জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস
আসুন আলোকিত মানুষ গড়ি
প্রকাশিত : ১১:৪১, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
আজ ৫ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস।’ এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ‘গ্রন্থাগারে বই পড়ি, আলোকিত মানুষ গড়ি।’ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দিবসই গুরুত্বপূর্ণ।
তারপরও কোনো কাজের অধিকতর গুরুত্ব বোঝাতে আমরা সুনির্দিষ্ট তারিখকে ‘বিশেষ দিবস’ ঘোষণা করি, আড়ম্বরের সঙ্গে উদযাপন করি। তেমনই একটি দিন ৫ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস।’ দেশে ২০১৮ সালে প্রথম জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস উদযাপন শুরু হয়। ওই বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল, ‘বই পড়ি, স্বদেশ গড়ি।’
যেভাবে শুরু :
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাধারণ অধিশাখা ২০১৭ সালের ৭ নভেম্বর একটি পরিপত্র জারি করে। তাতে বলা হয়, ‘সরকার ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ঘোষণা করেছে এবং ওই তারিখকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে উদযাপনের নিমিত্তে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালনসংক্রান্ত পরিপত্রের ‘খ’ শ্রেণীভুক্ত দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্তকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’ ২. ‘ওই সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে পরিপালনের জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়-বিভাগ-সংস্থাকে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হল।’
মন্ত্রিপরিষদ পরিপত্র (৭ নভেম্বর ২০১৭) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের (১৪ ডিসেম্বর ২০১৭) আলোকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকা বোর্ডের আওতাধীন অনুমোদিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান (অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষক) বরাবর ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি একটি ‘বিজ্ঞপ্তি’ পাঠায়।
তাতে বলা হয়, ‘সরকার ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখ জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে উদযাপন এবং দিবসটিকে ‘খ’ শ্রেণীভুক্ত হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী দিবসটি যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হল।’ তবে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি ও বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি উদযাপন করে।
আমাদের দেশে ওপর থেকে চাপিয়ে না দিলে সৃজনশীল কোনো কাজ সহজে হয় না। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে (স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা) ‘একাডেমিক গ্রন্থাগার’ পরিচালনার নির্দেশনা জারি আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা প্রতিপালন হতে দেখা যায় না।
গ্রন্থাগারিকের পদ সৃজন :
২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের (শাখা-১৩) জনবল কাঠামোবিষয়ক প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, মাধ্যমিক (ষষ্ঠ থেকে দশম) ও উচ্চ মাধ্যমিক (ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ) স্তরে সহকারী গ্রন্থাগারিক-ক্যাটালগারের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ।
স্কুল-কলেজে পদটি এমপিওভুক্ত হলেও সমমানের মাদ্রাসায় করা হয়নি। এক যাত্রায় দুই ফল। এ বৈষম্যের আশু অবসান জরুরি। এছাড়া সরকার ইতিমধ্যে ক্লাস রুটিনে ‘গ্রন্থাগার বিজ্ঞান’কে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা দিলেও অনেক প্রতিষ্ঠান তা পালন করছে না। বিষয়টির ‘মনিটরিং’ হওয়া দরকার।
আমরা মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের মতো দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় সহকারী গ্রন্থাগারিকের পদ সৃষ্টির দাবি জানাচ্ছি।
পাঠকসৃজন প্রকল্প :
বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি ও বেরাইদ গণপাঠাগার ২০১০ সাল থেকে ঢাকা জেলার বাড্ডা থানার বেরাইদ ইউনিয়নকে (হালে ডিএনসিসি ওয়ার্ড নং ৪২) ‘পাঠকসৃজন পাইলট প্রকল্প’ ধরে কাজ করছে। সরকারি প্রজ্ঞাপনের আগে থেকেই এখানকার স্কুল-মাদ্রাসা-কলেজে ‘গ্রন্থাগার বিজ্ঞান’কে রুটিনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
টেকসই উন্নয়ন :
বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোকে টেকসই করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের কাছে তিনটি দাবি পেশ করে। যেমন : ১. বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো ক, খ ও গ শ্রেণীভুক্ত করে স্থায়ী মঞ্জুরির আওতায় আনা হোক।
গ্রন্থাগারিকের পদ সৃষ্টি ও পদটি এমপিওভুক্ত করে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিকের সমান বেতন স্কেল দেয়া হোক। ২. অনুদান প্রদানে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার’ চালু করা হোক। ৩. অনুদান কমিটিতে বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হোক। তাহলে গ্রন্থাগারগুলো টিকে যাবে। জ্ঞানভিত্তিক, অলোকিত, বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনে এর বিকল্প নেই বলে মনে করি।
পুনশ্চ : গ্রিক শব্দ ‘Libre’ থেকে ‘Library’ শব্দের উৎপত্তি। এর বাংলা অর্থ ‘গ্রন্থাগার’। গ্রন্থাগার হচ্ছে বই-পুস্তক, পত্রপত্রিকা-সাময়িকীসহ অডিও-ভিজ্যুয়াল সামগ্রীর ভাণ্ডার, সংগ্রহশালা, সংরক্ষণাগার। পাঠক গ্রন্থাগারে বসে বই পড়তে পারেন। শর্তসাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পড়ার সামগ্রী বাড়িতেও নিতে পারেন।
প্রবাদ আছে, ‘একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য তার গ্রন্থাগার, মহাফেজখানা (আর্কাইভ-সংগ্রহশালা), জাদুঘর ধ্বংস করে দেয়াই যথেষ্ট, আর কিছু লাগবে না।’ এ থেকেই বোঝা যায় প্রতিটি জাতির জন্য গ্রন্থাগারের গুরুত্ব কতটা।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গ্রন্থাগার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়িয়া আছে।’ যে জাতির গ্রন্থাগার যত সমৃদ্ধ, সে জাতি তত উন্নত।
লেখক : সাংবাদিক; সভাপতি, বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি
এসএ/