আমি চাই না আর কারো সন্তান এভাবে শেষ হয়ে যাক: জয়শ্রী জামান
প্রকাশিত : ১৯:০৫, ২ অক্টোবর ২০১৮ | আপডেট: ১৮:১২, ৩ অক্টোবর ২০১৮
জয়শ্রী জামান। পেশায় একজন সাংবাদিক। আত্মহত্যা প্রতিরোধে দীর্ঘ দিন থেকে নিরলসভাবে কাজ করছেন। যখনই শুনেন কেউ আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে সেখানেই তিনি ছুটে যান। চেষ্টা করেন তাদেরকে আত্মহননের এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে। জয়শ্রী জামানের বুকে পাথর সমান কষ্ট। সেই কষ্টকে ভালোবাসায় রুপ দিয়ে চেষ্টা করছেন মানুষের জীবন বাঁচাতে।
অভিমান, কষ্ট, আর মনোবেদনা থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন তার দুই কিশোর বয়সী সন্তান চিরশ্রী জামান (১৮) ও মোহাম্মদ বিন আলীম (১৫)। ২০১৪ সালে তারা উত্তরার বাসায় আত্মহত্যা করে। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর দুই সন্তান নিয়েই ছিল জয়শ্রী জামানের সুখের ঠিকানা। কিন্তু বুক ভরা অভিমান থেকে চিরবিদায় নেন তার আদরের দু’সন্তান। সন্তান হারিয়ে তিনি এখন আর কারো মায়ের বুক যেন খালি না হয় সে জন্য ২০১৫ সালে তৈরি করেছেন ‘ব্রাইটার টুমরো ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনের মাধ্যমে যারা আত্মহত্যা করতে চায় তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
একুশে টিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন জয়শ্রী জামান। আলাপচারিতায় তিনি জানান, আত্মহত্যা থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য তার প্রাণান্তকর চেষ্টার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আউয়াল চৌধুরী।
ইটিভি অনলাইন: আপনার দু’সন্তান একসঙ্গে আত্মহত্যা করলো, কেন তারা এ পথ বেছে নিল? আপনি কী বুঝতে পারেননি ওরা এমন কাজ করতে পারে?
জয়শ্রী জামান: আমি মোটেই বুঝতে পারিনি তারা এমন কাজ করবে। আমি যেহেতু ভিকটিম আমি সব সময় চিন্তা করি কেন আমার সন্তানরা আত্মহত্যা করলো। কেন আমি ওদেরকে রক্ষা করতে পারলাম না। আমার ইচ্ছে ছিল যেভাবেই হোক ওদেরকে রক্ষা করবো। ওদের মনে স্ট্রেস ছিল, দুঃখ ছিল তা আমি দূর করতে পারি নাই। আমি একজন সচেতন মা হয়েও তাদেরকে ফেরাতে পারিনি। তবে ওরা আত্মহত্যা করতে পারে এটা আমার মাথাই আসেনি। অনেক কিছু মাথায় ছিল কিন্তু এ বিষয়টা একবারের জন্যও মাথায় আসেনি। ওরা যেহেতু আত্মহত্যা করেই ফেলেছে, আমি মনে করি, যে কোনো মানুষই এটা করতে পারে।
ইটিভি অনলাইন: আপনি এখন আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করছেন, কিভাবে কাজ করছেন?
জয়শ্রী জামান: আমি বিভিন্নভাবে এখন আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করছি। বাংলাদেশে আত্মহত্যা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যে বিষয়গুলো দেখি; সেটা হলো প্রতি পদে পদে বাধা। আমরা আমাদের বাচ্চাদের যেভাবে শাসন করি, তাদের সঙ্গে যেভাবে ব্যবহার করা হয়, তাদের প্রতি শাসনের যে ভাষা তাতে মনে হয় আমি মরে যাই। দেখা যায়, অনেক বাবা সন্তানকে মারছেতো মারছেই। সামান্য অপরাধের জন্য মেরে একেবারে অস্থির করে ফেলছে। এগুলো কিন্তু সঠিক পদ্ধতি না। এর মাধ্যমে সন্তান আত্মহত্যা প্রবণ হয়ে উঠতে পারে।
ইটিভি অনলাইন: কিভাবে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা যায় বলে মনে করেন?
জয়শ্রী জামান: আমি মনে করি, আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থা মানুষকে বিষন্ন করে তুলছে। এটা নিয়ে কিন্তু কেউ কথা বলছে না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, আমাদের ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, নারী নির্যাতন, বেকারত্ব প্রতিটি বিষয় আত্মহত্যার জন্য একেকটি দায়ী। আর সবচেয়ে বড় দায়ী হচ্ছি আমরা নিজেরা। আমরা আমাদের নিজেদেরকে বদলাতে পারি না। আমাদের স্বভাব বদলাতে পারি না।
অনেকে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে হট লাইন চালুর কথা বলেন। আত্মহত্যা রোধ করার জন্য একটা হট লাইন চালু করলেই হলো না। হট লাইনের অপর পাশে যিনি কথা বলছেন তার ওই মেধা আছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। দেখা যাবে হেল্প লাইনে আমি এমন কথা বলে ফেললাম যার একটু দেরিতে আত্মহত্যা করার কথা সে এবার আরও তাড়াতাড়ি আত্মহত্যা করে বসবে। এ বিষয়গুলো অনেক সেনসেটিভ। এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। যে জন্য আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে আমি আর্টিস্ট, সাংবাদিক, শিক্ষকদের কাছে যাই। সবার সঙ্গে কথা বলছি। সবাইকে সচেতন করার জন্য চেষ্টা করছি।
ইটিভি অনলাইন: আত্মহত্যা থেকে ফেরানোর কার্যকর পদ্ধতি কী হতে পারে বলে মনে করেন?
জয়শ্রী জামান: আত্মহত্যা থেকে ফেরানোর জন্য সম্মিলিত চেষ্টা প্রয়োজন। তাই আমি সবার সঙ্গে নিয়মিত কথা বলি। মিটিং করি, লেখা লেখি করছি। নিজে আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করছি। আমি একটা ম্যাগাজিন বের করছি। একটা ওয়েব সাইট করার চেষ্টা চলছে। মানুষকে সচেতন করার জন্য যা দরকার করার চেষ্টা করছি। তাই আমি বলবো, সুইসাইড প্রিভেনশনের দুইটা মেথড রয়েছে-একটা হলো কাউন্সিলিং অন্যটি মেডিকেশন। এ দুই পদ্ধতিতে মানুষকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাদেরকে সঠিক চিকিৎসা দিতে হবে এবং কাউন্সেলিং করতে হবে। তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না। ভালো আচরণ দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
আরেকটা বিষয়ে আমি বলবো, জীবন অত্যান্ত মূল্যবান। এটা মানুষকে বুঝাতে হবে। মৃত্যু সামাধান না এই ম্যাসেজটা সামাজের প্রত্যেকটি মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। আত্মহত্যা কোনো সমাধান দেয় না। আমার বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেল সে কারণে আমি আত্মহত্যা করে জীবনটা শেষ করে দেব। এভাবে জীবন শেষ করাটা সমাধান না। আমাকে ছেড়ে চলে গেছে; ওকে অসুবিধা নেই, আমি দাঁড়াতে পারবো। এই মানসিকতাটা মানুষের মধ্যে গ্রো করতে হবে। নিজের মধ্যে আত্ম শক্তি তৈরি করতে হবে।
ইটিভি অনলাইন: আপনি সংগঠন তৈরি করেছেন, সংগঠন থেকে কী ধরনের কাজ করছেন?
জয়শ্রী জামান: ব্রাইটার টুমরো সব সময় উৎসাহমূলক কথা বলে থাকে। আমি মনে করি, মানুষকে ভালোবাসার বিকল্প কিছু হতে পারে না। এটা সুইসাইড প্রিভেনশনের এক নাম্বার শর্ত। যারা দুঃখ ভারাক্রান্ত থাকে, তারা তাদের কথাগুলো শেয়ার করবে কার কাছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মায়ের সঙ্গে শেয়ার করে। এক্ষেত্রে মা’ই যদি বেঁকে বসে তাহলে কী অবস্থা হবে। মা তার কথা শুনছেই না, গুরুত্বই দিলো না। আবার স্কুলে গিয়ে তাকে শুনতে হচেছ সে সবচেয়ে খারাপ। বাচ্চাদেরকে কোনো ধরনের নেগেটিভ কথা বলাই যাবে না। এ সমস্ত ম্যাসেজগুলো সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। ‘ব্রাইটার টুমরো’ মানুষকে সচেতন করার এই কাজগুলো করছে।
এই সংগঠনের মাধ্যমে আমি এখন আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করছি, কারণ আমার বাচ্চাদের সমস্যাগুলো আমি বুঝিনি। তাই অন্য কেউ যেন আর আত্মহত্যা না করে সে জন্য সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছি। আমার জন্য এটা সহ্য করা অনেক কষ্টের। সারাদিন অফিস করে দিনশেষে আমি আবার সেই শুন্য বাসায় ফিরে যাচ্ছি। আমার জমাট বাঁধা দুঃখগুলো কেউ বুঝতে পারবে না, সেটা কেউ চিন্তাও করতে পারবে না। এটা বর্ণনা করার মতো না।
ইটিভি অনলাইন: কী কারণে বাচ্চারা আত্মহত্যা করতে পারে বলে মনে হয়? আপনার বাচ্চাদের সঙ্গে সর্বশেষ কী কথা হয়েছিল?
জয়শ্রী জামান: আমার বাচ্চাদের আত্মহত্যার কারণগুলো একটু অন্যরকম। ওদের বাবা আরেকটা বিয়ে করেছিল। তারা সেটা অনেকটা মানিয়ে নিয়েছিল। পরে তাদের একটি সন্তান হলো। ফেসবুকে তারা দেখলো বাবা তাকে নিয়ে আনন্দ করছে। তখন তারা আস্তে আস্তে আরও আপসেট হয়ে গেল। আমার মেয়ে আমাকে বলে, ‘তুমি আমাকে পৃথিবীতে আনছ এ জন্য তোমাকে আমি কখনো ক্ষমা করবো না’। আমার কী বলার আছে। তখন আমার কাছে মনে হয়েছে বড় কুৎসিত একটা পৃথিবীতে আমি ওদেরকে নিয়ে এসেছি।
অভিমান করে ওরা চলে গেছে। আমি চাই না আর কেউ এভাবে চলে যাক। পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। তাই আমাদের সবাইকে সবার পাশে দাঁড়াতে হবে। বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করছে। এই আত্মহত্যা প্রতিরোধে মানুষটির পাশে মমতা নিয়ে আমাদের দাঁড়াতে হবে। আমি চাই না আর একজন মানুষও সুন্দর এই পৃথিবীটা ছেড়ে চলে যাক।
এসি
আরও পড়ুন