ঢাকা, সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

ঈদেও নেই নান্নুদের মুখে হাসি

আজাদুল ইসলাম আদনান 

প্রকাশিত : ১৭:২১, ১ আগস্ট ২০২০

Ekushey Television Ltd.

নান্নু সরদার (৪০)। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে নদীতে মাছ ধরেই বড় হয়েছেন। জন্মও এই ভাসমান নৌকায়। নিজে বিয়ে করেছেন এই নৌকাতেও, এক সন্তানকেও বিয়ে দিয়েছেন ভাসমান এই ঠিকানায়। 

বাকি সন্তান ও মেয়ে-জামাই নিয়ে এখনও নৌকাতে বাস করছেন। জীবন বলতে দু’বেলা ভালভাবে খেতে পাড়ার লড়াইটাই বুঝেন তিনি। তাইতো চারদিকে ঈদের আনন্দ বইলেও তার ছিটে ফোঁটা প্রভাব পড়েনি নান্নুর জীবনে। 

তবে শুধু যে নান্নু, তা কিন্তু নয়। তার মতো ভাসমান এখানকার আরও অন্তত ৬০টি পরিবারেই ছোঁয়া লাগেনি ঈদের আনন্দ। অভাবের কষাঘাতে ঢেকে গেছে তাদের হাজারো স্বপ্ন আর আনন্দগুলো। 

দুই ছেলে আর এক মেয়ের বাবা নান্নু থাকেন বরিশালের বাবুগঞ্জ-বিমানবন্দর থানা দিয়ে বয়ে চলা সুগন্ধা নদীতে। বাবা ছিলেন জেলে, সেই সুবাদে জন্মের পর থেকেই লড়াই করেছেন নদীর বিশাল স্রোতের সাথে। বাবা মারা যাওয়ার পর হাল ধরেছেন নিজেই। চাইলে অন্য পেশায় যেতে পারতেন কিন্তু, বাবার হাত ধরে শেখানো জেলে পেশা আর অভাবের তাড়নায় শেষ আশ্রয়টুকু তথা মাথা গোঁজার মতো এক টুকরো জমি না থাকায় পারেননি। 

অভাবের কারণে নিজের পাশাপাশি স্ত্রী-সন্তানদের জন্য কিনতে পারেননি ঈদে নতুন জামা। মাথা গোঁজার ঠাইটুকু যাদের নেই তাদের আবার কিসের ঈদ? অব্যক্ত কণ্ঠে তাই এমন কথা বলছিলেন নান্নু। 

অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে নান্নু বলেন, ‘আমরা এতটাই দুর্ভাগা যে, নিজের থাকার মতো জায়গাটুকুও নেই। ঈদে ছেলে-মেয়েদের জামা-কাপড়ও কিনে দিতে পারিনি। কোরবানির মাংস জুটবে কোথা থেকে? দাদনের টাকা আনার চেষ্টা করছি, যদি পারি তাহলে মাংস আনতে পারবো। আপাতত ডাল-ভাতেই ভরসা।’

নান্নু সরদারের মতো অনেক ভাসমান জেলে রয়েছে, যাদের করোরই নেই ঘরবাড়ি, নেই স্থায়ী ঠিকানা। সারাদিন জাল বেয়ে যে মাছ পান, তা বিক্রি করেই পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেন কোনোমতে। ঠিকানা হারা এসব মানুষের কোরবানি দেয়া তো দূরের কথা, মাংস কেনার মতোও সামর্থ্যটুকু নেই। 

নান্নু সরদার বলেন, ‘নদীতে আর আগের মতো মাছ পাইনা। আবার মৎস্য প্রজননের সময় মাছ ধরা নিষেধ করলে, সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে যাই। সরকারিভাবে কিছু সহযোগিতা করা হলেও, চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম। এছাড়া, বছরের অন্যান্য সময় কখনো সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় না।’

তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর আগে, কয়েক শতক জমির জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেছিলাম। অনেক কষ্টে কিছু টাকাও জোগার করে দিয়েছিলাম কিন্তু জমি পাইনি। তাই, মারা গেলে লাশটা যে কোথায় দাফন হবে, তাও জানি না।’

বাবুগঞ্জ থানার কেদারপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ভূতেরদিয়া খেয়াঘাটের কাছে গিয়ে দেখা যায়, ঠিকানাহীন নান্নুর মতো আরও বেশ কিছু ভাসমান নৌকা। যারা পরিবার নিয়ে অসহায় জীবনযাপন করছেন, যাদের মাঝে নেই কোন ঈদের আমেজ। অনেকের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ।

নান্নু বলেন, ‘আগে প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার টাকার মাছ বিক্রি করতে পারতাম। পরিবারের মুখে দু’বেলা অনেকটা ভালভাবেই আহার তুলে দিতে পারতাম। কিন্তু, বর্তমানে অবস্থা একেবারেই খারাপ। নদীতে মাছ কমে যাওয়ায় আয় অর্ধেকে নেমেছে। এমতাবস্থায় ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুবই বিপাকে পড়েছি। তারপরও পেশা ছাড়তে পারছি না।’

পাশেই নৌকার মধ্যে দেখা গেল কয়েকজন নারী রান্না-বান্না করছেন। কেউ আবার জাল বুনছেন। ঈদের দিন হলেও ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের পরনে নেই নতুন জামা।

সামনে গিয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল, ‘বন্যা, ঝড়-জ্বলোচ্ছ্বাস তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করেই বছরের পর বছর তারা ভাসমান জীবন পার করছেন। তবে, ঝড়ের সময় সবচেয়ে কষ্ট ভোগ করতে হয় তাদের। এ সময় কোথাও যাওয়ার নেই, গাছের আড়ালে কিংবা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থান বেছে নিয়ে জীবন বাঁচাতে হয়।’

নান্নু সরদারের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে কয়েকজন জেলে বলেন, ‘আমাদের নেই কোন এমপি, মন্ত্রী। ভোটের সময় আমাদের প্রয়োজন হলেও কোন ধরনের সুযোগ সুবিধা পাই না। টিভিতে খবর দেখি সরকার অনেক কিছু করছে, ভূমিহীনদের ঘরবাড়ি করে দিচ্ছে কিন্তু আমরা এসব কিছু থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। মাথার গোঁজার ঠাইটুকু হলেও শান্তিতে বেঁচে থাকতে পারতাম।’

এমবি//


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি