আজ ঝিনাইগাতী মুক্ত দিবস
প্রকাশিত : ০৯:৫৩, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯
আজ ৪ ডিসেম্বর শেরপুরের ঝিনাইগাতী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইগাতী অঞ্চলকে শত্রু মুক্ত করে।
পাক-হানাদার বাহিনী ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালো রাতে যখন ঢাকার বুকে হত্যাযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই রাতেই ৩টা ৪৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণার টেলিগ্রাম ম্যাসেজ ঝিনাইগাতী ভি এইচ এফ ওয়্যারলেস অফিসে এসে পৌঁছে। ম্যাসেজ পেয়েই ওয়্যারলেস মাস্টার জামান সাহেব তার অফিসের পিয়ন পাঠিয়ে শেষ রাতের দিকে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের বাসায় সংবাদ দেন।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার সংবাদ পেয়ে পরদিন ভোরেই অর্থাৎ ২৬ মার্চ সকালে আওয়ামী লীগ নেতা ডা. সৈয়দ হোসেন, আব্দুল কাফি মিয়া, সেকান্দর আলী, ফকির আব্দুল মান্নান মাষ্টার সহ অনেকেই ওয়্যারলেস অফিসে এসে পৌঁছান। ইংরেজিতে লেখা টেলিগ্রাম ম্যাসেজটি পেয়েই নেতৃবৃন্দ তৎক্ষনাৎ তা শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের কাছে প্রেরণ করেন।
২৬ মার্চ সকাল থেকেই বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো ঢাকার সর্বশেষ সংবাদ কি তা জানার জন্যে শেরপুর শহরে মানুষ সমবেত হতে থাকে। ঝিনাইগাতী ওয়্যারলেসে পাঠানো বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ হাতে পেয়েই তা বাংলায় অনুবাদ করে শেরপুর নিউ মার্কেট মোড়ে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে পাঠ করে শুনানো হয়।
বঙ্গবন্ধুর পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণা শ্রবণ করে সমবেত জনতা মুহুর্মুহু শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে শেরপুরের আকাশ বাতাস। ২৭ মার্চ সকালে শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ এডভোকেট আব্দুল হালিম এমপি, মুহসিন আলী মাস্টার ও ছাত্র নেতা আমজাদ আলী ঝিনাইগাতী এসে পৌঁছান। ঝিনাইগাতীর নেতৃবৃন্দ তাদের অভ্যর্থনা জানান। ছাত্রনেতা ফকির আব্দুল মান্নানকে সঙ্গে নিয়ে তারা নকশি ইপিআর ক্যাম্পে যান।
নকশি ক্যাম্পের সুবেদার আব্দুল হাকিম নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে বসেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। দেশকে শত্রু মুক্ত করাসহ পাক হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শুরু হলো প্রতিরোধ সংগ্রাম। যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে রাংটিয়া পাতার ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। ট্রেনিং শেষে এসব স্বেচ্ছাসেবক সহ মুজিব বাহিনী ও ইপিআর সেনাদের নিয়ে সুবেদার হাকিম মধুপুরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরে তা পিছু হটে পুরাতন ব্র্হ্মপুত্র নদের চরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
২৬ এপ্রিল সুবেদার হাকিম এর খোলা জীপ এসে দাঁড়ায় ঝিনাইগাতীর ঐতিহাসিক আমতলায়। সুবেদার হাকিম জনতাকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে অনুরোধ জানান। ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ঝিনাইগাতী শত্রু মুক্ত ছিল। ২৭ এপ্রিল পাকবাহিনী বহর নিয়ে গোলা বর্ষণ করতে করতে আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ডা. সৈয়দ হোসেনের হলদীগ্রামের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পরে তারা হলদীগ্রাম থেকে ঝিনাইগাতী বাজারে ঢুকেই আওয়ামী লীগ অফিসে আগুন ধরিয়ে পুড়ে দেয়। গাড়ি বহর নিয়ে রাংটিয়া পাহাড় পর্যন্ত গিয়ে আবার পিছনে ফিরে এসে ওইদিন বিকালেই কোয়ারীরোডে পাকবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। পরে ঝিনাইগাতীর এক মাইল দক্ষিণে আহম্মদনগর হাই স্কুলে তাদের সেক্টর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করে। যা মুক্তিযোদ্ধাদের ১১নং সেক্টরের বিপরীতে পাকবাহিনীর ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তরে একমাত্র সেক্টর হেড কোয়ার্টার। যার দায়িত্বে ছিলেন মেজর রিয়াজ।
