আমার রক্তের রং লাল, দ্রোহের রংও…
প্রকাশিত : ১৯:৫৫, ৩ জুন ২০২০
লেখক- খান মুহাম্মদ রুমেল
আমি জর্জ ফ্লয়েড। আমার রক্তের রং শ্বেতাঙ্গদের মতোই লাল। যখন পিচঢালা সড়কের শক্ত শানে আমার টুঁটি চেপে ধরা হয়- আমি আতঙ্কে জমে যাই। সাদা মানুষের পায়ের তলায় আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সাদার শ্রেষ্ঠত্বের কাছে আমার দম কিংবা জীবনের কি মূল্য আছে? একজন কালো মানুষের মূল্যহীন জীবন সাদা মানুষের পায়ের নিচে চলে গেলে কী-ই-বা যায় আসে বিশ্ব সভ্যতার!
বিশেষজ্ঞরাইতো গবেষণা করে দেখিয়েছেন, এই মার্কিন মুলুকে দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে বর্ণবাদ। সাদার চেয়ে তিনগুণ বেশি কালো মানুষ মারা যায় পুলিশের হেফাজতে। সভ্যতা রক্ষার, মানবতা রক্ষার মহান দায়িত্ব যাদের কাঁধে, তারাইতো সেই সভ্যতার দীপশিখাটি জ্বলজ্বলে রাখতে এমনটা করতেই পারেন! স্বাস্থ্য সেবাতেও সাদার আর কালোর পার্থক্য প্রকট। আর্থিকভাবেও আমরা- কালো মানুষেরা সাদা মানুষের চেয়ে অনেক দুর্বল। তাহলে আমাদের গলায় পা দিয়ে,আমাদের দম বন্ধ করে দিয়ে যদি শ্বেতাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ববাদের ধ্বজ্জা আরো একটু উপরে উঠে তাহলে কি এমন ক্ষতি?
এই সাদাত্বের শ্রেষ্ঠত্ব দিক বিদিকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যই তো ২০১৬ সালে রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কে বিজয়ী করা হয়। তিনি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের গোঁড়া সমর্থক। তিনি কাজে কর্মে সেটা দেখিয়েছেনও। তারপরেও আমি- জর্জ ফ্লয়েড- একজন কালো মানুষ- আমার মৃত্যু নিয়ে কেন এতো হৈ চৈ! এক শ্বেতাঙ্গের হাতে এক কৃষ্ণাঙ্গ নিহতের ঘটনায় সপ্তাহখানেক ধরে এই মহান মার্কিন মুলুকে- সাদার সাম্রাজ্যে বিক্ষোভ চলছে, এটা কোনো কথা হলো?
এই অন্যায় কাজের জন্য বিক্ষোভকারীদের প্রতি সামরিক শক্তি প্রয়োগের ঘোষণা দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প- আমাদের মহান প্রেসিডেন্ট উচিৎ কাজ করেছেন। সাদার শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ করার এতো ধৃষ্টতা কালো মানুষেরা পায় কোত্থেকে? কি, শুধু কালো নয় বিক্ষোভের মধ্যে সাদাসহ বিভিন্ন বর্ণ গ্রোত্রের গুটিকয়েক মানুষজনও রয়েছেন, তাই বলছেনতো? আরে ভাই, শোনেননি আমাদের মহান প্রেসিডেন্ট বলেছেন– এসবই বামপন্থীদের অরাজকতা! আর এই বামরা পারেও বটে। পৃথিবী জুড়ে এই বামরা ভাঙতে ভাঙতে অনু পরমানুতে পরিণত হলেও সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দেয়ার অভ্যাস তাদের গেলো না।
এছাড়া আছে এই মহান মার্কিন সাম্রাজ্যের চির শত্রু রাশিয়া। আছে চীন, ইরানের মতো কিছু লাফাঙ্গা রাষ্ট্র। যারা ওঁত পেতেই থাকে কখন আমাদের পান থেকে চুনটা খসবে। আরে বাবা কত বড় সাহস – মার্কিন মূলুকের আইনের শাসন নিয়ে প্রশ্ন তোলে? তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়গুলো বিবৃতি দেয় এই গণবিক্ষোভ নাকি যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের অন্ধকারের দিকগুলো তুলে এনেছে। কই, পৃথিবীতে আমাদের মতো উন্নত এবং সভ্য অন্য যেসব রাষ্ট্র রয়েছে তারাতো এ ধরণের কথা বলে না! যদি আসলেই আমাদের আইনের শাসনের অভাব থাকতো তারা কি বলতো না!
যাই হোক অনেক কথা বললাম। এখন এই স্বর্গলোকে এসে আমার কেবল মনে পড়ে ফেলে আসা পূর্ব পুরুষের পিতৃভূমির কথা। আহা আমার সবুজ আফ্রিকা! আফ্রিকার সবুজ ছাওয়া কোনো গ্রাম থেকে ধরে আনা হয়েছিলো আমার পূর্ব পুরুষকে? সেই যে দাসপ্রথার কাল। যখন সাদা মানুষেরা ধরে আনতো আমাদের। তারপর দীর্ঘ দিবস রজনীর জাহাজ যাত্রা শেষে , সভ্যতাকে এগিয়ে নেয়ার মিছিলে শামিল করা হতো আমাদের। আমরা কালো মানুষরাতো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সভ্য হওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখন এই উত্তর আধুনিক কালে এসেও কি আমরা সভ্য হতে পারিনি? আর পারিনি বলেই কি আমাদের পায়ের তলায় পিষে মারতে হয়? আর কতো শতাব্দী গেলে পরে আমরা সভ্য হবো! আর কতো শতাব্দী গেলে পরে আমাদের আর পায়ের তলায় পিষে মরতে হবে না। জবাব কারো কাছে পাই নি। না মর্ত্যলোকে। না এই স্বর্গলোকে এসে।
তবে প্রত্যয় রাখি, এখানে, এই স্বর্গলোকে মার্টিন লুথার কিংয়ের সঙ্গে দেখা হবে আমার। একমাত্র তিনিই পারবেন আমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে। আমি আপনার অপেক্ষায় আছি মহান মার্টিন লুথার কিং! কালো মানুষের প্রশ্নের উত্তর কেবল কালো মানুষই দিতে পারে।
লেখক: অ্যাসাইনমেন্ট ডেস্ক ইনচার্জ, সময় টিভি।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।