আসুন নিজের হৃদয়ের দিকে তাকাই
প্রকাশিত : ২০:৫৮, ১২ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ২১:০০, ১২ জুলাই ২০২১
চারপাশের সবার দিকে আমরা তাকাই। অন্যের দোষ গুণ ভুল ত্রুটি ভালো মন্দ ইত্যাদি সহজেই আমাদের চোখে পড়ে। আমাদের চোখ সবাইকেই দেখে, দেখে না কেবল নিজেকে। আমাদের মনের চোখও অনেকটা তা-ই। কিন্তু নিজের সমস্যা বুঝতে হলে, সমস্যার ধরন জানতে হলে, সমস্যাকে সম্ভাবনায় রূপ দিতে চাইলে, সর্বোপরি ভেতরের অফুরন্ত আত্মশক্তির বিকাশ ঘটিয়ে নিরাময় ও সুস্থতার পথে এগিয়ে যেতে চাইলে প্রয়োজন নিজের দিকে ফিরে দেখা, নিজের গভীরে তাকানো।
এই আত্মসচেতনতা খুব সহজেই আমাদের সমস্যা এবং সম্ভাবনার পথ নির্দেশ করে। আমাদের ভুল আর করণীয়-বর্জনীয়গুলো সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি আমরা। আর এটি সম্ভব মেডিটেশনে।
‘হৃদয়ের কথা বলি হৃদয়ে’ মেডিটেশনে আপনি জীবনে প্রথমবারের মতো আপনার হৃৎপিন্ডের সাথে কথা বলবেন। তার প্রতি মনোযোগ দেবেন। শুনবেন কী বলতে চায় সে। আপনার হৃৎপিন্ডের কাছে জানতে চাইবেন—তার কষ্টের কারণ, কী কারণে সে কাঁদছে, আপনার কোন কোন ভুল জীবনাচার দিনের পর দিন তাকে অসুস্থ করে তুলেছে? গভীর আত্মনিমগ্নতায় আপনি শুনবেন তার উত্তর, তার কষ্টের কারণগুলোকে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করবেন। এই মেডিটেশনের মধ্য দিয়ে আপনি জীবনে প্রথমবার আপনার হৃদযন্ত্রের সাথে সংযোগ স্থাপন করবেন।
আসুন আমরা মেডিটেশনে প্রবেশ করি।
মেডিটেশন ।। হৃদয়ের কথা বলি হৃদয়ে
১. নিয়মমাফিক মনের বাড়ির দরবার কক্ষে গিয়ে বসুন।
২. ৩ থেকে ০ গণনা করে দরবার কক্ষের ডান দিকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করুন নিরাময় কক্ষে। ৩-২-১-০। আপনি পৌঁছে গেছেন নিরাময় কক্ষে।
আপনার চেয়ারে আরাম করে বসুন। অবলোকন করুন হালকা নীল আলোয় প্লাবিত হচ্ছে আপনার পুরো অস্তিত্ব ............
প্রিয় সুহৃদ, আপনি জানেন, হৃদরোগ শুধু হৃৎপিন্ডের রোগ নয়। হৃদরোগের আসল উৎস হলো হৃদয়। পারিবারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মমতার অভাব, প্রিয়জনের সাথে সম্পর্কের জটিলতা, পেশাগত স্ট্রেস বা মানসিক চাপের প্রভাব পড়ে আমাদের মনের ওপর। পরবর্তী সময়ে যা আমাদের হার্টের স্বাভাবিক কর্মছন্দকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে। তাই সুস্থ স্বাভাবিক হার্টের জন্যে মন থেকে এসব নেতিবাচক আবেগ ঝেড়ে ফেলতে হবে।
৩. এবার আপনার হার্টকে অবলোকন করুন। হার্টে কান লাগান। হার্টের কথা শুনুন। হার্টের সাথে কথা বলুন ............
অনুভব করুন, হৃদযন্ত্র বা হার্ট আপনার দেহের কত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। সারা শরীর থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইডযুক্ত দূষিত রক্ত হার্টে এসে জমা হচ্ছে, হার্ট সেই রক্ত ফুসফুসে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আবার ফুসফুস থেকে অক্সিজেনসমৃদ্ধ বিশুদ্ধ রক্ত হার্টে আসার পর হার্ট পাম্প করে সেই রক্ত শরীরের প্রতিটি কোষে পাঠিয়ে দিচ্ছে ............
অনুভব করুন জন্মগ্রহণ করার পর থেকে একমুহূর্তের জন্যেও না থেমে প্রতিনিয়ত এ-কাজ করছে আপনার হার্ট ............
৪. হার্টকে আপনার পরম বন্ধু হিসেবে অনুভব করুন। আপনাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে হার্টের নিরলস পরিশ্রমকে অনুভব করুন। জীবনব্যাপী এ অক্লান্ত কাজের জন্যে গভীর কৃতজ্ঞতা জানান তাকে। আপনার হার্টের জন্যে অনুভব করুন গভীর মমতা ............
অবলোকন করুন হার্ট আপনার শরীরের একটি অঙ্গ শুধু নয়; আপনার সেবায় নিয়োজিত এক জীবন্ত অস্তিত্ব, আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু। এ বন্ধুর সাথে এখন সরাসরি কথা বলবেন আপনি ............
প্রিয় বন্ধুর সাথে দীর্ঘদিন পর যোগাযোগ হওয়ায় আনন্দানুভূতি নিয়ে হার্টকে ডাকুন। সম্বোধন করুন কোনো মিষ্টি, শ্রুতিমধুর নামে।
দেখুন, সে আপনার সম্বোধনের কী উত্তর দিচ্ছে। উত্তর শুনতে কান পাতুন আপনার হার্টে। বুঝতে চেষ্টা করুন তার উত্তর।
তার কণ্ঠের উষ্ণতাকে অনুভব করুন।
আপনার শরীরের একটি মাংসপিন্ড হিসেবে নয়, হৃদযন্ত্রকে অনুভব করুন অনুভূতিময় একটি অস্তিত্ব হিসেবে যা আপনার আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ সব অনুভূতিতেই সাড়া দেয় ও প্রভাবিত হয়।
হার্টকে জিজ্ঞেস করুন, আপনার জীবনে তার ভূমিকা কী?
উত্তরে সে কী বলছে? ............
বুঝতে চেষ্টা করুন হার্টের উত্তর। সে বলছে, আপনাকে বাঁচিয়ে রাখাই তার কাজ। আপনি যাতে জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেন, সেজন্যেই সে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
অনুভব করুন হার্ট আপনাকে বলছে, আমি তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু।
৫. হার্টকে জিজ্ঞেস করুন, আপনাকে সে কীভাবে সাহায্য করছে?
শুনুন তার উত্তর—‘তুমি কখনো প্রচন্ড হতাশায়, দুঃখে, যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়েছিলে। কখনো রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলে। কখনো নিঃসঙ্গতায়, কখনো না পাওয়ার বেদনায়, কখনো-বা লজ্জা-সংকোচ-হীনম্মন্যতায় অসহায় হয়ে পড়েছিলে। এসব পরিস্থিতি আমার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। তবুও আমি কখনো থেমে থাকি নি। প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করে গেছি
আপনার হার্ট তার জমানো কষ্টগুলো, আকুলতাগুলো ধীরে ধীরে আপনাকে বলে যাচ্ছে। আপনি অনুভব করছেন, দৈনন্দিন জীবনের ও দীর্ঘদিনের জমে থাকা আবেগ অনুভূতির সরাসরি প্রভাব পড়েছে আপনার হার্টের ওপর। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটাই হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ।
৬. আপনি দেখুন, বিশ্লেষণ করুন, আপনার হার্টের ওপর এ ধরনের আবেগ, অনুভ‚তির প্রভাব কতটুকু। হার্টকে রোগগ্রস্ত করে তুলতে পারে এমন কিছু কি আপনার জীবনে ঘটে চলেছে? ............
জীবনের প্রতি কি আপনি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধাশীল? নিজের ও পরিবার-পরিজনের প্রতি পরিপূর্ণ মমতা অনুভব করেন কি? ............
আপনি জানেন, স্নেহ-মমতাহীন জীবন এক দুঃসহ বোঝা। আর এর প্রভাবেই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েন আপনি।
জীবনের প্রতি কি কোনো অনীহা বোধ আছে আপনার? আপনি কি নিজেকে ভালবাসেন? নিজের প্রতি কতটুকু মমতা আছে আপনার?
