ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪

‘ইয়াহিয়া বলেছিলেন ৩০ লাখ মানুষ মারবেন, বাকিরা ভিক্ষা খাবে’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:২৯, ২৬ মার্চ ২০২২ | আপডেট: ১৪:২১, ২৬ মার্চ ২০২২

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বাঙালির ওপর চালানো পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা যে পরিকল্পিত ছিল তার সপক্ষে তথ্যপ্রমাণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক।

জাতীয় প্রেস ক্লাবে শুক্রবার এক আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, সে সময় এক সামরিক নথিতে ‘গ্রেফতার’ এবং ‘নিরস্ত্র’ করার আদেশের আড়ালে নির্মম গণহত্যার আদেশ দেয়া হয়েছিল।

সম্প্রীতি বাংলাদেশ আয়োজিত আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজ্জাদ আলী জহির বলেন, “অপারেশন সার্চলাইট নির্মম গণহত্যার একটা ডকুমেন্ট। বিশ্বের ইতিহাসে মাত্র দুটো জেনোসাইডের ডকুমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে। একটা হলো ১৯৪৩ এর ওয়ানবির রেভুলেশন। ওয়ানবি একটা ছোট শহর বার্লিনের ৩৪ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে। সেখানে ডকুমন্টে রেডি করা হয়েছিল ফাইনাল অনস্লট অন জিউ কমিটিনিটি অব জার্মানি, ওদেরকে ধ্বংস করার জন্য। আর দুই নম্বর হচ্ছে অপারেশন সার্চলাইট। পাকিস্তানিরা যখন অপারেশন সার্চ লাইট করবে তার পরিকল্পনা কোথায় হয়েছিল? পরিকল্পনা হয়েছিল ১৭ জানুয়ারি, লারকানাতে। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, রাজনীতিবিদ ছিলেন, ভুট্টো সাহেব ছিলেন, ইয়াহিয়া খান ছিলেন, তিনজন ব্যুরোক্রেট ছিলেন। 

“সার্চলাইট সিমবোলিক্যালি কিভাবে হলো...আমি আমেরিকাতে একটি সেমিনারে বলেছিলাম, পাকিস্তান ইজ আ জেনোসাইডাল নেশন। সেখান কয়েকজন পাকিস্তানি অপোজ করে বলল, ইউ ক্যান নট অ্যবিউজ আ নেশন, আই সেইড ইয়েস আই হ্যাভ আ রাইট টু অ্যাবিউজ। তারা বলল বেসিস কী? অপারেশন সার্চলাইট? অপারেশন সার্চলাইটে দেখবেন আপনারা, কোথাও লেখা নাই কিছু, কোথাও লেখা নাই মানুষকে হত্যা করবে। তাহলে কেমন করে জাস্টিফাই করেন?” 

তিনি বলেন, “এখানে দুটো ওয়ার্ড আছে, একটা হচ্ছে অ্যারেস্ট, আরেকটা ওয়ার্ড হচ্ছে ডিজআর্ম। অ্যারেস্ট কাদের করছে, লেখাই আছে- আওয়ামী লীগ নেতা, কমিউনিস্ট নেতা, ছাত্রনেতা, সমাজে যারা পরিচিত, যারা পাকিস্তানের বিরোধী, তাদেরকে অ্যারেস্ট করো। অপারেশন সার্চলাইটে কাউকে অ্যারেস্ট করা হয়নি, বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া। প্রথম অ্যারেস্ট হলো লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। তাকে বাসা থেকে টেনে আনা হলো, বেঁধে জিপের পেছনে লাগিয়ে রমনা রেসকোর্স ময়দানে দুই চ্ক্কর দেয়ার পর উনি মাংসপিণ্ড হয়ে গেছিলেন।”

ওইদিন কাউকে নিরস্ত্রও করা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “ডিজআর্ম করার একটা মিলিটারি পলিসি আছে, বিউগল বাজাতে হবে, টেপ লাগাতে হবে, অ্যানাউন্স করতে হবে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে প্রথম আক্রমণ, প্রথমেই লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজ মোহাম্মদ খান তার ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট নিয়ে মেশিনগান দিয়ে গুলি শুরু করেছিল। সো, অপারেশন সার্চলাইটে কোনো ডিজআর্ম হয়নি। সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে, যেখানে প্রায় হাজারখানেক রিক্রুটকে মারা হয়েছিল, সেটাও ছিল একটা ব্যাপার। 

“...ইট ওয়াজ আ জেনোসাইডাল ডকুমেন্ট। ... ২৩ মার্চ দুইটা হেলিকপটার ঢাকা থেকে টেকঅফ করেছিল, একটার মধ্যে ছিল খাদিম হোসেন রাজা, আরেকটায় ছিল রাও ফরমান আলী। এরা প্রত্যেক ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে একটা সিলড এনভেলপ দিয়েছিলেন, এটিই ছিল সার্চলাইট এবং প্রত্যেকটা জায়গায় গিয়ে সিনিয়র মোস্ট পাঞ্জাবি অফিসার, নট পাঠান অর বেলুচি অফিসার, তার হাতে দিয়ে বলেছিল- ‘ফর অ্যারেস্ট (রিড কিল), ফর ডিজআর্ম (রিড কিল)’। এটা যদি আপনারা দেখেন, তাহলে বুঝবেন সবচেয়ে বড় গণহত্যা এখানে হয়ে গেছে।”

সে সময়কার তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে সাজ্জাদ আলী জহির বলেন, “২৬ মার্চ সকাল বেলা টিক্কা খান তার কমান্ড পোস্ট থেকে বের হয়ে আড়মোড়া দিয়ে বলেছিল- ঢাকা হ্যাজ নো পিপল, অনলি ফিউ স্ট্রেই ডগস আর ওয়াকিং অন দ্য রোড- সব শেষ করেছি, কুকুর বেঁচে আছে। ববি, ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার, সিলেকটেড, জাহানজেব আরবাব..যে ১৯ তারিখে জয়দেবপুরে হত্যাকাণ্ড চালাল, ববি হ্যাজ ইউজ এভরিথিং ইন হিজ হ্যান্ড। এভরিথিং অর্থ, সমস্ত অস্ত্র ব্যবহার করে ফেলেছে, টিক্কা সাকসেসফুল। 

“সেইদিন বিকাল সাড়ে ৫টার সময় ইয়াহিয়া খানের একটা স্টেটমেন্ট আছে- ‘আই উইল কিল থ্রি মিলিয়ন অব দেম, আমি তাদের ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করব, বাকিরা যারা থাকবে, তারা আমার হাতে ভিক্ষা খাবে, দে উইল ইট ফ্রম মাই পাম’। ১২ তারিখে সকাল বেলা, অফিসার্স কনফারেন্স, নিয়াজি টিক্কা খান থেকে টেকওভার করেছে। নিয়াজি চিৎকার করে বললেন- ‘ইয়ে হারামজাদে কওমকা মে সবক সিখাওংগা, উসকা নকশা ম্যায় বদল দুঙ্গা’।  হারামজাদা জাতি মানে বাস্টার্ড জাতি, অলরেডি আমরা কিন্তু এপ্রিলের ১২ তারিখে বাস্টার্ড হয়ে গেছি। নকশা পরিবর্তন হচ্ছে চেহারা পরিবর্তন, রক্ত পরিবর্তন। তখন সামনে ছিলেন একজন বাঙালি মেজর এ ওয়াই এম মুশতাক আহমেদ, তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, চিৎকার করে বললেন, ‘স্যার, ইউ ক্যান নট অ্যাবিউজ মাই পিপল লাইক দিজ, ইউ হ্যাভ টু উইথড্র ইউর ওয়ার্ডস’। 

মেজর মুশতাক আহমেদের পরিণতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “নিয়াজি ভীষণ রেগে গেলেন, হেঁটে চলে গেলেন। সবাই স্টান্ট হয়ে গেল। পরদিন সকালে ৬টার সময় তার (মেজর মুশতাক) মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, তার বাথরুমে, অফিসার্স মেসে। তার পরিবারকে বলা হয়েছিল সে আত্মহত্যা করেছে। ওর গলাটা কেটে ফেলা হয়েছিল। সে তখন শেভ করছিল, ১৩ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের তিনজন অফিসার এসে গলাটা ধরে ছুরি দিয়ে কেটে ফেলেছিল, এটাই পাকিস্তানের বিচার।”

পাকিস্তানকে যে আরো কয়েকটি গণহত্যা সংঘটিত করেছিল তার সপক্ষে তথ্য দিয়ে সাজ্জাদ আলী জহির বলেন, “প্রথম গণহত্যা বেলুচিস্তানে... এগজ্যাক্টলি সেইম অপারেশন সার্চলাইটের ট্রায়াল করেছে। দুই নম্বর গণহত্যা জর্ডানে। ১৯৪৮ সনের পরে আমাদের প্যালেস্টাইনি ভাইদেরকে ইসরাইলিরা এভিকশন শুরু করল, অনেকে পালিয়ে গেল লেবাননে, অনেকে ইরাকে, অনেকে ইজিপ্টে। বেশিরভাগ জর্ডান নদী অতিক্রম করে চলে এসেছিলেন জর্ডানের কাছে। সেখানে তারা রিফিউজি ক্যাম্পে ছিল। তারা একটা আন্দোলন শুরু করেছি অধিকারের জন্য, খাবারের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, চিকিৎসার অধিকার। 

“কিং হোসেন অব জর্ডান বললেন, ‘আই উইল নট গিভ ইউ এনি রাইট। তখন তারা আন্দোলন বেগবান করেছিল। জর্ডানের সৈন্য ব্যবহার করা হয় নাই। কারণ তারা মুসলিম, প্যালেস্টাইনিদের প্রতি সিমপ্যাথিটিক হবে। কিং হোসেন অব জর্ডান ডেকে আনলেন জেনারেল জিয়াউল হককে পাকিস্তানি, সেকেন্ড ট্রেনিং ডিভিশনের, বললেন ম্যাসাকার করো। জিয়াউল হক ম্যাসাকার করেছিল প্যালেস্টাইনিদেরকে। আমি তাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে গেছি এ ব্যপারে স্টাডি করার জন্য। তারা আমাকে বলেছে, তুমি জোরে কথা বলো না, এ দেশে কাউকে বলো না, কিং হোসেনের স্পাইরা তোমাকে মেরে ফেলবে। তারা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে ঘটনার কথা বলেছে, কিভাবে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে।”

ফিলিস্তিনিদেরকে কতটা নির্মমতার সাথে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী তা তুলে ধরতে গিয়ে পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী মঁশিয়ে দেয়ানের একটি বক্তব্য টেনে আনেন। 

“ইসরাইলি ডিফেন্স মিনিস্টার মঁশিয়ে দেয়ান বলেছিলেন, ২৬ বছরে আমরা প্যালেস্টাইনি মেরেছি সত্য কথা, কত মেরেছি হিসাব নাই। কিন্তু এটা হিসাব আছে ২৬ দিনে পাকিস্তানের জেনারেল জিয়াউল হক তার থেকে বেশি প্যালেস্টাইনি হত্যা করেছে। এটাই পাকিস্তান, চিনতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের সঠিকভাবে চিনতে পেরেছিলেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “(বঙ্গবন্ধু) ৭ মার্চের ভাষণ কেন দিয়েছিলেন, সুযোগ হয়েছিল একবার জিজ্ঞেস করার- ‘বঙ্গবন্ধু চক্রান্ত সব জেনে ফেলেছিলেন? বলেন, তুই জেনেছিলি কিছু?’ তাদের আর্মিতে ছিলাম, কিছু জেনে ফেলছিলাম। তখন তিনি আস্তে করে বলেছিলেন, ‘নেতা যখন, মানুষকে বাঁচাতে হবে না, মানুষকে জানাতে হবে না?”

সাজ্জাদ আলী জহির ২৫ মার্চের গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। 

সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য সচিব মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের সঞ্চালনায় এবং আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভপতিত্বে আলোচনা অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য ও শহীদ পরিবারের সদস্য আরমা দত্ত, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক কর্নেল (অব.) তৌফিকুর রহমান এবং শহীদ সন্তান নট কিশোর আদিত্য।
এএইচএস/
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি