ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

আমাদের আশাবাদী হওয়ার এখনো কারণ আছে

গোলাম সারোয়ার

প্রকাশিত : ১৬:৪৭, ১৫ এপ্রিল ২০২০

আমাদের দেশে করোনাভাইরাসে মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্যের যতটা ক্ষতি করতে পারছে, তারচেয়ে হাজারগুণে বেশি ক্ষতি করেছে গণ-মানসিক স্বাস্থ্যের। অথচ আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার কথা ছিলোনা, ছিলো সচেতন হওয়ার কথা। 

আমরা সচেতনভাবে আমাদের অবস্থাটা দেখে নিই। পাঁচ দিন আগে ৯ এপ্রিল ১,০৯৭ জনকে টেস্ট করে আমরা রোগী পেয়েছিলাম ১১২ জন। আর আজ ১,৯০৫ জনকে টেস্ট করে আমরা রোগী পেয়েছি ২০৯ জন। তারমানে আমাদের সমাজে মোট রোগী জ্যামিতিক হারে বাড়েনি। আনুপাতিক হারে প্রায় ঠিকই আছে। ব্যাপার হলো, যত টেস্ট বাড়বে তত শনাক্ত রোগী বাড়বে। এ মূহুর্তে আঠারো কোটি মানুষকে একসাথে টেস্ট করাতে পারলে রোগী হবে হাজার হাজার কিংবা লাখ লাখ। কারণ যারা এখনো শনাক্ত হয়নি, তারাও রোগী। তাই সংখ্যা দেখেই ভয় পেলে চলবেনা।

এ থেকে আমরা কি তথ্য পাই। প্রথম তথ্য হলোঃ
করোনা আমাদের দেশে অনেক বেশি প্রাণঘাতী হবেনা। হলে ইতোমধ্যে ইউরোপ-আমেরিকার মতো আমাদেরও প্রতিদিন লাশ পড়তো হাজারে হাজারে। কিন্তু উহানে ধরা পড়ার পর গত সাড়ে তিন মাসে আমাদের সরকারী হিসেবে মারা গেছেন ৪৬ জন। আর আমাদের সরকারী শনাক্তের পরেও এই সংখ্যা হয়েছে এক মাস সাতদিন পর। আমাদের প্রথম সরকারী শনাক্ত ছিলো ৮ মার্চ। এই রকম সময়ের হিসাবে ইতালিতে মারা যায় ৪৬৩ জন আর শনাক্ত হয় ৯,১৭২ জন, যা তাদের ৯ মার্চের হিসাব। তাদের সরকারী হিসেবে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ৩১ জানুয়ারী। 

আসি আবার আমাদের কথায়। সরকারী হিসাবকে কেউ যদি বিশ্বাসে না নেয় তাদেরও দাবি করার সুযোগ নেই, আমাদের প্রতিদিন শয়ে শয়ে লোক মারা যাচ্ছে। অথচ টেস্ট বলছে, বহু মানুষ এই মূহুর্তে এই রোগ নিয়েই আছেন। কারণ যত টেস্ট করা হচ্ছে তত ধরা পড়ছেন। হয়তো এরমধ্যে অনেকে আক্রান্ত হয়ে ভালোও হয়ে গেছেন, যিনি নিজেই জানেন না।

দ্বিতীয় তথ্য হলোঃ
লকডাউন আমাদের দেশে কাজ দিচ্ছে। টেস্টের রেজাল্ট বলছে, অন্তত পাঁচদিন পরও প্রতি হাজারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে প্রায় একই রকম আছে। তারমানে আমাদের রোগীর ঘনত্ব বিরাজমান জনসংখ্যার ভিতরে খুব বাড়েনি। এই সুযোগটা আমরা কাজে লাগাতে পারি। আমরা ঘরে থেকেই রোগটির বিস্তৃতি কমিয়ে দিতে পারি। যেহেতু আমাদের দেশে ইউরোপ-আমেরিকার মতো ইহা এখনো প্রতিদিন হাজারে হাজারে লাশ ফেলছেনা।

তার মানে আমাদের আক্রান্তরা মূলত আল্লারওয়াস্তে ভালোই হয়ে যাচ্ছেন। এই নিয়মে আমরা যদি বেশি বেশি টেস্ট করি, তাহলে বেশি বেশি রোগী ডিটেক্ট হবে। তাতে করে আমরা বেশি বেশি তাদের থেকে দূরত্বে থাকতে পারবো। এতে করে আমাদের আক্রান্তের সংখ্যা লক হয়ে যাবে, পরিণামে শূন্যের কাছাকাছিতে চলে যাবে। 

এখন আমাদের সরকারের কাজ হলো, দ্রুত অনেক বেশি বেশি করে টেস্ট করা। আর জনগণের কাজ হলো, আতঙ্ককে ঝেড়ে ফেলা এবং ঘরে থাকা। আতঙ্ককে ঝেড়ে ফেলার যুক্তি হলো, করোনা আমাদের পথে পথে লাখে লাখে লাশ ফেলে যাবে, এ আশঙ্কা ঠিক নয়। করোনা ধরলেই মানুষ মরে যাবেনা। বরং এখানে মরার চেয়ে বাঁচার সম্ভাবনাই বেশি। বৈশ্বিক ডাটাও তাই বলছে। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে শনাক্ত রোগী ১৯,৪৬,৩৮৬ জন, তারমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ১,২১,৭০৪ জন আর ভালো হয়ে গেছেন ৪,৬০,১১১ জন। 

আমরা হিসাবে চলি। হিসাব হলো, করোনা প্রথম ধরা পড়ে উহানে, যা ইতালি থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার  দূরে, আমেরিকা থেকে প্রায় বার হাজার কিলোমিটার দূরে আর আমাদের চট্টগ্রাম থেকে প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে। খোদ জানুয়ারীতেই চট্টগ্রামে চাইনিজরা গিজগিজ করতো, আর আমাদের ইমপোর্টার ব্যবসায়ীরা প্রায় প্রতিদিন শয়ে শয়ে চায়না যেতো আসতো। কারণ চায়না হলো আমাদের আমদানীর একটি গুরুত্বপূর্ণ হাব।  

কোন ক্রমেই আমরা দাবি করতে পারিনা, আমরা ইউরোপীয় কিংবা আমেরিকানদের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তাই হিসাব মতেই করোনা আমাদের দেশে নিশ্চয় এসেছিলো সেই জানুয়ারীতেই। আমাদের সামাজিক সুরক্ষা দুর্বল বলে এবং আমাদের গোষ্ঠীভিত্তিক সংস্কৃতি বলে ইহা তখন আমাদের মাঝে ছড়িয়ে যাওয়ার কথা। তার মানে আমাদের বহু মানুষ বহু আগেই এই রোগে পড়ে ভালোও হয়ে গিয়েছে,  হয়তো তিনি জানেনইনা। আবার অনেকে হয়তো বিগতও হয়েছেন, মনে করেছেন অন্য রোগে মারা গেছেন। 

বাস্তবতা হলো, আমরা করোনা ভাইরাসের অনেক ফেভার পেয়েছি। প্রায় কোন রকম পাত্তাই আমরা দিই নাই সামাজিকভাবে। এখনো বহু মানুষ সুযোগ পেলেই মিলিত হয়ে আড্ডা দেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে। তবুও আল্লাহ আমাদেরকে রহম করেছেন। আমাদের অবস্থা নিশ্চয় নিউইয়র্কের মতো নয়। 

বিশেষজ্ঞরা অনেক তথ্যই দিচ্ছেন। অনেক বিজ্ঞানী রিভিল করেছেন, ইউরোপ-আমেরিকাতে যে নেচারের করোনা ভাইরাস আক্রমণ করেছে, আফ্রিকা এবং এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়াগুলো নাকি ততটা মারাত্মক নয়, কিংবা ভিন্ন নেচারের। হয়তো আমরা এরকম ফেভার নিয়ে আজো বেঁচে আছি। তবে মাথায় রাখতে হবে, যত রকমের পরিসংখ্যানই হোক, যেদিন যে মরবে সেদিনই তার কেয়ামত। তাই মৃত্যুর পরের নাম্বারে যেন আপনি না পড়েন সে দায়িত্ব আপনার। রাষ্ট্র অনেক চেষ্টা করছে। আপনি যদি নিজে না বাঁচতে চান তাহলে কে বাঁচাবে আপনাকে !

তবে রোগের আগে ভয়ে মরবেন না। আতঙ্কে কিংবা মানসিক রোগে মরবেন না। আপনার পূর্বপুরুষেরা হাজার বছর ধরে এর চেয়ে বহু বেশি প্রাণঘাতী বাহিনীর সাথে লড়ে লড়ে জিতে এসেছেন। সে জন্যেই আপনি  আজো এখানে আছেন। আপনি সেই বিজয়ী যোদ্ধার সন্তান। আপনি কেন ভয় পাবেন। অতএব আতঙ্ক নয়, সচেতন থাকুন। ঘরে থাকুন। এখন সরকারের পক্ষে অনর্গল টেস্ট করা, ডাক্তারদের পক্ষে সেবা ঠিক রাখা আর জনগণের পক্ষে ঘরে থাকা ছাড়া আপাতত আর কোন যুদ্ধ নেই। এটিই নিশ্চিত করতে হবে।

গোলাম সারোয়ার-গবেষক ও কলামিস্ট। 

আরকে/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি