ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

আরব বসন্ত ও সিরিয়া সংকট, কালের চলমান অগ্নিগর্ভ

প্রকাশিত : ২১:২৮, ২০ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ২৩:৫৭, ২০ এপ্রিল ২০১৮

আমাদের পৃথিবী হলো কতগুলো স্থলভাগ আর জলভাগের সমষ্টি। স্থলভাগগুলোতে আবার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ভুখণ্ড নিয়ে এক একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। এক একটি রাষ্ট্র শাসন করে এক একজন নৃপতি। সে হিসেবে বর্তমানে গোটা দুনিয়া শাসন করছে শ’দুয়েকের মতো নৃপতি। পৃথিবীর বেশিরভাগ নৃপতিদের ইতিহাস হলো তাঁরা যখন মসনদে বসে শাসনের ছড়ি ঘোরায় তখন তাঁরা ভেবে বসেন তাঁরাই অনন্তকাল তখতে বসে ভুখন্ড শাসন করে যাবে। ঐসব স্বৈরাচারী শাসকদের অবিরাম বিচ্যুতির আড়ালে ভূমি বিপ্লবের জন্যে তৈরি হয়। তারপর কোন এক মামুলি কারণে ঘটতে থাকে দুনিয়া কাঁপানো এক একটি ঘটনা। 

তেমনি একটি ঘটনা ঘটে ১৯১৪ সালের ২৮ জুন। এদিন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে একজন সার্বিয়াবাসী অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্ডিনান্ডকে হত্যা করে। তার ঠিক একমাস পর অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তারপর ধীরে ধীরে দেশ দুটির বন্ধু রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধের ময়দানে জড়ো হতে থাকে। একপক্ষে আসলো ওসমানীয় সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি ও বুলগেরিয়া অক্ষশক্তি হয়ে, আর অপরপক্ষে মিত্রশক্তি হয়ে আসলো সার্বিয়া, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, রুমানিয়া ও আমেরিকা। এই যুদ্ধ চললো ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত। ইতিহাসে এটিই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সর্বগ্রাসী সে যুদ্ধে প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষ মারা যায় আর আহত হয় আরো প্রায় সোয়া দুই কোটি। ধ্বসে পড়ে চার চারটি সাম্রাজ্য, উলট-পালট হয়ে যায় পৃথিবীর যাবতীয় ভুখণ্ডের ভৌগোলিক-জ্যামিতিক ইতিহাস। ঠিক একইভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দেনা-পাওনার ইতিহাস থেকে জন্ম নেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের, যা ১৯৩৯ সালে জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণ এবং জাপানের চীন আক্রমণের মধ্য দিয়ে সূচনা হয়। এই যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করে প্রায় সোয়া সাত কোটি আদম সন্তান !

জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, ইতিহাসের শিক্ষা হলো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। আসলেই কেউ শিক্ষা নেয় না। অন্তত নৃপতিরাতো নয়ই। তাই ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে মাটির পৃথিবীতে ছোট কিংবা বড় স্কেলে, শুধু কালের সন তারিখগুলো পরিবর্তিত হয়। তেমনি ইতিহাসের এক রিকন্সিলিয়েশন হচ্ছে ইউরেশিয়া, ভুমধ্যসাগর আর ভারত মহাসাগরের সঙ্গমস্থলে-আরব ভূখণ্ডে।

ঘটনার সূত্রপাত একজন সাধারণ মানুষের সংক্ষুদ্ধতা থেকে। ১৮ ডিসেম্বর ২০১০ সাল। তিউনিসিয়ার একজন ফলব্যবসায়ী ফেরিওয়ালা মুহাম্মদ বোয়াজিজি পুলিশে দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারে ক্ষুদ্ধ হয়ে নিজের গায়ে গ্যাসোলিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। ব্যস! বোয়াজিজির শরীরের এই আগুন সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এমন না যে পৃথিবীতে বোয়াজিজিই প্রথম ব্যক্তি যিনি সংক্ষুদ্ধ হয়ে আগুনে আত্মাহুতি দেন। বরং আমরা অনেকবারই আমাদের পৃথিবীতে এইসব দেখেছি। দেখেছি তিব্বতের ভিক্ষুরা চীনের শাসনের প্রতিবাদে অনেকেই এভাবে প্রাণ দিয়েছেন। তাহলে তিউনিসিয়ার আগুন কেন দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়লো এশিয়া, ইউরোপে, আফিকায় কিংবা বাকী বিশ্বে! আসলে ঘুষ, দুর্নীতি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক নিপীড়ন আর স্বৈরশাসনের ফলে ওখানে ভূমি আগেই রেডি হয়ে গিয়েছিলো। বোয়াজিজি শুধু শুরুর ঘণ্টায় হ্যামারের বাড়ি দেন। এভাবেই হয়। প্রতিটি সভ্যতায় এভাবেই হয় এবং হবে। তিউনিসিয়ার বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়লো সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে। আরবে বসন্ত কালে শুরু হয়েছিলো বলে ইতিহাসে এই জাগরণকে বলা হলো আরব বসন্ত।

