প্রিয় লন্ডনে অপ্রিয় অভিজ্ঞতা (পর্ব-৪)
ইন্ডিয়ান কুইজিন নামে চলে বাঙালি রেস্টুরেন্ট
প্রকাশিত : ১৯:২৮, ২ মে ২০১৮ | আপডেট: ২১:৫৪, ২ মে ২০১৮
কেউ কখনো কি প্রশ্ন তুলেছেন কেনো যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টগুলো স্বাধীনতার সাত চল্লিশ বছর পর আজও ইন্ডিয়ান কুইজিন নামে চলবে বাংলাদেশের কত মন্ত্রী, এমপি, সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা ব্রিটেন যাচ্ছেন এবং বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টগুলোয় বসে খাচ্ছেন। কিন্তু তারা কখনো জানতে চাননি স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পরও ব্রিটেনের বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টগুলো এখনও কেনো ইন্ডিয়ান কুইজিন নামে পরিচিত হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যে প্রতি দশটি বাঙালি রেস্টুরেন্টের মধ্যে নয়টির মালিক বাংলাদেশি। সেখানে ছোট বড় প্রায় ১০ হাজার বাঙালি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টগুলো আজও ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট নামেই পরিচিতি পাচ্ছে-যা বাংলাদেশকে বরং হেয় করছে। অথচ দ্বৈতনাগরিকের নামে এই সব প্রবাসীরা বাংলাদেশ থেকে নানা রকম সুযোগ সুবিধা নিয়ে চলেছে।
অনেক ভারতীয়রাও বিষয়টি পছন্দ করে না যে বাংলাদেশিরা তাদের রেস্টুরেন্টগুলো ইন্ডিয়ান কুইজিন নামে পরিচালনা করুক। কারণ ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সাফল্যকে তারা একটু বৈরী চোখেই দেখে। তারা কখনো ভাবতে পারেনি, তাদের টপকে বাংলাদেশিরা একদিন যুক্তরাজ্যে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় নাম করুক। আমি নিজে এ নিয়ে কোন কোন রেস্টুরেন্ট মালিক ও শ্রমিকদের সাথে ভারতীয়দের ঝগড়া ঝাঁটিও শুনেছি।
কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, আমার দেখা বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টগুলো সমগ্র যুক্তরাজ্যের খাদ্য অভ্যাস এবং রুচিতে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। খোদ অনেক ব্রিটিশ পরিবার এখন বাংলাদেশি মেন্যু অনুযায়ী নিজেরা তাদের ঘরের খাবার তৈরি করে। অনেক বাংলাদেশি শ্যেফ প্রতিনিয়ত রাজকীয় খেতাবও পাচ্ছেন। কিন্তু তারাও পরিচিতি পাচ্ছেন ইন্ডিয়ান শ্যেফ হিসেবে।
ব্রিটেনে প্রথম বাঙালি রেস্টুরেন্টটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার খবর পাওয়া যায় লন্ডনে ১৮০৯ সালে। পাঁচ বছর পর হিন্দুস্তানি কফি হাউজ নামক ওইরেস্টুরেন্টটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘদিন ব্রিটেনে কোন বাঙালি রেস্টুরেন্টের অস্তিত্ব ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ১৯৪৬ সাল নাগাদ সেখানে ২০টি বাঙালি রেস্টুরেন্টের অস্তিত্বের কথা শোনা যায়। ১৯৬০ সালে সেগুলো বেড়ে ৩০০টি হয়। এর বিশ বছরের মাথায় ১৯৮০সালের দিকে ব্রিটেনে বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার। ১৯৬০ সালের পর ব্রিটেনে উপ-মহাদেশের অভিবাসীদের ঢল নামতে শুরু করলে বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টগুলো ব্যাপক সাফল্য অর্জন করতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ব্রিটেনে এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কমপক্ষে ১০ হাজার বাঙালি রেস্টুরেন্ট যার নয় হাজারের মালিক সরাসরি বাংলাদেশি। অথচ সব রেস্টুরেন্টের নামে এখনও ইন্ডিয়ান কুইজিন লেখা হচ্ছে।
কেউ কেউ এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসা থেকে ব্রিটেনে মিলিওনিয়ার হয়েছেন। কিন্তু তাদের এই সাফল্যের পরও রেস্টুরেন্টগুলো এখনও পরিচালিত হচ্ছে ইন্ডিয়ান কুইজিন নামে। যার প্রতি আমার মন কখনো সায় দেয়নি।আমি রেস্টুরেন্টগুলোর ছোট ছোট বিলবোর্ডের দিকে চেয়ে থেকেছি আর ভেবেছি আহা ইন্ডিয়ান কথাটির জায়গায় বাংলাদেশি লেখা হলে কী এমন ক্ষতি হতো! বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ব করার মতো এই সব বাংলাদেশি মালিকদের কি কিছুই নেই?
যুক্তরাজ্যে বাঙালি রেস্টুরেন্টগুলো প্রথমদিকে বিভিন্ন বন্দর কেন্দ্রিক ছিল। বাংলাদেশি নাবিকদের হাত ধরেই একের পর এক সেগুলো গড়ে উঠতে শুরু করে। এখন যুক্তরাজ্যের ছোট বড় সব শহরেই রয়েছে বাঙালি রেস্টুরেন্ট। যার বেশির ভাগই লন্ডন ও এর আশপাশের শহরগুলোতে অবস্থিত। কিন্তু বাংলাদেশিদের এই বিশাল সাফল্য পরিচিতি পাচ্ছে ইন্ডিয়ান কুইজিন নামে। সেখানে খুব কম সংখ্যক মানুষের মুখে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টের কথা শোনা যায়। তারা মূলত ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট বলতেই পছন্দ করেন। আর এর কারণ হচ্ছে রেস্টুরেন্টগুলোর সাইনবোর্ডে বাংলাদেশি কুইজিন লিখতে এই বাংলাদেশিদের আপত্তি ও অনীহা।
আমি অনেকের কাছে এর কারণ জানতে চেয়েছি। যদিও তাদের কারও উত্তরে আমি খুশি হতে পারিনি। কেউ কেউ অকপটে বলেছেন, বাংলাদেশ হচ্ছে ঝড় বন্যা জলোচ্ছ্বাসের দেশ। এই সব কারণে ব্রিটিশরা বাংলাদেশ লেখা থাকলে রেস্টুরেন্টে আসতে চায় না। বরং তারা রেস্টুরেন্টগুলোতে ভারতীয় মোগল সম্রাটদের ছবি এবং কারুকাজ থাকাকে পছন্দ করে। বেশির ভাগ রেস্টুরেন্টে গেলে দেখা যাবে ভারতের তাজমহলের ছবি, যা ব্রিটিশদের আকৃষ্ট করে ব্যবসার প্রসার বাড়ানোর জন্যই। আর এই সব কারণে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট মালিকরা ভারতীয় নামকরণ থেকে আজও বেরিয়ে আসতে পারেননি।
আমি মনে করি ব্রিটেনে বাঙালিদের এই মন মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া দরকার। আমরা ব্রিটেনে আজ বাঙালিদের সাফল্য দেখে অনেক গর্ব করি। কিন্তু তাদের মধ্যে দেশাত্ববোধের প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। ব্রিটেনে আরও অসংখ্য এথনিক কমিউনিটি রয়েছে যেমন জাপানিজ, চাইনিজ, কোরিয়ান ইত্যাদি। তারা তাদের দেশকেই আগে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। তারা রেস্টুরেন্টের নামকরণ, সাজসজ্জা, কর্মচারীদের পোশাক, আচার আচরণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা তাদের নিজস্ব দেশাত্ববোধ ফুটিয়ে তোলে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশি রেস্টরেন্টের ক্ষেত্রে।
লেখক: সিইও এন্ড লিড কনসালট্যান্ট, গ্লোবাল গ্লোবাল স্টাডি কনসালটেন্সি
(লন্ডন অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখকের নিজস্ব মতামত)
টিকে
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।