ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

আমাদের সেই সময় ও সীতাকুন্ড ডিগ্রী কলেজের পঞ্চাশ বছর পূর্তি

প্রকাশিত : ২৩:৫৪, ২ মে ২০১৮

এক.

সীতাকুন্ড ডিগ্রী কলেজে আমরা যখন ভর্তি হই তখনো কলেজ রোডে টিনের ছাউনি দেওয়া দোকানের সংখ্যা ছিল অনেক। শুধু সুপার মার্কেট ও ন্যাশনাল মার্কেট ছাড়া আর কোনো বড় মার্কেট তখন কলেজ রোডে ছিলনা। এখনকার তুলনায় দোকানের সংখ্যাও অনেক কম ছিল।

সীতাকুন্ড ডিগ্রী কলেজে তখন দালান ছিল আড়াই খানা। পুরনো ভবন, সায়েন্স বিল্ডিং আর সামনে ১১৬ নাম্বার কক্ষ। আমি জানিনা, ১১৬ নাম্বার কক্ষের নামকরণ বা সিরিয়াল নাম্বার এখনো একই আছে কীনা।

এই কলেজের আঙিনা জুড়ে, দেওয়াল জুড়ে আমাদের স্বপ্ন ছিল। প্রতিটা কক্ষে আমাদের প্রেম ছিল। ছোট্ট ক্যাম্পাসের এখানে সেখানে এলোমেলো আড্ডা ছিল। প্রতিটা দিন নতুন নতুন করে আমাদের পুণ:জন্ম হতো।কলেজ যেদিন বন্ধ থাকতো সেদিন ভীষণ অস্থির লাগতো আমার। মাঝে মধ্যে শুক্রবারেও কলেজের ঘাটে গিয়ে বসে থাকতাম আমি-আমরা। কীসের যেন এক দুর্বোধ্য নেশায় আমরা মোহগ্রস্থ হয়ে থাকতাম।

আমাদের মাঝে তখন আবেগ ছিল, আমাদের মাঝে তখন বিপ্লব ছিল। এই কলেজেই আমাদের ছাত্রলীগ করার হাতেখড়ি হয়। কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তখন জয়নাল ভাই। তিনি এখন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। এই কলেজেই আমাদের এক ঝাঁক  সদ্য কৈশোর পার হওয়া তরুণের হাত দিয়ে বের হতো হাতে লিখা দেওয়াল পত্রিকা `সৃষ্টি`। `সৃষ্টি` অনেকগুলো সংখ্যা করেছিলাম আমরা। তিনটি বা চারটি সংখ্যা আমি নিজের হাতে লিখেছিলাম।

আমাদের হাতে মোবাইল ফোন ছিলনা। ফেসবুক ইনস্ট্রাগ্রাম আমাদের কাছে অপরিচিত শব্দ। আমরা বিনোদন খুঁজতাম বইয়ে, পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে, কবিতা উৎসবে, মঞ্চে, সভায়।

সীতাকুন্ড ডিগ্রী কলেজ মানে আমাদের কাছে হিরণ্ময় স্যার।  হিরন্ময় স্যারের ক্লাস যারা করার সুযোগ পায়নি তাদের জীবনটাই বৃথা। তিনি ২০১২ সালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। কোনো পিএইচডি ডিগ্রীধারী শিক্ষক তিনি ছিলেন না। কিন্তু তাঁর বাচন ভঙ্গি, পড়ানোর স্টাইল, হ্যামিলনের বাঁশির মতো এক অদ্ভুৎ সুরের টানা লেকচারের নেশায় আমরা একটি প্রজন্ম বুঁদ হয়ে ছিলাম। এমন জনপ্রিয় ও দাপুটে শিক্ষকের শেষ জীবনটা ভালো যায়নি। পরাজিত সৈনিকের হাহাকার হয়তো তাঁর জীবনের বর্ণমালায় ছিলোনা। কিন্তু আর্থিক দৈন্যতায় ম্লানহীন জীবন আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি বলেই হয়তো মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনে যাই করি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক হবোনা।

অশোক স্যার ( Asok Saha) আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াতেন। এখন তিনি সিপিবি চট্টগ্রাম জেলা অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক। আমরা আদর্শগত ভাবে কখনো এক ছিলাম না। তবে আমরা দু`জনেই বিশ্বাস করতেন বিপ্লবে। প্রচুর বই পড়তেন। এখনো পড়েন। তার সাথে বই লেনদেন আমার এখনো হয়।

অধ্যাপক আবদুল আলী স্যার, কাশেম স্যার ( প্রয়াত), হালিম স্যার ( প্রয়াত), সুনীল বন্ধু নাথ স্যার, ইকবাল স্যার, শামীমা মেম, সুবীর স্যার (সুবীর কান্তি নাথ), তানভীর স্যার সবার কথা আমার মনে আছে স্পষ্ট ভাবে। সবাইকে নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে বলা যায়।

এখন কেমন জানিনা, আমাদের সময়ে শিক্ষকরা আমাদের প্রচুর বই পড়ার কথা বলতেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, ধর্ম সব। তাঁরা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো পণ্ডিত ছিলেন না। কিন্তু কোনো তরুণের সামনে পৃথিবীটাকে নতুন করে খুলে দেওয়ার শক্তি কেউ কেউ রাখতেন।

আলী স্যারের সাথে আমি তর্ক করেছিলাম ডারউইনবাদের পক্ষ নিয়ে। এখনো মাঝে মধ্যে দেখা হলে তর্ক হয়। তবে আমরা কেউই একগুঁয়ে নই। তর্ক করি নতুন পথের আশায়।

বয়সের জড়তা ভেঙ্গে নতুনকে বরণ করার নেশায় আমরা তখন বেপরোয়া। সামাদ, হাছান, হেলাল, জিয়া, সুমন, রাসেল, কামাল, রিপন, গিয়াস, পারভেজ, মিজান। মেয়েদের মধ্যে পম্পি ( প্রয়াত), জোবায়দা মুন্নী, গীতা, মুন্নী সোম, পলি সোম, সুরাইয়া, স্মৃতি, শিপু, জ্যোৎস্না, লিপি, সাবরিনা, শামসুন্নাহার, সুমী দে, আফরোজা, শিল্পী স্বল্প পরিসরে সবার নাম বলার সুযোগ নেই।

আমাদের ক্লাসে আমরা ছিলাম পঁচাত্তর জন। ১০১ থেকে রোল কল করা হতো। আমি অধমের রোল নাম্বার ছিল ১১০। আমরা আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু এই কলেজের আঙিনায় কাটিয়েছি।

গোপনে সিগারেটের হাতে খড়ি হলেও এই কলেজেই  পড়াকালীন প্রকাশ্যে ধূমপান শুরু করি। সেটাও এক ধরনের বিদ্রোহ। যেহেতু বড়রা ছোটদের সামনে ধূমপান করে সেহেতু " আমরাও বড় হয়েছি" বা " আমরা কাউকে পাত্তা দিইনা" এই মানসিকতা থেকেই যেখানে সেখানে আমাদেরকে সিগারেট হাতে দেখা যেতো। এসব ছেলেমানুষি এখন হাস্যকর লাগে নিজের কাছেই।

সীতাকুণ্ড ডিগ্রী কলেজের গেইটে দাঁড়িয়েই দুরু দুরু বুকে প্রেম প্রস্তাব দিয়েছিলাম একজনকে। সাথে সাথেই বোল্ড আউট! কী লজ্জা! কী লজ্জা!

আমাদের সময়ে গ্রামে `প্রেম` কে বলা হত `লাইন`। কেউ যখন কারো সাথে `লাইন` করত, অন্যরা তখন স্কুলের দেওয়ালে তাদের দু`জনের নাম যোগ চিহ্ন দিয়ে লিখে সেই লাইনের প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখত। যেমন: আদনান+................।

অধিকাংশ ছেলেই নিজে একা গিয়ে প্রপোজ করার সাহস রাখত না। সে ক্ষেত্রে সাহায্য করত মেয়ের বান্ধবী।  প্রেমিকার চাইতে প্রেমিকার বান্ধবীকে বেশি তেল দিতে হতো।

প্রেমপত্র লিখা ছিল সবচেয়ে বড় যোগ্যতা। যে যতো বেশি আবেগ দিয়ে লিখতে পারত, তার প্রেম টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তত বেশি। আর প্রেমিক চিঠির বিনিময়ে পাল্টা চিঠি যখন পেত, তখন তার আনন্দ ছিল পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন পেয়ে যাওয়ার মতো।

তবে হ্যাঁ, এখন সব ছেলে প্রপোজ করে ও সব মেয়ে প্রপোজ পায়। তখন প্রপোজ করার জন্য বুকের পাটা লাগত। আর প্রপোজ পাওয়ার জন্য কিছু না কিছু একটা আলাদা গুণ লাগতো।

আর কারো `লাইন` ভেঙ্গে যাওয়াকে বলা হত `ছ্যাঁক` খাওয়া। এখন অনেকে দিন একবার করেও ছ্যাঁকা খায়। কেউ সেই ছ্যাঁকার খবর জানেনা। আমাদের সময়ে কেউ ছ্যাঁকা খেলে গ্রামবাসী তাকে `দেবদাশ` নামকরণ করে শরৎচন্দ্রের কর্মের স্বার্থকতা ধরে রাখত।

আর এতো সব কেচ্ছা কাহিনীর জন্ম দিতাম আমরা সীতাকুন্ড ডিগ্রী কলেজের ঘাটে বসে। সেই কলেজের জন্য আমাদের আজন্ম ভালোবাসা।

সময় আমাকে আত্মকেন্দ্রীক করে তৈরি করছে। বাস্তবতার তাগিদে নিজেকে নিয়েই একটু বেশি ভাবতে শিখেছি হয়তো। তারপরও পুরনো স্মৃতিতে আশ্রয় খুঁজি পরম তৃপ্তিতে।

দুই.

সীতাকুন্ড ডিগ্রী কলেজ পঞ্চাশ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে নানা উদ্যেগ গ্রহণ করছে। সফলতা কামনা করছি। কোন ইতিবাচক উদ্যোগ কখনোই বৃথা যায় না। তবে এতোবড় আয়োজনকে সফল ও স্বার্থক করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলো অবশ্যই সার্বজনীনভাবে হওয়া উচিত। সেই জায়গা থেকে সীতাকুন্ড সমিতি - চট্টগ্রাম এর সভাপতি গিয়াস উদ্দিন আঙ্কেল এর কিছু প্রস্তাবকে সমর্থন করছি। প্রস্তাবগুলো হলো,

ক.সীতাকুণ্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ১ম ব্যাচ হতে ২০১৭ পর্যন্ত এখনো অনেকে বেঁচে আছেন। প্রত্যেক ব্যাচকে সংগঠিত করতে হবে ।

খ.কলেজ পরিচালনা পর্ষদ  এর সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ।

গ.কলেজ প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করতে হবে ।

ঘ.১ম ব্যাচ হতে ২০১৭ পর্যন্ত সব ব্যাচের প্রতিনিধির উপস্থিতে এবং কলেজ প্রশাসনসহ একটি মতবিনিময় সভা করে ঐ সভায় সর্বসন্মত সিদ্ধান্ত ক্রমে একটি সর্বজন গ্রহনযোগ্য দক্ষ, অভিজ্ঞ দলনিরেপক্ষ ৫০ বছর পূর্তি উৎসব উদযাপন কমিটি গঠন করতে হবে ।

ঙ.৫০ বছর পূর্তি উৎসব উদযাপন কমিটি আগামী ডিসেম্বর ২০১৮ অথবা জানুয়ারি ২০১৯ এ ৩ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের মহপরিকল্পনা হাতে নিবেন এবং বিভিন্ন উপ কমিটি গঠন করবেন ।

চ.একটি সফল অনুষ্ঠান করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন তা ৫০ বছর পূর্তি উৎসব উদযাপন কমিটি করবেন ।

৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠাণ সফল ও স্বার্থক হোক। সবার জন্য শুভকামনা।

টিকে


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি