অগ্নিঝরা মার্চ
‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’
প্রকাশিত : ০৮:৪৭, ২৬ মার্চ ২০১৯
টানা ২৪ দিন ধরে চলা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন আর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে গণহত্যার দিকে এগিয়ে যায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ২৫ মার্চ জিরো আওয়ারে গণহত্যা শুরুর আধা ঘণ্টার মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেন- ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন!’ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী রাত ১২টায় পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকার চারটি স্থানকে টার্গেট করে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, তৎকালীন ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর বাসভবন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গণহত্যা শুরু করে অখণ্ড পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে ক্ষীণস্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হলো পূর্বেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।’
বাংলার মানুষের স্বাধিকারের দাবিতে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা-বিবৃতির বিপরীতে ভুট্টো লাগাতার এই দাবি করতে থাকেন যে, পাকিস্তানের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে তার দল অপরিহার্য। তাকে বা তার দল পিপিপিকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যৎ সরকার গঠন বা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের চেষ্টা করা হলে তা শুধু সংকট বাড়াবে। এসব কথাবার্তার সঙ্গে সঙ্গে ভুট্টো সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করে তোলেন। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু এর চেয়েও দ্রুতগতিতে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করেন। এরই অংশ হিসেবে ১৯৭১-এর জানুয়ারির ৩ তারিখে ঐতিহাসিক রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করান স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, `৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ-আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাঁকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি, আমাকেও।` ১৯৭১-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে যথাক্রমে বঙ্গবন্ধু ও মনসুর আলী নেতা নির্বাচিত হন। জাতীয় পরিষদের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এএইচএম কামারুজ্জামান সচিব নির্বাচিত হন। এ ছাড়াও সর্বজনাব ইউসুফ আলী, আব্দুল মান্নান ও আমীর-উল ইসলাম যথাক্রমে চিফ হুইপ ও অপর দু`জন হুইপ নির্বাচিত হন। এর পর আসে মহান ২১ ফেব্রুয়ারি। `৭১-এর শহীদ দিবস ছিল সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এদিনটিতে মধ্যরাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মশালের আগুনে উদ্দীপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, `এই বাংলার স্বাধিকার- বাংলার ন্যায্য দাবিকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু বাংলার সাত কোটি মানুষ আর বঞ্চিত হতে রাজি নয়। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন হলে আরও রক্ত দেব। আর শহীদ নয়, এবার গাজী হয়ে ঘরে ফিরব। বাংলার ঘরে ঘরে আজ দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে হবে আমাদের সংগ্রাম। মানুষ জন্ম নেয় মৃত্যুর জন্য; আমি আপনাদের কাছে বলছি- এই বাংলার মানুষ রক্ত দিয়ে আমাকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছে। আমিও আপনাদের জন্য নিজের রক্ত দিতে দ্বিধা করব না। বাংলার সম্পদ আর লুট হতে দেব না।` ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেন এবং পিন্ডিতে গভর্নর ও সামরিক প্রশাসকদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। এই বৈঠকে লারকানা ও রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করা হয়। সামরিক শাসকচক্রের সঙ্গে মিলে ভুট্টো যে ভূমিকায় লিপ্ত, তাতে এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কোনোভাবেই বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না।
উপরোক্ত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, `...গত সপ্তাহে জাতি যে ধরনের নাট্যাভিনয় প্রত্যক্ষ করেছে, তা বন্ধ হওয়া দরকার। জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালের উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। ...পাকিস্তানে যখনই জনসাধারণ গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণে উদ্যত হয়েছে, তখনই এই তামস শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই গণবিরোধী শক্তি ১৯৫৪ সনে পূর্ব বাংলার নির্বাচিত শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করে, ১৯৬৬ সনের আইন পরিষদ ভেঙে দেয়, ১৯৫৮ সনে দেশে সামরিক আইন জারি করে এবং তারপর প্রতিটি গণআন্দোলন ব্যর্থ করার জন্য হস্তক্ষেপ করে। এই ষড়যন্ত্রকারী শক্তি যে আবার আঘাত হানার জন্য তৈরি হচ্ছে, জাতীয় পরিষদের তারিখ ঘোষণার পর যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলো থেকেই এটা প্রতীয়মান হয়। জনাব জেডএ ভুট্টো ও পিপল্স পার্টি আকস্মিকভাবে এমন সব ভঙ্গিমা ও উক্তি করতে শুরু করেছে, যা জাতীয় পরিষদের স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি করে শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি বানচালের প্রবণতাই উদ্ঘাটন করে। এভাবে জনসাধারণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। ...বাংলাদেশের জাগ্রত জনতাকে, কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র ও জনগণকে বিজয় বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ...আমরা যে ক্ষমতাকে স্বীকার করি, তা হচ্ছে জনগণের ক্ষমতা। জনগণ সকল স্বৈরাচারীকেই নতি স্বীকারে বাধ্য করেছে। কারণ স্বৈরাচারীর ক্ষমতার দম্ভ জাগ্রত জনগণের সংকল্পবদ্ধ আঘাতের কাছে টিকে থাকতে পারে নাই। ...আমরা আজ প্রয়োজন হলে আমাদের জীবন বিসর্জন করারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের একটি কলোনিতে বাস করতে না হয়। যাতে তারা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সম্মানের সাথে মুক্ত জীবনযাপন করতে পারে, সে প্রচেষ্টাই আমরা চালাব।`
এই দীর্ঘ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু ষড়যন্ত্রকারীদের নাটুকেপনা বন্ধ করা এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের যাতে একটি কলোনিতে তথা উপনিবেশে বসবাস করতে না হয়, তার অংশ হিসেবে স্বাধীন দেশের কথা বলেছেন। এর পর থেকে পরিস্থিতি ক্রমেই আরও রক্তঝরা সংগ্রামের দিকেই এগোয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি করাচির প্রেসিডেন্ট হাউসে পুনরায় ভুট্টো-ইয়াহিয়া শলাপরামর্শ শুরু হয়। ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতির সংবর্ধনা সভায় প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের আহ্বান জানান। একই দিনে লাহোরে এক জনসভায় ভাষণদানকালে ভুট্টো হুমকি দেন, `তার দলের কোনো সদস্য যদি পরিষদ অধিবেশনে যোগদান করে. তাহলে দলের সদস্যরা তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।` তিনি আরও বলেন, `তার দল খাইবার থেকে করাচি পর্যন্ত সবকিছু অচল করে দেবে।` এ ছাড়াও জাতীয় পরিষদের পশ্চিম পাকিস্তানি যেসব সদস্য অধিবেশনে যোগদানের জন্য ইতিমধ্যে ঢাকা গিয়েছেন তারা ফিরে গেলেই তিনি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দেন। ভুট্টোর এসব উত্তেজক, হঠকারী বক্তৃতা-বিবৃতির একটিই উদ্দেশ্য ছিল। আর তা হচ্ছে, যে কোনো মূল্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা। ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা অনুযায়ী বাংলার মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য অবশেষে `৭১-এর মার্চের ১ তারিখে দুপুর ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদ স্থগিত ঘোষণার মধ্য দিয়ে ভুট্টো এবং জেনারেলদের মধ্যকার ঐকমত্য জনসাধারণে প্রকাশিত হলো। এ রকম একটি ষড়যন্ত্র হতে পারে- এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু পূর্বেই আমাদের ধারণা দিয়েছিলেন এবং তার অবস্থান অত্যন্ত পরিস্কার করে জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এহেন বক্তব্যে তাৎক্ষণিক ক্ষোভ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরী। এদিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়ন কাজ চলছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয়ে স্লোগানে স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, `অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারা দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। আমি মর্মাহত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রাম করেই মুক্তি আনব। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন।`
বিকেল ৩টায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পল্টন ময়দানের স্বতঃস্ম্ফূর্ত জনসভায় যোগদান করি। পল্টন ময়দান যেন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে বক্তৃতায় বলি, `আর ৬ দফা ও ১১ দফা নয়। এবার বাংলার মানুষ ১ দফার সংগ্রাম শুরু করবে। আর এই ১ দফা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আজ আমরাও শপথ নিলাম- বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।` প্রতিবাদ সভায় আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশমতো আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাই। আজকাল অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, ইতিহাস বিকৃতির ধারায় অনেকেই মননের দীনতা ও নীচতা প্রকাশ করেন বিভিন্ন মিডিয়ায়। কেউ পতাকা তুলেছেন, কেউবা আবার ঘোষণা দিয়েছেন ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ না দিলে তো স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদই গঠিত হতো না। পতাকা তোলার প্রশ্ন তো অবান্তর। আর ঘোষণা তো এক মাস আগে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত এমএনএ এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেবও দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, `পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা যদি ৬ দফা ও ১১ দফাকে পাশ কাটাতে চেষ্টা করেন, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দেওয়া হবে।` স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা তখন অনেকেই দিয়েছেন। কিন্তু সমগ্র জাতিসহ গোটা বিশ্ব তাকিয়ে ছিল বঙ্গবন্ধু মুজিবের দিকে। কেননা, তিনি ছিলেন জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। `৭০-এর নির্বাচন না হলে, নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে কিছুই হতো না, কিছুই সম্ভব ছিল না। বঙ্গবন্ধু মুজিব নির্বাচনে অংশগ্রহণের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, বাংলার মানুষ ৬ দফা ১১ দফার পক্ষে। নির্যাতিত বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর আস্থা ছিল গগনচুম্বী। আর তাই তিনি জনগণের কাছে আহ্বান রেখেছিলেন এ নির্বাচনকে রেফারেন্ডামে পরিণত করতে।
সেদিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্র নেতাদের ডেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। ২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বতঃস্ম্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় এবং তার নির্দেশে কলাভবনে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় স্বাধীন বাংলার মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলিত হয়। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। এর পর আসে বাঙালির ইতিহাসের পরম আকাঙ্ক্ষিত দিন- ৭ মার্চ। সেদিন ছিল রোববার। বাংলাদেশের সার্বিক মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে দুর্গম প্রস্তর পথের প্রান্তে অতুলনীয় স্মৃতিফলক এই দিনটি। সংগ্রামী বাংলা সেদিন ছিল অগ্নিগর্ভ, দুর্বিনীত। কারও চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় প্রভুত্ব মেনে নেওয়ার জন্য, কারও কলোনি বা করদ রাজ্য হিসেবে থাকার জন্য বাংলার মানুষের জন্ম হয়নি। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিকামী মানুষের ঢল নেমেছিল সার্বিক জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে পথনির্দেশ লাভের জন্য। আমরা যারা সেদিনের সেই জনসভার সংগঠক ছিলাম; আমরা মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পদতলের পাশে বসে ময়দানে উপস্থিত পুরনারী, অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কচি-কিশোর, তরুণ-যুবক, কৃষক-শ্রমিক জনতার চোখে-মুখে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের যে অগ্নিশিখা দেখেছি তা আজও স্মৃতিপটে ভাস্বর। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির পর মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন, বাংলার বীর জনতা বজ্রনির্ঘোষে তুমুল করতালি ও স্লোগানের মধ্যে তাকে বীরোচিত অভিনন্দন জানায়। তার চোখে-মুখে তখন সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের সুযোগ্য সর্বাধিনায়কের দুর্লভ তেজোদৃপ্ত কাঠিন্য আর সংগ্রামী শপথের দীপ্তির মিথস্ট্ক্রিয়ায় জ্যোতির্ময় অভিব্যক্তি খেলা করতে থাকে।
বঙ্গবন্ধু যখন বক্তৃতা শুরু করলেন জনসমুদ্র যেন প্রশান্ত এক গাম্ভীর্য নিয়ে পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে গেল। এত কোলাহল, এত মুহুর্মুহু গর্জন নিমেষেই উধাও। আবার পরক্ষণে সেই জনতাই সংগ্রামী শপথ ঘোষণায় উচ্চকিত হয়েছে মহাপ্রলয়ের উত্তাল জলধির মতো, যেন জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার। সেদিনের সেই গণমহাসমুদ্রে আগত মানুষের বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও শ্রেণিগত অবস্থানের যতই ফারাক থাকুক; সে জনতার মধ্যে আশ্চর্য যে ঐকতান ছিল, তা হচ্ছে হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠের স্লোগান আর অন্তরের অন্তরতম কোণে লালিত জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা।
৭ মার্চের রেসকোর্স বাংলার মানুষকে শুনিয়েছে স্বাধীনতার অমোঘ মন্ত্র। সর্বাত্মক মুক্তিসংগ্রামের অগ্নিশপথে ভাস্বর, যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত সভাস্থলের প্রতিটি নিরস্ত্র মানুষ যেন সেদিন সশস্ত্র হয়ে ওঠে; তাদের চোখ-মুখ শত্রুর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আত্মত্যাগের অপার মহিমায় আলোকিত হয়। নেতার বক্তৃতার শেষাংশ `এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম`- বস্তুত এটাই ছিল বীর বাঙালির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
এসএ/