এছাড়া পাকবাহিনী শালচূড়া, নকশি, হলদীগ্রাম, তাওয়াকোচা, মোল্লাপাড়ায় ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৬ বৈশাখ জগৎপুর গ্রামে হানা দিয়ে গ্রামটি পুড়িয়ে দেয় এবং পাকবাহিনী ৪১ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। ৫ জুলাই কাটাখালি ব্রিজ ধ্বংস করে মুক্তিযোদ্ধারা রাংগামাটি গ্রামে আশ্রয় নেয়। দালালদের খবরে পাকবাহিনী রাংগামাটি গ্রামে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। শুধু রাংগামাটি বিলের দিক খোলা ছিল। সম্মুখ যুদ্ধে কমান্ডার নাজমুল আহসান শহীদ হন। তার লাশ আনতে গিয়ে আলী হুসেন ও মোফাজ্জল শহীদ হন। পরদিন রাংগামাটি গ্রামে হানা দিয়ে পাকবাহিনী ৯ জন গ্রামবাসীকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
২৩ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা তাওয়াকুচা ক্যাম্প দখল করে এবং মুক্ত তাওয়াকুচায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। তাওয়াকুচা যুদ্ধে ৪ জন পাক সেনা ও ৭ জন রাজাকার নিহত হলে পাকবাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে আসে। ৩ আগস্ট নকশি ক্যাম্প আক্রমন করে মুক্তিযোদ্ধারা। আগের দিন ২ আগস্ট বিকালে মেজর জিয়া নকশি ক্যাম্প আক্রমনের জন্যে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিয়ারের অবস্থানগুলো দেখেন। এদিনের যুদ্ধে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও নিখোঁজ হন। যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩৫ জন সেনা নিহত হয়।
২৭ নভেম্বর কমান্ডার জাফর ইকবালের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইগাতী বাজারের রাজাকার ক্যাম্প দখল করে ৮টি রাইফেলসহ ৮ জন রাজাকারকে ধরে নিয়ে যায়। ২৮ নভেম্বর পাকবাহিনী ঝিনাইগাতী হানা দিয়ে ৮ জনকে আহম্মদ নগর ক্যাম্পের বধ্যভূমিতে ধরে নিয়ে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে তাদের এক গর্তে মাটি চাপা দিয়ে পুতে রাখে।
৩ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক দেড়টায় শালচূড়া ক্যাম্পের পাকবাহিনী কামালপুর দুর্গের পতনের আগাম সংবাদ পেয়ে পিছু হটে এবং আহম্মদ নগর হেড কোয়ার্টারের সেনাদের সঙ্গে নিয়ে রাতেই মোল্লাপাড়া ক্যাম্প গুটিয়ে শেরপুরে আশ্রয় নেয়। এভাবে রাতের আঁধারে বিনা যুদ্ধে ঝিনাইগাতী শত্রু মুক্ত হয়। ৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত ঝিনাইগাতীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ায়। তবে স্বাধীনতার ৪৮ বছরে শহীদদের স্মৃতি চিহ্নগুলো (গণকবর) সংরক্ষণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সুরুজ্জামান আকন্দ বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার এত দিন পর স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচারের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এ সরকারের আমলে এ উপজেলার ঘাগড়া কোনাপাড়া গ্রামের স্মৃতিস্তম্ভটি অযত্ন ও অবহেলায় থাকবে, এটি মেনে নেয়া যায় না। আজ পর্যন্ত এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকায় এখানে অবাধে বিচরণ করে গরু-ছাগল। শুকানো হয় গরুর গোবর। এটি জাতির জন্য খুবই লজ্জা ও দুঃখজনক বিষয়।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ভবিষৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করতে হলে এসব বধ্যভূমি (গণকবর) সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
হাতিবান্দা ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন দোলা বলেন, প্রশাসনের কাছে লিখিত ও মৌখিকভাবে আবেদন করেও ঘাগড়া কোনাপাড়া গ্রামে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটির চার-পাশে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের জন্য কোনও বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। অথচ জাতির স্বার্থেই ওই স্থান সংরক্ষণ করা জরুরি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবেল মাহমুদ বলেন, এ উপজেলার গণকবরগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। আহমদ নগর গ্রামের গণকবরে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও ঘাগড়া কোনাপাড়া গ্রামে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং এর উন্নয়ন কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে আবেদন করা হয়েছে।
একে//