আরব জাগরণে প্রথমেই ভেঙ্গে পড়লো তিউনিসিয়ার জেন এল আবেদিন বেন আলির তখত। মাত্র ২৮ দিনের জেসমিন বিপ্লবের ফলে ১৪ জানুয়ারি ২০১১ সালে ২৩ বছরের স্বৈরশাসকের সিংহাসন ভেঙ্গে পড়লো এবং তিনি দৌড় দিয়ে সৌদি আরবে পালিয়ে গেলো। তারপর জেগে উঠলো মিশর। ২৫ জানুয়ারিতে টলে উঠলো হোসনী মুবারকের ৩০ বছরের সিংহাসন। জেগে উঠলো তাহরির স্কয়ার। মাত্র ১৮ দিনের গণবিদ্রোহে স্বৈরশাসক মুবারক পরিত্যক্ত হলেন।

ক্ষমতা হারান ইয়েমেনের ৩৩ বছরের স্বৈরশাসক আলি আব্দুল্লাহ সালেহ। ক্ষমতা ও জীবন হারান ৪২ বছরের স্বৈরশাসক মুয়াম্মর গাদ্দাফি। এভাবেই আরব জাগরণের উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়লো সিরিয়ায়, আলজেরিয়ায, জর্দানে, আর্মেনিয়ায়, আজারবাইজানে, জর্জিয়ায়, ইউরোপের আলবেনিয়ায়, ক্রোয়েশিয়ায়, স্পেনে, সাব সাহারান অঞ্চলের বারকিনা ফাসোয়, জিবুতিতে, উগান্ডায়, মালদ্বীপে, চীনে এবং সর্বশেষ আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিটে!

আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে স্বৈরাচারী সরকারগুলো পড়তে থাকলো। কিন্তু লিবিয়ায় স্বৈরশাসক গাদ্দাফি তখত ছিলো লৌহকঠিন। এখানে আন্দোলন দমিত হতে থাকলে পশ্চিমারা বিদ্রোহীদের সহায়তা দিতে থাকলো। শেষে গাদ্দাফি নিজের শহরেই নিহত হলো। ততদিনে আন্দোলন আরব উপত্যকা ছেড়ে ইউরোপ, আমেরিকা আর কিছুটা চীনের দিকে হাওয়া দিতে লাগলো। এবার পশ্চিমারা সচেতন হলো। তারা আন্দোলনের রাশ টেনে ধরলো, শুধু সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পতন ছাড়া। আন্দোলনের বিশ্বায়ন থামানো তাদের জন্যে ফরজ হয়ে গেলো কারণ ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল কর’-আন্দোলনে বিশ্বের ধনী-দরিদ্রের শ্রেণিযুদ্ধের হিসাব ও ডাক এলো। অতএব পশ্চিমারা আন্দোলনটা সিরিয়ায়ই আটকে রাখলো। কিন্তু সিরিয়ার সমীকরণ হয়ে গেলো জটিলতর।

সিরিয়ায় বাশারের পরিবার ৪৭ বছর ধরে ক্ষমতায়। তাঁর পিতা হাফেজ আল-আসাদ ১৯৭০ সালে বাথ পার্টির অভ্যন্তরে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন এবং প্রায় তিন দশক যাবত সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ২০০০ সালে তাঁর মৃত্যুর পর বাশার ক্ষমতায় আসেন। সিরিয়ায় শিয়ারা মাত্র ১২ ভাগ। সেখানে ৭৫ ভাগ লোক সুন্নি আর বাকীরা খ্রিস্টান। বাশারের পরিবার সংখ্যালঘু শিয়ার হয়েও গত ৪৭ বছর ক্ষমতায় থাকা একটি বড় বিস্ময়। মধ্যপ্রাচ্যের সব সংঘাত শিয়া-সুন্নিকে কেন্দ্র করে। এই হলো সিরিয়া সংকটের আসল প্যাঁচ।

সিরিয়ায় আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধ চলছে ২০১১ সাল থেকে। এই যুদ্ধে ইতিমধ্যে ৪ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, ১২ থেকে ১৫ লাখ মানুষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছে, ৫০ লাখের বেশি মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং দেশের ভিতরেই বাস্তুচ্যুত ও স্থানান্তরিত হয়েছে ৬ লাখের বেশি মানুষ।  সিরিয়ার যুদ্ধ চলছে বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে নিজ দেশের অনেকগুলো বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মাঝে। সাত বছরে এত ক্ষয়ক্ষতির পরেও এখনো বাশার কিভাবে টিকে আছে! কারণ বাশারের সাথে প্রথম থেকেই রাশিয়া এবং ইরান আছে, আছে লেবাননের হিজবুল্লাহসহ ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যের সবশিয়া সম্প্রদায়!

সিরিয়া এখন একটি অগ্নগর্ভ । কারণ এখানে খেলতেছে বহু আঞ্চলিক ও আন্তির্জাতিক শক্তি। সৌদি আরব প্রথম থেকেই বাশারের পতনের জন্যে আদাজল খেয়ে লেগে আছে। এই লক্ষ্যে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সহায়তাও পাচ্ছে। এই লক্ষ্যে প্রথমে আইএসও সৃষ্টি করা হলো। আইএস শেষে উল্টো চৌবল দিতে এলে সবাই সর্বশক্তি দিতে আইএস ধ্বংস করলো। সর্বশেষ দুমায় নিরীহ জনগণের উপর আসাদ বাহিনীর রাসায়নিক হামলার জবাবে গত ১৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সিরিয়ায় একযোগে মিশাইল হামলা চালায়। রাশিয়া এই হামলায় তীব্র নিন্দা করে বলেছে সিরিয়ায় পশ্চিমাদের আরো হামলা হলে পৃথিবী অশান্ত হবে। পুতিনের এই হুমকিকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই কারণ সিরিয়ার রাশিয়া এবং ইরানের সৈন্য আছে। সুতরাং এই হামলা তাঁদের নিজেদের উপরই হামলা।

সিরিয়ার রণক্ষেত্রে চিরবৈরী ইসরায়েল ও ইরান যুদ্ধ থেকে খুব অল্পদুরত্বেই অবস্থান করছে। ইরান-ইসরায়েল হুমকি-পাল্টাহুমকি এখন আর জল্পনাকল্পনার পর্যাযে নেই। ইরান সিরিয়ায় একটি বিমানঘাঁটি তৈরি করেছে যেখান থেকে ইসরায়েলে সরাসরি হামলা চালানো যাবে। ইতোমধ্যে ইরানের একটি সামরিক ড্রোন ইসরায়েলের আকাশসীমা অতিক্রম করলে ইসরায়েল ড্রোনটি ভূপাতিত করে এবং ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানের বিমানঘাঁটিতে হামলা করে ইরানের কুদস ফোর্সের সাত সদস্যকে হত্যা করে। ইরান বলেছে এর জবাব দিবে। এটিই হলো সিরিয়া সংকটের সর্বোচ্চ নাজুক সময়। কারণ ইরান ও ইসরায়েল যদি সিরিয়ার রণক্ষেত্র সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে যায় তবে এই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র বড় পরিসরে আসতে বাধ্য। যুক্তরাষ্ট্র আসলে রাশিয়ায় যুদ্ধে অংশগ্রহন ছাড়া উপায় নেই। তখন এই যুদ্ধ আর সিরিয়ায়, আরবে কিংবা নিছক মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেনা। অবশ্যই তা’ বিশ্বের বিভিন্ন ভুখন্ডে ছড়িয়ে পড়বে।

আমাদের সমগ্র পৃথিবীটাই বর্তমানে অগ্নিগর্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আমরা আমাদের সভ্যতাটিকে অনেক অনেক দূর নিয়ে এসেছি জ্ঞানে বিজ্ঞানে । কিন্তু পরিহাস হলো, পৃথিবীটা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে যে পরিমাণ মারণাস্ত্র লাগবে আমরা তারচেয়ে অনেকগুণ বেশিই তৈরি করে বসে আছি। আর সেগুলোর উপর ক্ষমতাবান স্রেফ কয়েকজন নৃপতি। এদের ভিতরে এমনও কেউ কেউ আছেন, যাঁদের নৈতিকতা নিয়ে অনেক আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। এদের দু’চার দশজনের হটকারীতায়ও সমস্ত পৃথিবী তুলোর মতো উড়ে যেতে পারে।  

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট                                                                                           


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি