"আমার যৌবনের ২৫টি বছর ফিরিয়ে দেবে কে?"
প্রকাশিত : ২৩:৪৩, ২৭ জানুয়ারি ২০২১
প্রতীকী ছবি
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের করা এক মামলার তদন্তে মূল আসামির নাম ও তার বাবার নামের সাথে মিল থাকায় অভিযুক্ত করা হয়েছে আরেক ব্যক্তিকে। পরে সেই ব্যক্তি উচ্চ আদালতে আবেদন করলে দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের ভুল হয়েছে বলে স্বীকার করে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত নিয়ে ঐ ব্যক্তির অভিযোগ প্রমাণিত না হলে তার ১৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারতো। তবে ঐ ব্যক্তিকে শেষ পর্যন্ত কারাভোগ করতে না হলেও, এরকম ক্ষেত্রে তেমন সুপ্রসন্ন হয়নি অনেকেরই ভাগ্য।
সাম্প্রতিক সময়ে এরকম একটি আলোচিত মামলা ছিল জাহালমের ঘটনাটি, যিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের ভুল তদন্ত এবং এক ব্যাংক কর্মকর্তার ভুল সাক্ষ্যের কারণে তিন বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। পরে মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসে যে, জাহালম নিরপরাধ। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে সব মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মুক্তি পান জাহালম।
কোনও অপরাধ না করেও জীবনের একটা লম্বা সময় কেটেছে কারাগারে- সিনেমার কাহিনীর মতো শোনালেও এরকম ঘটনা কিন্তু মাঝেমধ্যেই ঘটে থাকে আমাদের আশেপাশে। তদন্তে অনিচ্ছাকৃত বা ইচ্ছাকৃত ভুল, মিথ্যা সাক্ষ্যদান বা বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হওয়া- এরকম নানা কারণে আদালত অনেক সময় ভুল রায় দিয়ে থাকেন। যার ফল ভোগ করতে হয় নিরপরাধ কোনও ব্যক্তিকে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিনা অপরাধে কারাভোগ করার এমনই কয়েকটি আলোচিত ঘটনা তুলে ধরা হলো আজকের এই প্রতিবেদনে।
বিনা অপরাধে ১৩ বছর কারাভোগ, অত:পর...
২০০৩ সালে সাতক্ষীরায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন ওবায়দুর রহমান, যিনি আবেদ আলী হিসেবে বেশি পরিচিত। ২০০৬ সালে আদালত ঐ মামলায় আবেদ আলীসহ আরও দু'জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
এরপর ২০১১ সালে হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে এবং আবেদ আলীকে খালাস দেয়। কিন্তু উচ্চ আদালত খালাস দিলেও রাষ্ট্রপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন এবং পরবর্তী চার বছর ধরে শুনানি চলে মামলার।
২০১৮ সালের এপ্রিলে আদালত খালাস বিভাগের রায় বহাল রেখে সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু আদালতের সিদ্ধান্তের পরও মুক্তি পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি আবেদ আলীর। সেই বছরের অক্টোবর মাসের যে দিন আবেদ আলীকে কারাগার থেকে খালাস করার রায়ের কপি কারাগারে গিয়ে পৌঁছায়, তার কিছুক্ষণ আগেই মারা যান আবেদ আলী।
তিনি যে নির্দোষ, মৃত্যুর আগে সেই স্বীকৃতিটা পেলেও মুক্ত অবস্থায় একদিনও তিনি পরিবারের সাথে সময় কাটাতে পারেননি!
কৈশোর, তারুণ্য ও যৌবন কেটেছে জেলে
১৯৯২ সালে এক বাসে ডাকাতির অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাবুল মিয়া যখন গ্রেফতার হন, তখন তার বয়স তখন ১৮ বছর। এরপর ২০১৭ সালে তিনি যখন বেকসুর প্রমাণিত হন এবং তাকে খালাস দেয়া হয়, সে সময় তার বয়স ৪৩। অর্থাৎ- বাবুল মিয়া তার জীবনের কৈশোরের একাংশ, তারুণ্য এবং যৌবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছেন জেলে।
মজার ব্যাপার হলো- বাবুল মিয়া যে মামলায় ২৫ বছর কারাভোগ করেছেন, সেই মামলায় দোষী প্রমাণিত হলেও তার সর্বোচ্চ শাস্তি হতো ১০ বছর!
শুধুমাত্র বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণেই মূলত এই দীর্ঘসময় কারাগারে থাকতে হয় বাবুল মিয়াকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে উঠে আসে যে, ১৯৯৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে বিচার চলাকালীন সময়ে মামলার সাক্ষীদের অধিকাংশই সাক্ষ্য দিতে আসেননি। মামলার বাদী এবং তদন্ত কর্মকর্তাও কখনও আদালতে উপস্থিত হননি বলেও উঠে আসে প্রকাশিত খবরে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, জেল থেকে বের হয়ে বাবুল মিয়া সাংবাদিকদের সামনে একটি প্রশ্ন রেখেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সামর্থ্য ছিল না কারও। প্রশ্নটি ছিল- "আমার যৌবনের ২৫ বছর ফিরিয়ে দেবে কে?"
স্ত্রী-কন্যা হত্যার মিথ্যা অভিযোগে জেলে ২০ বছর!
নিজের স্ত্রী ও দেড় বছরের কন্যা হত্যার অভিযোগে ২০০০ সালে আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয় বাগেরহাটের শেখ জাহিদকে। ঐ বছর শেখ জাহিদ এই রায়ের বিরুদ্ধে অ্যাপিল করেন, যেটির শুনানি শেষে ২০০৪ সালে হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ডের আদেশ জারি রাখেন।
হাইকোর্টের ঐ রায়ের বিপরীতে আসামি জাহিদ আবারও আবেদন করেন, যেই আবেদনের সুরাহা হয় ২০২০ সালের অগাস্টে। আদালত শেখ জাহিদকে নির্দোষ ঘোষণা করে রায় দেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় কারাবাসের পুরোটা সময়ই ফাঁসির আসামির জন্য নির্ধারিত 'কনডেমড সেল'-এ দিনযাপন করতে হয় শেখ জাহিদকে। ৩০ বছর বয়সে শাস্তির মেয়াদ শুরু করা ঐ ব্যক্তি যখন খুলনা কারাগার থেকে মুক্তি পান, তখন তার বয়স ৫০ বছর।
বাবার নামের সাথে মিল, কারাগারে ৫ বছর!
গত সপ্তাহে কাশিমপুর কারাগার থেকে আরমান নামের এক ব্যক্তিকে খালাস করা হয়, যিনি ২০১৬ সাল থেকে কারাগারে ছিলেন। ২০০৫ সালে বিস্ফোরক আইনে করা একটি মামলায় একজন আসামির বাবার নাম আর মিরপুরের বাসিন্দা আরমানের বাবার নাম একই। ঐ মামলায় আসামিকে ২০১২ সালে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। ঐ আসামি সে সময় পলাতক ছিলেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলো অনুযায়ী, শুধুমাত্র বাবার নাম একই থাকার কারণে ২০১৬ সালে মিরপুর থেকে আরমানকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। পরে এই বিষয়ে আরমানের পরিবারের পক্ষ থেকে আদালতে রিট করা হয় এবং চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদালত আরমানকে খালাসের রায় দেন।
এই ঘটনায় আরমানকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়ার এবং আরমানকে আটকের ঘটনার দায় নিরূপণে নতুন করে তদন্তের সিদ্ধান্ত দেন আদালত।
বহুল আলোচিত জাহালমের কারাভোগ
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন জাহালমকে গ্রেফতার করা হয়, তখন তিনি নরসিংদীতে এক পাটকলে কাজ করছিলেন। এরপর ঠিক তিন বছর পূর্ণ হবার দু'দিন আগে হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে ফেরেন জাহালম।
মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, তিনি নির্দোষ হয়েও জেল খাটছিলেন। একটি ব্যাংক থেকে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ছিল আবু সালেক নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। ঐ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জাহালমকেই আবু সালেক বলে চিহ্নিত করে সাক্ষ্য দিলে জাহালমকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত।
কার দোষে জাহালমের কারাভোগ করতে হলো- তা নির্ণয় করতে পরবর্তীতে তদন্ত কমিটি গঠন করে দুর্নীতি দমন কমিশন। অবশ্য সেই তদন্তের ফলাফল আজও দিনের আলো দেখেনি।
এনএস/