আমিও শরণার্থী নিজেরই কাছে
প্রকাশিত : ১৩:১০, ২৯ নভেম্বর ২০২০
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।
‘মানুষ নানাভাবেই শরণার্থী’ -কথাটি আমার চেতনায় সারাদিনই ঘোরাঘুরি করেছে। আমি চললে সেও চলেছে, অথচ আমি থেমে গেলেও সে কিন্তু থামেনি। কথা ক’টি জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা কয়ে গেছে’ আমার সঙ্গে, নানানভাবে ভাবিয়েছে আমাকে।
প্রথমেই ভেবেছি ‘শরণার্থী’ শব্দটি নিয়ে। ‘শরণার্থী’ শব্দটির সঙ্গে ‘ছিন্নমূলতার’ একটি নিবিড়তা আছে, একটি সম্পর্ক আছে ‘ভীতির’ সঙ্গে, একটি যোগসূত্র আছে ‘অসহায়ত্বের’ সঙ্গে। এই সব মাত্রিকতা আছে বলেই তো একজন শরণার্থী ‘আশ্রয়’ প্রার্থনা করে অন্যত্র, অন্যের কাছে। সে আশ্রয় খোঁজা সব সময়েই ‘বস্তুগত আশ্রয়’ নয়, ‘মানসিক আশ্রয়’ও বটে। মানুষ আত্মস্বত্ত্বার আশ্রয় খোঁজে জীবনভর। ব্যক্তি মানুষ যেমন শরণার্থী, তেমনি তো গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষও।
আসলে নানানভাবেই তো মানুষ আশ্রয় প্রার্থনা করে। যেমন- অবিচারের শিকার হলে মানুষ আইনের কাছে আশ্রয় চায়, নিরাপত্তাহীনতায় সে রাষ্ট্রের দ্বারস্থ হয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে সমাজের হস্তক্ষেপ কামনা করে। বাস্তুচ্যূত মানুষ ভিনদেশে আশ্রয় প্রার্থনা করে। সমাজে নারীর প্রতি অত্যাচার, নির্যাতন আর ধর্ষণের মাধ্যমে তাঁদের মানসিকভাবে আশ্রয়চ্যূত করছি আমরা। তাঁরা তখন আশ্রয় চায় নীতির কাছে, মানবিকতার কাছে, পরিবারের কাছে। যাঁরা শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধী, তাঁরাও তো শরণ প্রার্থনা করে সমাজ আর রাষ্ট্রের কাছে। আর যখন কোথাও তার আশ্রয় মেলে না, তখন মানুষ সজল চক্ষে আশ্রয় ভিক্ষা করে বিধাতার কাছে।
ব্যক্তিজীবনেও তো আমরা সতত: আশ্রয় খুঁজি। কারণে অকারণে মায়ের আঁচলে কি আশ্রয় নেইনি- মনে কি হয়নি, ওইটাই সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়? ভয় যখন আমাদের গ্রাস করে, তখন বাবার স্নেহবাক্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করি। অসফলতা যখন আমাদের ভঙ্গুর করে, তখন শিক্ষকের আশ্বাসবাণীর কাছে আশ্রয় নেই। নৈরাশ্য যখন আমাদের অন্ধকারে নিমজ্জিত করে, তখন বন্ধুর কাঁধে মাথা রাখি। দু:খ-বেদনার অশান্তিতে শান্তির আশ্রয় খুঁজি প্রিয়জনের বক্ষে।
মনে রাখা দরকার, মানুষ দু:খে অন্যের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, সুখে সে অন্যকে আশ্রয় দেয়। ব্যক্তি মানুষ তো শরণার্থী তার নিজের কাছেও। মানুষ আশ্রয় খোঁজে তার আবেগের কাছে, তার কান্নার কাছে, তার অভিমানের কাছে। কত সময়ে কত অবস্থায় নিজের আবেগ ভিন্ন আর অন্য কিছুর কাছে যাওয়ার অবস্থা থাকে না। কত নৈরাশ্য, কত অবিচার, কত অপমানে আঁধারে এক নীরব অশ্রুপাতের কাছে নিজেকে মানুষ সমর্পণ করে।
প্রিয়জনের কথায়, কাজে যখন মানুষ আঘাত পায়- তখন সে আশ্রয় খোঁজে অভিমানের কাছে। কান্না, আবেগ আর অভিমানের কোনও ভাষা নেই, তবু তারা মানুষকে কতভাবে সান্ত্বনা দেয়।
কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও তো জানি যে, শরণার্থী হলেও আশ্রয় মেলে না প্রায়শই। সারা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ বাস্তুচ্যূত আজও আশ্রয়হীন। নানান বিত্তবান নগরীতে কত শত মানুষ ঠিকানাহীন। বঞ্চিত মানুষও তো শরণার্থী এক দুয়ার থেকে অন্য দুয়ারে। রাষ্ট্র উদাসীন সে সব ব্যপারে। নানান সমাজে সংখ্যালঘুদের অধিকার বঞ্চিত করে তাদের অত্যাচার করে আশ্রয়হীন করার প্রক্রিয়ায় সতত: তৎপর কত অপশক্তি।
নারীর প্রতি নির্যাতন ও ধর্ষণের ক্ষেত্রে তাঁদের আশ্রয়ের জায়গাটি কি দিতে পারছে রাষ্ট্র ও সমাজ? তবে কি সেই ‘না-ভাবতে চাওয়া’ ভাবনাটিই সত্যি যে- চূড়ান্ত বিচারে মানুষ শুধুমাত্র নির্ভর করতে পারে তার নিজের ওপরেই- সে নিজেই তার একমাত্র আশ্রয়দাতা?
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।