হতাশা, অনুশোচনা, আশঙ্কার মতো নেতিবাচক আবেগ, হীনম্মন্যতা, ধূমপান, মাদকাসক্তি, পেশাগত চাপ, মানসিক অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা, ঋণগ্রস্ততা আপনার জীবনকে আনন্দহীন বোঝায় রূপান্তরিত করতে পারে। আবার টিভি ও মিডিয়া আসক্তি বা পরিবারের কারো সাথে ভুল বোঝাবুঝি, ক্ষোভ কিংবা দাম্পত্য কলহ জীবনের প্রতি আপনাকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলতে পারে।
অবলোকন করুন, এমন কোনোকিছু কি ঘটেছে আপনার জীবনে? সময় নিয়ে অনুসন্ধান করুন ............
বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে আপনার হার্টকে জিজ্ঞেস করুন। তাকে জিজ্ঞেস করুন, এসবের কোনটার ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে তার ওপর? আপনার ক্ষেত্রে হৃদরোগের এক বা একাধিক কারণ থাকতে পারে। অবলোকন করুন, হৃদরোগের জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ কী আছে আপনার জীবনযাপনে? আপনি কি ধূমপায়ী? আপনি কি অতিভোজনে অভ্যস্ত? অতিরিক্ত তেল, চর্বি, মসলাযুক্ত খাবার দেখলেই কি আপনি ঝাঁপিয়ে পড়েন? আপনি কি খুব বেশি টেনশন করেন বা সবসময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন? কিংবা আপনার কি শারীরিক পরিশ্রমে অনীহা রয়েছে? প্রতিদিন নানা অজুহাতে আপনি কি হাঁটা, ব্যায়াম করা থেকে বিরত থাকেন? অবলোকন করুন, কোন বিষয়টি বা বিষয়গুলো আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে? সময় নিয়ে ভাবুন ............।
আপনি শনাক্ত করেছেন শারীরিক অনিয়মগুলো, অনাচারগুলো।
আপনি বুঝতে পারছেন সুষম খাবার, ব্যায়াম, মেডিটেশন ও স্বাস্থ্য পরিচর্যার গুরুত্ব।
৭. এবার প্রতিজ্ঞা করুন, আপনি হার্টের যথাযথ যত্ন নেবেন।
গভীর ভালবাসায় প্লাবিত করুন হার্টকে। অনুভব করুন আপনার এই একাগ্র মনোযোগে হৃদযন্ত্র উল্লসিত হয়ে উঠেছে। হৃদয় ও হৃৎপিন্ড একাকার হয়ে গেছে।
৮. অবলোকন করুন আপনার মমতা পেয়ে আপনার হার্ট আনন্দে নাচছে ............ নাচছে আপনার মন ............।
সারা দেহ-মনে এক অভূতপূর্ব আনন্দের শিহরণ অনুভব করুন ......।
অনুভব করুন এক সুস্থ হৃদযন্ত্র আপনার জীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু।
দিনে যখনই সময় পান, নীরবে চোখ বন্ধ করে হার্টের প্রতি মনোযোগ দিন। তার কাজকে অবলোকন করুন। হার্টের প্রতি আপনার মনোযোগ হার্টকে প্রতিদিন করে তুলবে আগের চেয়ে সুস্থ, আগের চেয়ে সবল, আগের চেয়ে প্রাণবন্ত। আপনার জীবনে আসবে নতুন ছন্দ, নতুন আনন্দ, নতুন বিশ্বাস, নতুন প্রত্যয়।
৯. এবার মনে মনে প্রত্যয়ন করুন, সুস্থ থাকার ক্ষমতা প্রতিটি মানুষের সহজাত। সুস্থতা স্বাভাবিক আর অসুস্থতা অস্বাভাবিক। আমি প্রাকৃতিক নিয়মেই সুস্থ হচ্ছি, প্রাণবন্ত হচ্ছি, সফল হচ্ছি, সুখী হচ্ছি।
১০. এবার ০ থেকে ৩ গণনা করে আপনি দরবার কক্ষে ফিরে আসুন। তারপর নিয়মমতো ০ থেকে ৭ গণনা করে স্বাভাবিক জাগ্রত অবস্থায় ফিরে আসুন।
লেখাটি ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান এর লেখা এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই ‘হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক বই থেকে নেয়া।
আরকে//