ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

আন্তরিকতার বন্ধন ফোবানায় : নার্গিস আহমেদ

প্রকাশিত : ২১:৩৯, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মানচিত্রে বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে যুক্তরাষ্ট্র। দিনরাতের ফারাকটাও বেশ। আমাদের দিন তো ওখানে রাত। আমাদের ঘুম আর তাদের নিরন্তর ব্যস্ততা। পার্থক্যের এই রকমফেরে মানিয়ে নেওয়া সময়ে কথা শুরু দীল আফরোজ আহমেদের সঙ্গে। সেখানকার বাঙালি কমিউনিটিতে নার্গিস আহমেদ নামে তিনি বেশি পরিচিত। আরেক যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালের নিউইয়র্ক শাখার সেক্রেটারি আনিসুল কবির জাসিরের মাধ্যমে নার্গিস আপার সঙ্গে ভার্চুয়াল পরিচয়। মানবপ্রেম থেকে মানবকল্যাণে প্রচেষ্টায় যারা নিয়োজিত- তাদের একজন জাসির ভাই। আর জাসির ভাইয়ের ভাষায়, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সবার কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ নার্গিস আপা। 

প্রাণোচ্ছল আর আন্তরিকতার স্বরে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর নার্গিস আহমেদের। ঠিক আসলে গণমাধ্যমের সিরিয়াস কোনো ইন্টারভিউ নয়। যেনো দীর্ঘ দিনের পরিচিত দুইজনের অনেক দিন পরের সাক্ষাৎ। যাঁদের কাজ, চিন্তা ও মূল্যবোধ মানুষের জীবনকে গভীরভাবে স্পর্শ করে যায়, তাঁরা শারীরিকভাবে গত হলেও মানুষের জীবন ও চেতনায় থেকে যান। তাই তো, জনহিতকর কাজ দিয়ে নশ্বর এই পৃথিবীতে অবিনশ্বর হওয়ার অবিরাম প্রচেষ্টা তার। কথা শুরু ফোবানা দিয়ে।

ফোবানা হচ্ছে উত্তর আমেরিকায় সব সংগঠনের আমব্রেলা সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা’। মার্কিন আইন অনুযায়ী ৫০১ সি(৩) এর আওতায় একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ইউএস পেটেন্ট অ্যান্ড ট্রেডমার্ক অফিস কর্তৃক রেজিস্টার্ড একটি সংগঠন। দেশের সঙ্গে উত্তর আমেরিকার বাংলাদেশিদের সেতুবন্ধন রচনার ভীত আরও শক্তিশালী করতে কাজ করছে ফোবানা। পাশাপাশি আমেরিকায় বসবাসরত সব বাংলাদেশিদের মধ্যে যোগাযোগস্থাপন, আন্তরিক সম্পর্ক দৃঢ় করে তোলার কাজও করে যাচ্ছে এই সংগঠন।

এই সংগঠনের নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন নার্গিস। আমেরিকায় যাওয়ার পর থেকেই তিনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক নানা সংগঠনের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। উত্তর আমেরিকাপ্রবাসী বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী সংগঠন ফোবানার ২০১৯ সালের সম্মেলনের কনভেনারও তিনি।

নার্গিস জানান, ২০১৯ সালের ৩৩তম ফোবানা সম্মেলনের আয়োজক নিউইয়র্কের জনপ্রিয় নাট্যদল ড্রামা সার্কেল। প্রতিবছরের মতো এবারও জোরেশোরে চলছে ২০১৯ সালের ফোবানা সম্মেলনের প্রস্তুতি। এবছর ৩৩তম ফোবানা সম্মেলন যুক্তরাষ্ট্রের লেবার ডে উইকেন্ডে ৩০ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে। এবার সম্মেলনের স্লোগান থাকবে ‘আওয়ার চিলড্রেন আওয়ার প্রাইড’। কি থাকছে এবারে নতুনত্ব- এবার ফোবানা সম্মেলন গতানুগতিক নয়, বরং দৃষ্টান্তস্থাপনকারী সম্মেলন উপহার দেওয়া হবে। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের ৮০টিরও বেশি সংগঠনের সদস্য ও কর্মকর্তারা এতে অংশ নেবেন।

আমেরিকায় বাংলাদেশিদের জীবন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে চাই নার্গিস আহমেদের কাছে। প্রতিবছর শিক্ষার্থী, গবেষক, চাকরি, ভ্রমণসহ নানা উদ্দেশ্যেই হাজারো বাংলাদেশিদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ। প্রথম যারা যান, নতুন পরিবেশ, অচেনা শহরে ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না অনেক কিছুই। তারা কি ধরণের বিড়ম্বনায় পড়েন?

নার্গিস আহমেদ বলছিলেন, পথ ঘাট না চেনা, সড়কে যান চলাচল, বাস, ট্যাক্সি বা ট্রেনে উঠার ক্ষেত্রেও খানিকটা ঝামেলা তৈরি হয়। কেন না, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ সুযোগ অথবা অভ্যাসের কারণে নিয়ম মেনে চলাচল করেন না। আবার, তথ্য ঘাটতির কারণেও অনেকে ভোগান্তিতে পড়তে পারেন। তাদের জন্য করণীয়- বলছিলেন তিনি, ‘বাংলাদেশ সংসদ’ নামের স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠন রয়েছে। বিভিন্ন বয়স, শ্রেণি, পেশার মানুষ, কারা নতুন আমেরিকায় আসছেন, জানা থাকলে বিমাবন্দরে অবতরণ থেকে শুরু করে প্রত্যাশিত ঠিকানায় স্থায়ী হওয়া পর্যন্ত সহযোগিতা মেলে তাদের কাছ থেকে। এমনকি, আমেরিকার বাজারে চাকরি উপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয় বাংলাদেশ সংসদের উদ্যোগে। যেখানে প্রচেষ্টা থাকে পরবর্তীতে কাঙ্খিত একটি চাকরি যোগানের।

নার্গিস আহমেদের হাত ধরেই যাত্রা শুরু করে ‘বাংলাদেশ সংসদ’ নামের সংগঠনটি। তিনি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে আসা নতুন বাংলাদেশিদের ইংরেজি, আমেরিকান কাস্টমস, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানসহ বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা দেয় এই সংগঠনটি। তাদের ব্যবস্থাপনায় শীতবস্ত্র সংগ্রহসহ মানবিক সাহায্যের জন্য তহবিলও সংগ্রহ করা হয়। বিতরণ করা হয় মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সবার মাঝেই।
বাংলাদেশে বসে ভাবি, আমেরিকার জীবনটা অনেক যান্ত্রিক। প্রতিজনের প্রতিক্ষণের ব্যস্ততা। নিজের বাইরে আর কিছু ভাবতে চান না আর অনেকেই- আমার কথা শেষ হয় না। নার্গিস বলেন, আসলে সবকিছু নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর। রুটি-রোজগারের পরও প্রত্যেকের স্বাভাবিক জীবন থাকে। আমরা সবাই সমাজেই বাস করি। পরিবারে যেমন আরও কজন সদস্য থাকেন, প্রতিবেশী থাকেন পাশের ফ্ল্যাটে। একই বিল্ডিংয়ের উপরে বা নিচে থাকে আরও কটা পরিবার। তেমনি সমাজেও অনেকেই থাকেন। পরিবারের সমস্যায় যেমন নিজে আক্রান্ত হই, তেমনি সমাজের আর কজনেরও বিপদেও আমাদের খারাপ লাগা উচিৎ, তাদের সমস্যার উত্তোরণে এগিয়ে যাওয়াই আত্মার তৃপ্তি। তাই প্রচেষ্টা থাকে সব সময় তাদের কল্যাণে কাজ করা। এমন ভাবনা থেকেই এখানকার মানবিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানা সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা।

‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে, আসে নাই কেহ অবনী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’ এমন ব্রত নিয়েই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শুরু নার্গিসের। ১৯৭৫ সালে যাত্রা শুরু করা ‘বাংলাদেশ সোসাইটি’র সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। আমেরিকায় বাংলাদেশি কমিউনিটির সদস্যদের নানাভাবে সহযোগিতা করে সংগঠনটি। যার সঙ্গে সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন প্রায় ১৮ হাজার সদস্য। সাংগঠনিক প্রজ্ঞা ও দারুণ জনপ্রিয়তা নিয়ে এখন পর্যন্ত তিনিই একমাত্র নারী সভাপতি হিসেবে এই সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। এর আগে তিনি কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ও সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্বপালন করেন। বিভিন্ন মেয়াদে তিনি ‘বাংলা স্কুলে’র সভাপতিরও দায়িত্বপালন করেন। আর, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ছেলেমেয়েদের ঐতিহ্যবাহী বাংলা গান, রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীত, নৃত্য, বাংলা লেখা ও পড়তে শেখার ব্যাপারে নানা উদ্যোগগ্রহণ করেন। আমরা অনেকেই দেশের বাইরে গিয়ে সে দেশের রীতিরীতি রপ্ত করার চেষ্টা করি। কিন্তু অস্তিত্বের আপন নীড় যেখানে, সেটা অস্বীকার করি কিভাবে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের সংস্কৃতি একজন মানুষকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে তৈরি করে, করে মানবিক। তাই তো বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ শেখানোর এই প্রত্যয়- নার্গিসের ভাবনা আর এমন উদ্যোগ- ভাবনার নতুন শেকড় তৈরি করে আমার মস্তিষ্কেও।

বাংলাদেশের নাটক খুব পছন্দ নার্গিসের। তাই তো বিদেশ বসেও চর্চা করেন প্রাচীন গীতি নাট্য কিংবা সেলিম আল দীনের যৈবতী কন্যার মন কিংবা সৈয়দ শামসুল হকের নূরুলদীনের সারাজীবন। পহেলা বৈশাখ উদযাপন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসসহ বাঙালি ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত সব উৎসব-পার্বন উদযাপনে বরাবরই উদ্যোগী সংগঠক তিনি। এসব আয়োজন হয়ে থাকে আমেরিকার বাংলাদেশি জনগণের মাঝে অতি পরিচিত সংগঠন ‘ড্রামা সার্কেল’ এর মাধ্যমে। মনেপ্রাণে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক নার্গিস আহমেদের হাত ধরেই যাত্রা শুরু করে এই সংগঠনটি। নিইউয়র্ক সিটির মেয়রের ফান্ডে অনুদানপ্রদানসহ শুমারি ২০০০ ও আমেরিকার ক্যান্সার সোসাইটিতেও রয়েছে তার উল্লেখযোগ্য অবদান।

সমাজ-সংস্কৃতি, মানবপ্রেম... অনেক কিছুর ভীড়ে কি বাদ যাবে রাজনীতি? মোটেও না। মৃদু হাসির সঙ্গে বের হয় পরবর্তী উত্তর। আমেরিকার স্থানীয় রাজনীতিতে স্বক্রিয় নার্গিস আহমেদ। তিনি এশিয়ান আমেরিকান ডেমোক্রেটিক অ্যাসোসিয়েশনও অব কুইনস’ এর কো- চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। নিইউয়র্কে ডেমোক্রেটিক পার্টির সাউথ এশিয়ান প্যাসিফিক ডিভিশনের সদস্য হিসেবেও কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। এই পদে তিনিই প্রথম নারী। গেল ১৪ বছর ধরে স্বক্রিয় সদস্য হিসেবে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন আজও। ২০১৪ সালে তিনি নিউইয়র্কের আল মামুর স্কুলের উপদেষ্টা পরিষদের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন।

দিনভর ব্যস্ত সময়ের ফাঁকে একটু অবসর পেলেই গান শুনেন, বই পড়েন। অতিথি আপ্যায়ন ও তাদের সঙ্গে জুটিয়ে গল্প করা তার অন্যতম আনন্দের শখ। আর নিয়মমাফিক সব ব্যস্ততা ছাপিয়ে বেড়িয়ে পড়েন ঘুরতে, দেশে বা বিদেশে। ১৯৮১ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। কাজ শুরু করেন ট্রাভেল এজেন্ট হিসেবে। উপস্থাপক হিসেবে পদচারণা ছিল স্থানীয় গণমাধ্যমে ‘রূপসী বাংলা’ অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশের বাইরে এটাই ছিল প্রথম বাংলা ভাষার কোনো টিভি প্রোগ্রাম, যা আমেরিকার বাঙালি কমিউনিটির পাশাপাশি বাংলাদেশেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ব্যক্তিজীবনে নার্গিস আহমেদ দুই সন্তানের জননী।

ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায় সব পরিচয় ব্যতিরেকে মানুষ হিসেবে তিনি সবাইকে সহযোগিতা করেন, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মানব উন্নয়নে কাজ করেন। যার ফলও পেয়েছেন হাতেনাতেই। এএফএল-সিআইও, এশিয়ান আমেরিকান ডেমোক্রেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব কুইনস, বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউইয়র্ক, বাংলাদেশি কনস্যুলেট জেনারেল অব নিউইয়র্কসহ নানান সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের কাছ থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক নানা পুরস্কার ও খেতাব। কনগ্রেসম্যান ইউভ ক্ল্যার্ক, সিটি কাউন্সিল মেম্বার জন লিয়্যু, ডেভিড ওয়েপ্রিন, হেলেন সিয়ার্স, সিনেটর সাবিনি, আডা ল স্মিথ, অ্যাসেম্বিয়ান জোস পেরাল্টাসহ প্রমুখ বিখ্যাতজনের কাছ থেকে পেয়েছেন সম্মাননাসূচক নানা উপাধি। অফিস অব দ্য সিটি কম্পট্রোলার উইলিয়াম সি থমসন ও স্কট এম স্ট্রিংগারের কাছ থেকে ২০০৭ আর ২০১৪ সালে পেয়েছেন বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার।
নার্গিস আহমেদের নেতৃত্বে এবারের ফোবানা সম্মেলন সফল হবে- এমনটাই আশাবাদ।

লেখক: বিজনেস রিপোর্টার, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।

email: imdad_ju@yahoo.com

এসএইচ/

 

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি