যেন আমার খাদ্যলিপ্সা পোড়াতে পারি।
চতুর্থত: দরিদ্র জনগণের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যে খাদ্য ত্রাণ বজায় রাখতে হবে। বিশ্বের সব দেশেই এটা অগ্রাধিকার ভিত্তি করতেহবে। এ জন্যে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীকে জোরদার করা প্রয়োজন। ভারতে খাদ্য ত্রাণ ব্যবস্থার মাধ্যমে ৮০ কোটি মানুষের খাদ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা হচ্ছে। এর অধীনে প্রতিটি মানষকে প্রতি মাসে ৫ কেজি গম ও ১ কেজি ডাল দেয়া হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য সুরক্ষার জন্যে খাদ্য ত্রাণের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তার আশু বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে বাংলাদেশর বহু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এ কাজটি করছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগও এখানে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করছে।
পঞ্চমত: ব্যাপ্তিতে এ গভীরতায় বর্তমান করোনা সঙ্কট অভূতপূর্ব। আমরা সবাই একই নৌকার যাত্রী। এ অবস্থায় আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের উত্তরণের পথ হতে পারে না। যুথবদ্ধতাই আমাদের পরিত্রাণের একমাত্র উপায় - এই সহজ সত্যটি আমরা যেন ভুলে না যাই। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটাও মোক্ষম কথা। মনে রাখা প্রয়োজন, ‘নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না’।
শেষের কথা বলি, খাদ্য সঙ্কটের মতো একটি অশনি সংকেত আমাদের দ্বারপ্রান্তে। এখনই না ঠেকালে কোন একদিন এই সঙ্কটই হয়তো দুর্ভিক্ষের বেশে বিশ্ববাসীর দ্বারে কড়া নাড়বে। আজ আমাদের সচেতনতার প্রয়োজন পরিকল্পনার প্রয়োজন এবং আগাম ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন। আমরা যেন বিস্মৃত না হই যে, ‘অন্ধ হলেই, প্রলয় বন্ধ থাকবে না’।
এমবি//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।