আমরা খাদ্য সচেতন হবো কবে?
প্রকাশিত : ২২:০৮, ৮ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৮:৪১, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭
পেশাগত কারণে আমি বিশ্বের ৭৯টি দেশে ঘুরে বেড়িয়েছি। পেশার তাগিদে বিভিন্ন দেশে গেলেও ভ্রমণের সময় নিবিড় চিন্তা চেতনা দিয়ে উপলব্ধি করেছি বিভিন্ন দেশের মানুষের জীবনধারা। সুদীর্ঘ প্রবাস জীবনে থেকে ভুলে যাইনি নিজ দেশ ও দেশের কৃষ্টি -কালচার। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে মানুষের খাদ্যাভাস পরিবর্তনের বিষয়টি। মানুষ এখন প্রকৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। সুস্বাদু খাবারের পরিবর্তে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের দিকে ঝুঁকছে মানুষ। ফাস্ট ফুডের মতো জাঙ্ক ফুড থেকে দূরে থাকছে মানুষ। নানা রোগব্যাধী ছাড়াও মুটিয়ে যাওয়ার কারণে শাক-সবজি ও ফলমূলের দিকে ঝুঁকছেন অষ্ট্রেলিয়ার মানুষ।
আমাদের দেশের শিশুরা স্কুল থেকে বেরিয়ে বাইরের জাঙ্ক ফুড যেমন চটপটি, ফুসকা, আচার, ঝালমুড়ি ইত্যাদি খাবারের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। অপরদিকে, অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবারের সন্তানরা ফাস্ট ফুডের দোকানে ভিড় করছে। পিজা, ম্যাকডোনালস, কেএফসি এসব দোকানে না খেলে যেন তাদের আভিজাত্যের ভাব প্রকাশিত হয় না। আর এই ধরণের খাবার এসেছে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে। অথচ সেই পশ্চিমা বিশ্বই এসব খাবার এড়িয়ে চলছে।
অষ্ট্রেলিয়ায় স্কুলের বাচ্চাদের খাদ্যাভাস নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিদিন ১০টা সবজির আইটেম রাখতে বলা হয়েছে। স্কুলের টিচাররা বাচ্চাদের খাবারের বক্স খুলে দেখেন নির্দেশনা অনুযায়ী খাবার আনা হয়েছে কিনা। খাবারের বক্সে টমেটো, গাজর, আপেল আছে কিনা দেখা হয়। কোনো সফট ডিংকস এলাউড না। সবজি আর ফল ছাড়া শুধুমাত্র সিম্পল ওয়াটার পারমিট রয়েছে।
বাচ্চারা দিনদিন ওবিস (স্থুল) হয়ে যাচ্ছে। এতে করে তাদের চিকিৎসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। হাসপাতালগুলোর উপর চাপ বাড়ছে। বাচ্চারা অকর্মণ্য হয়ে যাচ্ছে। দেখা গেছে, অল্প বয়সে চিকিৎসকের কাছে যেতে হচ্ছে। পেট বেড়ে যাচ্ছে, ডায়াবেটিস সমস্যা বেড়েই চলেছে। সরকারের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বাড়ছে। তারপরও আমাদের দেশে ক্রমেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ফাস্ট ফুড। কিন্ত যেই ইডরোপের দেশ থেকে এসব সংস্কৃতি আমাদের অঞ্চলে আসলো সেই ইউরোপেই এখন নিরাপদ খাবারের আন্দোলন করছে।
ইউরোপজুড়ে এখন নিরাপদ খাবারের আন্দোলন গড়ে উঠছে। স্বাস্থ্য সচেতন থাকতে অফিস- আদালতে জিম চালু করা হয়েছে। এখন অনেকেই চাকরি করার আগে দেখছে বেতনের সঙ্গে ফ্রি জিমের অফার আছে কি না? অনেকের বেতনের সঙ্গে ফ্রি জিমের ভাউচার দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সপ্তাহে ৫ দিন দুই ঘণ্টা করে জিমের জন্য সময় দেওয়া হচ্ছে অফিস থেকে। এক্সিকিউটিভরা পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে অফিস যাতায়াত করেন। অথচ আমাদের দেশের মানুষ এখনও এতটাই আরামপ্রিয় হয়ে গেছেন যে আয়ের অনেকাংশেই চলে যায় ডাক্তার আর হাসপাতালে। অথচ স্বাস্থ্য সচেতন থাকলে অনেক রোগব্যাধী তো বটেই, ভালো থাকা যায়, সুস্থ্য থাকা যায়।
নুসাতুন অস্ট্রেলিয়ার একটা রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী। সেই মহিলা প্রতিদিন ২৫কি.মি দূর থেকে ট্রেনে করে অফিস যাতায়াত করেন। রাস্তায় জনগণের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আসেন,মানুষের সমস্যাগুলো শোনেন।
অষ্ট্রেলিয়ায় জাঙ্ক ফুডের দাম এখন কমে গেছে। যেসব মুরগি খোলামেলা জায়গায় বেড়ে উঠে, সেসব মুরগির ডিমের দাম বেশি। যেটা ফার্মের মুরগির চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। অথচ বাংলাদেশে ঘটনাটা উল্টো। দেশে আমরা দিন দিন এতো কেমিকেল খাচ্ছি যে এন্টিবায়োটিকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। আমাদের দেশে সার দিয়ে বড় পেয়ারা উৎপাদন করা হচ্ছে, এর ফলে শরীরে নানান রাসায়নিক উপাদান ঢুকে পড়ছে।
অষ্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া আমাদের দেশের মতোই। শুধু ওখানে ঠান্ডার সময় আমাদের এখানে গরম, আর আমাদের ঠান্ডার সময় ওখানে গরম।
ওখানে এখন প্লেন কোম্পানিগুলো মোটা মানুষদের নিতে চায় না। আর নিলেও ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। ইউরোপে মোটা মানুষদের বাড়তি সমস্যা নিয়ে গবেষণা চলছে। কারণ, তাদের জায়গা বেশি লাগে, ফুয়েল বেশি বার্ণ হচ্ছে এসব নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু হয়েছে। সময় এসেছে আমাদের দেশেও এ বিষয়ে সচেতনতার।
অষ্ট্রেলিয়ায় ইতোমধ্যে ৩০০ থেকে ৪০০ ম্যাগডোনালস বন্ধ হয়ে গেছে। ২০ বছর আগেও দেখা গেছে, যে এলাকায় ম্যাগডোনালস নাই সেখানে ঘরবাড়ি হতো না। এখন বিভিন্ন এলাকায় ম্যাগডোনালসের প্রতিষ্ঠান খুলতে গেলে আশপাশের লোকদের চিঠি দিতে হয়। কাউন্সিলে পাশ হতে হয়, তারপর দোকান দিতে হয়। আমার এলাকাতে কমার্শিয়াল ভবন আছে সেখানে ম্যাগডোনালস এলাউড না। কারণ, এসব খাবার স্বাস্থ্যকর না। ফলে ম্যাগডোনালসের খাবারের দামও কমে গেছে। এ কারণে এ কোম্পানির শেয়ারের দামও কমে গেছে। এ প্রেক্ষাপটে ম্যাগডোনালস এখন ব্যবসার ধরণ পাল্টেছে। এর বিপরীতে অনুন্নত দেশগুলোতে কেএফসি ঢুকে পড়ছে। মানুষ সেগুলোতে হুমরি খেয়ে পড়ছে। পিৎজা যে কত খারাপ সেটা বলে বোজানো যাবে না। এর প্রতিক্রিয়া অনেক খারাপ।
সম্প্রতি এক ছোট ভাই স্টোক করেছে। বয়স ৩৫ হবে। তার এক সময় প্রিয় খাবার ছিলো চিস আর ফাস্ট ফুড। অনেকে বুঝতে পারছেন না এর প্রভাব কতটা খারাপ। চিস রক্তে জমাট বাঁধে, চর্বি সৃষ্টি করে ব্লকেজ করে। রক্ত স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে না।
অষ্ট্রেলিয়াতে ডাঃ এবং নার্সরা এটার সম্পর্কে ক্যাম্পেইন করে যে মোটা হওয়া যাবে না,স্থূল হওয়া যাবে না।এমনকি অফিস ২-৩ ঘন্টা ব্যায়ামের কারনে আপনাকে কাজ থেকে রিলিফ দেবে। এ ব্যাপারে সরকার খুব জোড় দিচ্ছে। এটা বাড়তি সুবিধা।
অষ্ট্রেলিয়ায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেশি। শিক্ষার্থীরা শর্ট টাইম কাজের মাধ্যমে টিকে থাকে। ফাস্ট ফুডে জব করে, ড্রাইভিং করে।
অষ্ট্রেলিয়ায় প্রচুর গরু আছে। একেকটার ১৫০০ কেজি পর্যন্ত মাংস হয়। গরুগুলো প্রচুর দুধ দেয়, অষ্ট্রেলিয়া থেকে প্রচুর গরু প্লেনে করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। এটা থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। বড় বড় তৃণভূমিতে গরুগুলো ছেড়ে দেয়া হয়।
ওখানকার আয়ের বড় অংশ হচ্ছে কৃষি। একেকটি খামার অনেক বড়। কৃষকরাই সেখানে ধনী। হাজার হাজার একর জায়গাজুড়ে প্রোজেক্ট। হেলিকপ্টারের মাধ্যমে সুপার ভাইস করা হয়। চাষিদের হেলিকপ্টারও আছে। এই হেলিকপ্টার দিয়ে ফড়িঙের মতো গরুগুলোকে দৌড়ানো হয়। কারণ, গরু যদি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে খায় তাহলে গরুর হজমে সমস্যা হতে পারে। তাই গরুগুলোকে দৌড়ানো হয়। অর্থাৎ গরুগুলো যেন ফার্মের মুরগির মতো না হয়।
প্রাকৃতিক খাবারের জন্য কৃষিতে ট্যাক্স কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। কৃষিতে সরকার উৎসাহিত করছে। সেখানে তৃণভোজী গরুর অনেক চাহিদা। প্রচুর পরিমানে আবাদ হয়। ৯০ শতাংশ আবাদ করা হয়। অনেক ফল- ফলাদি, সবজি উৎপাদন হচ্ছে। মেক্সিকো, নিকারাগুয়া ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে রফতানি করা হয়। দেশটা অনেক বড় আর লোক সংখ্যা খুবই কম। ওখানে ইন্ডিয়ান অনেক লোক প্রচুর কলা চাষ করে। এছাড়া আপেল কমলা অনেক হয় সেখানে।
আমাদের দেশে মায়েরা সন্তানদের ফাস্ট ফুড খেতে উৎসাহিত করে। তাই এ ব্যাপারে মায়েদের আগে শেখানো দরকার।
লেখক : তিন দশক ধরে অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী।
কেআই/ডব্লিউএন
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।