আমাদের বেলমাস্টার করিম হোসেন
প্রকাশিত : ১৯:৩৭, ১০ এপ্রিল ২০১৮
প্রাচীন যাত্রাপালায় নির্দিষ্ট কিছু অভিনয় দৃশ্য শেষ হওয়ার পর একজন ঘন্টি বাজিয়ে জানান দিতেন পালাটির একটি অংক শেষ হয়েছে। তিনি ওই দলের বেলমাস্টার। আর আমাদের বেলমাস্টার, করিম হোসেন। সবার প্রিয় করিম হোসেন ভাই। জন্ম হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জের সুদিয়াখলা গ্রামে। সাল ১৯৪৮। মাত্র ১২ টাকা ১০ পয়সা বেতনে শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে দপ্তরী পদে যোগ দেন। সুনামের সাথে ১৯৯৪ সালে অবসর নেন। এই সুদীর্ঘকালে শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের শতসহস্র শিক্ষার্থীর স্মৃতির সাথে তিনি উজ্জ্বল হয়ে মিশে আছেন। করিম হোসেন মানেই ঘণ্টাধ্বনি। কখনো হৈ-হুল্লোড় করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসা। কখনো স্কুল গেটে থমকে দাঁড়ানো, অ্যাসেম্বলির জন্য। করিম হোসেন মানে শুধুই কি ঘণ্টাধ্বনি? কখনো-সখনো করিম হোসেন ছিলেন আতঙ্কের বার্তাবাহী দূত। লৌহমানব প্রধান শিক্ষকের চিরকুট হাতে শ্রেণি কক্ষের দরজায় দাঁড়ালে সব শিক্ষার্থীই আতঙ্কে থাকতো, না জানি কার নামে সমন এসে হাজির হয়েছে। তবে রেজিস্টার খাতা হাতে করিম হোসেন দরজায় এসে দাঁড়ালে সবার মনে পুলক জাগতো বুঝি ছুটির নোটিশ এসে গেছে। আহা আনন্দের আর সীমা নাই।
সবচেয়ে মজার ছিল, টিফিন পিরিয়ডে স্যারের স্লিপ নিয়ে টিফিন কালেক্ট করতে গেলে করিম হোসেন ভাই হিসাব থেকে দুটি বিস্কুট বেশি দিতেন। বিতরণকালে বিস্কুট ভাঙা না পড়লে চারআনা দামের দু’খানা নুনতা কপালে অতিরিক্ত জুটত। টিফিনের ঘণ্টা পড়লে দলবেঁধে একমাত্র টিউবওয়েলটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়া। কিন্তু লেডিস ফার্স্ট, মেয়েদের আগে সুযোগ দিতে হবে। উপরন্তু মেয়েদের হাতে থাকতো করিম হোসেন ভাইয়ের সরবরাহ করা টিনের গ্লাস।
স্কুলজীবনের সময়কালে কখনো মানুষটিকে বিরক্ত হতে দেখিনি। যেখানে রাশভারী প্রধান শিক্ষকের কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় তটস্থ সবাই, সেখানে দপ্তরীর কি হাল তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু প্রিয় করিম হোসেন স্কুলের পশ্চিমের গার্লস রুম থেকে শুরু করে পূর্বের শেষ প্রান্তের ক্লাস রুমটিরও খবর রাখতেন। হয়তোবা রাখতে হতো।
ক্লাসের গুরুগম্ভীর পাঠ যখন মনে ধরতো না, কিশোর বেলার উদাস মন জানালা গলে ছুটতো অগ্রহায়ণের পাকা ধানক্ষেতে। নাকে সোনালি ধানের মম গন্ধ। হলুদ মাঠে, সবুজ টিয়ার ধান খাওয়ার দৃশ্য, হিমেল বাতাস, এক তন্ময় পরিবেশ। হঠাৎ বেলমাস্টার করিম হোসেনের ঘণ্টাধ্বনি ফিরিয়ে দেয় চেতনা। স্যারের উপস্থিতি গুরুগম্ভীর ক্লাসের সমাপ্তি।
এখনো মাঝরাতে দূরে কোথাও ঘণ্টাধ্বনি শুনলে ফিরে যাই কৈশোরে। সেই খেলার মাঠ, ক্লাসরুম, সহপাঠী, প্রিয় শিক্ষক আর আমাদের বেলমাস্টার করিম হোসেন। সকলের করিম হোসেন ভাই। সাদামাটা মানুষ করিম হোসেন ভাই ২০০৩ সালে ইন্তেকাল করেন। করিম হোসেন ভাই যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।
অনেক অনেক শুভকামনা আপনার জন্য।
লেখক: শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৮৬ ব্যাচের ছাত্র
আরও পড়ুন