ই-সিগারেট ও ভেপিং স্মার্টনেস নাকি সুইসাইড?
প্রকাশিত : ২১:০২, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | আপডেট: ২১:০২, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
নিঃশব্দে তারুণ্যের শক্তি ও সম্ভাবনাকে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে ভেপিং বা ই-সিগারেট। বাঁচতে হলে প্রয়োজন সম্মিলিত সচেতনতা ও উদ্যোগ।
কী এই ভেপিং?
ই-সিগারেট বা ভেপিং হলো ধূমপানের আধুনিক সংস্করণ। ‘ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম’ বা ‘ইলেকট্রনিক সিগারেট’ ব্যাটারিচালিত একটি ডিভাইস বা যন্ত্র। ইউএসবি পোর্টে লাগিয়ে এতে চার্জও দেয়া যায়। সিগারেটের পোড়া তামাকের পরিবর্তে ই-সিগারেটের একটি চেম্বারে থাকে লিকুইড নিকোটিন ও আসক্তিকর নানা উপাদান। যন্ত্রটি গরম হয়ে এই তরলকে ধোঁয়ায় পরিণত করে এবং ব্যবহারকারী সেই ধোঁয়া টেনে নেয় ফুসফুসে, যা মস্তিষ্কে ধূমপানের মতো অনুভূতির সৃষ্টি করে। এই পদ্ধতিকে বলে ‘ভেপিং’।
ভেপিংয়ের রকমফের
আকর্ষণীয় মোড়কে সাজিয়ে এবং বিভিন্ন ধরনের ফ্লেভার যুক্ত করে বিক্রি করা হয় এই নেশাদ্রব্য। কখনো ভেপিং ডিভাইসটি দেখতে কলমের মতো, কখনো পেনড্রাইভ, কখনো লিপস্টিক, কখনো লাইটার, কখনো-বা পারফিউমের ছোট শিশির মতো। আকার ভেদে নামেও আছে বৈচিত্র্য : ভেপ পেন, মোড, ই-হুকা, সাব-ওহ্ম, ট্যাংক সিস্টেম, জুল ইত্যাদি।
দেখতে যেমন বহুরূপী, তেমনি এ থেকে নির্গত ধোঁয়ার গন্ধও হতে পারে বহুরকম। পুদিনা পাতা, ভ্যানিলা, স্ট্রবেরি, আম, কলা, লেবু, আঙুর, আনারস, বাদাম, চকোলেট, কফি, দারুচিনি, মধু, শসা, অ্যালোভেরা—কী নেই এর ফ্লেভারের তালিকায়! ফলে সহজে বুঝে ওঠা যায় না যে, ধূমপানের মতো ক্ষতিকর অভ্যাস কেউ দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে।
এই সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে তামাক, সিগারেট ও নেশার কারবারিরা। আধুনিকতার প্রলেপ লাগিয়ে কিশোর-তরুণদের ধূমপানের প্রতি আকৃষ্ট করছে। আবার মা-বাবা অভিভাবকদের চোখ এড়িয়ে তারা যেন নেশার জগতে বিচরণ করতে পারে, সেই ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে নিকোটিনে ফ্লেভার বা সুগন্ধী যোগ করে। স্বাভাবিকভাবেই এরকম একেকটি জীবনঘাতী বিজনেস আইডিয়ার ফাঁদে নিজের অজান্তেই পা দিচ্ছে মানুষ।
আরো বেশি বিপজ্জনক
জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও কার্ডিওলজিস্ট ডা. মাইকেল জোসেফ ব্লাহা-র মতে, সিগারেট এবং ই-সিগারেট দুটোরই মূল উপাদান হলো নিকোটিন যা কখনো কখনো হতে পারে হেরোইন ও কোকেনের মতোই আসক্তিকর।
সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, ই-সিগারেট সেবন করার মধ্য দিয়ে মানুষ সাধারণ সিগারেটের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি নিকোটিন গ্রহণ করে। কারণ অধিকাংশ ধূমপায়ী ই-সিগারেটে এক্সট্রা স্ট্রেংথ কার্টিজ যুক্ত করে নেয় যাতে নিকোটিনের ঘনত্ব ও পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি থাকে। শুধু তা-ই নয়, ভেপিংয়ে আসক্তরা ধোঁয়ার উত্তাপ বাড়াতে ই-সিগারেটের ভোল্টেজ বাড়িয়ে নেয়, যা ফুসফুসের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এক প্যাকেট সিগারেটে নিকোটিনের পরিমাণ ৪৮ মিলিগ্রাম। আর ই-সিগারেটের একটি পডে থাকে দুই প্যাকেট সিগারেটের সমান নিকোটিন! জাপানে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ই-সিগারেট সাধারণ সিগারেটের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ক্ষতিকারক।
দেহ-মনে এর প্রভাব ভয়ংকর
হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিংয়ের সিনিয়র এডিটর রবার্ট এইচ শ্মারলিং বলেন, ই-সিগারেটে ডায়াসিটাইল নামক একটি রাসায়নিক থাকে, যা ফুসফুসের বায়ুথলিগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। Popcorn lung (Bronchiolities Obliterans) রোগে আক্রান্ত হয় ধূমপায়ীরা। ফলে দেখা দেয় খুকখুক কাশি, বুকে ঘড়ঘড় শব্দ ও শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ।
ই-সিগারেটে ব্যবহৃত গ্লিসারল ও প্রোপাইলিনের ধোঁয়া শ্বাসনালীর নিজস্ব সুরক্ষা ব্যবস্থাকে চিরতরে নষ্ট করে দেয়। এ-ছাড়াও ই-জুসে থাকে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের ক্ষুদ্র কণা, ভারী ধাতব কণা যা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করে, বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি।
দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, ই-সিগারেটে আছে জীবাণুনাশক ফরমালডিহাইড, যেটি ক্যান্সার তৈরির উপাদান।
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ একটি গবেষণা রিপোর্টে বলে, যারা ই-সিগারেট সেবন করে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা দেয়। বিষণ্নতার অনুভূতি উসকে দিতেও এর ভূমিকা বেশ জোরালো।
লক্ষ্য যখন শিশু-কিশোররা
যুক্তরাষ্ট্রের দ্য সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে হাইস্কুল পড়ুয়া ১৪.১% মার্কিন শিক্ষার্থী ই-সিগারেট বা ভেপিংয়ে আসক্ত। অর্থাৎ প্রতি পাঁচ জনে একজন ই-সিগারেটে আসক্ত।
শুধু ইউরোপ-আমেরিকা নয়, আমাদের দেশেও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ভেপিংয়ের প্রবণতা বাড়ছে। ঢাকাসহ বড় বড় শহর, গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে গেছে এই বিষ। ব্যবসায়ীরা জানায়, মূলত ১৪ থেকে ১৫ বছরের কিশোররাই ই-সিগারেটের ক্রেতা।
গত এক দশকে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো ই-সিগারেটে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। ভেপিং সেবন স্মার্টনেস, এটি কম ক্ষতিকর বা তামাকমুক্ত—এ ধরনের ভ্রান্ত প্রচারণায় খুব দ্রæত ছড়িয়ে পড়ছে এটি, যা মূলত তরুণদের মাদকাসক্ত করার আধুনিক কৌশল।
নিঃশব্দে তারুণ্যের শক্তি ও সম্ভাবনাকে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে ভেপিং বা ই-সিগারেট। বাঁচতে হলে প্রয়োজন সম্মিলিত সচেতনতা ও উদ্যোগ।
তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান, ১৫ আগস্ট ২০২৩, হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিং, ১৫ জুন ২০২৩ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, ২ মে ২০২২জন্স হপকিন্স মেডিসিন, ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে