ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

ঈশ্বরই চির সুন্দরের সমঝদার

বাপ্পী রহমান 

প্রকাশিত : ১১:২৩, ২৮ অক্টোবর ২০২০ | আপডেট: ১১:২৪, ২৮ অক্টোবর ২০২০

লেখক: বাপ্পী রহমান 

লেখক: বাপ্পী রহমান 

১. জীবনের অপ্রতিরোধ্য সত্য হলো মোহাবিষ্ট হওয়া। এই ধরুন, আমার শৈশব মোহাবিষ্ট হয়েছিল সরষে ফুলে। সরষে খেতের হলুদ রং আকাশে মিশে যেত আর কচি সরষে ফুল দুলতো উত্তরের মিষ্টি হাওয়ায়। আমার চোখ জুড়ে যেত শ্রান্তিতে। আবার তুমুল তারুন্যে মোহাবিষ্ট হয়েছিলাম ‘অন্তরাত্মা’প্রপঞ্চ নিয়ে। অবশ্য এর পেছনে একটা ছোট গল্পও আছে। সে গল্পে পরে আসছি।  তবে এখন পরিণত বয়সে এসে মনে হচ্ছে আমি ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত। আর এই অসামান্য তৃষ্ণার জালে বন্দি থাকার চেয়ে ঢের ভালো ছনের ছাউনির শীতল একটি ঘর। মাটি দিয়ে লেপানো কাশের বেড়া, লাউ-শিমের জাংলায় ছোট ছোট পাখির ওড়াউড়ি, পুকুরে পানার দাড়ির সঙ্গে কৈ মাছ, ঢেঁকির ঢুকঢুক শব্দ। ঘরের পাশে থাকবে কবরী কলা গাছ। কবরী কলা দিয়ে খাবো দুধভাত। নদী দিয়ে ভাটি উজানে নাও যাবে। আর মাঝ দুপুরে আমার সাথে কথা হবে অচেনা শালিকের। 

২. বলেছিলাম ‘অন্তরাত্মা’নিয়ে একটা গল্প আছে। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের হাল ধরেছিলেন। ২০০৪ সালে কংগ্রেস সরকার গঠন করার পর সংসদীয় দলের প্রধান হিসেবে সোনিয়া গান্ধীরই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু দলের ভেতরে ও বাইরে বিরোধিতার মুখোমুখি হন তিনি। এমনকি কংগ্রেস কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরাও প্রশ্ন করেন, একজন বিদেশিনি কীভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন? মিডিয়ার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি আমার অন্তরাত্মা (Inner Voice) সাড়া দেয় তাহলে প্রধানমন্ত্রীত্ব নিব’। তাঁর অন্তরাত্মার সাড়া দেয়নি। বর্জন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পদ। পরে জেনেছি, গল্পের অন্য দিক আসলে ছিল ‘সুন্দরের মাঝে অসুন্দরের খেলা’। সোনিয়া গান্ধী নাকি ছেলে রাহুল গান্ধীর আপত্তিতে সরে দাঁড়িয়েছিলেন৷ তাঁর জায়গায় ড. মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী করেন৷ প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নটবর সিং কংগ্রেস এবং মনমোহন সিং-এর কংগ্রেস-জোট মন্ত্রিসভা থেকে বিতাড়িত হবার আট বছর পর ‘ওয়ান লাইফ ইজ নট এনাফ (২০১৪)’ নামক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে এই ফিরিস্তি দিয়েছেন। বিভ্রান্ত হয়েছি কিন্তু মোহভঙ্গ হয়নি!

৩. তবে পাশাপাশি এও সত্য-মেঘের ওপারে যে অভিমানী চাঁদের বাস তার অবয়ব অদ্ভুত সুন্দর। মেঘের ওপারের গল্পও সুন্দর। আজ জেনেছি, ভার্সাইতে থাকাকালীন সময়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে নিদারুন অর্থকষ্টে পড়েছিলেন অমিতব্যায়ী স্বভাবের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। দেশ থেকে যাদের টাকা পাঠানোর কথা ছিল, তারা কেউ কথা রাখেননি। আর কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে মাইকেল চিঠি লিখলেন তাঁর বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। বলে রাখা ভালো, মাইকেল-বিদ্যাসাগরের শুরুটা হয়েছিল তীব্র সমালোচনা আর অভিমান নিয়ে। মাইকেলের ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ গ্রন্থের সমালোচনা করেছিলেন বিদ্যাসাগর। অবশ্য পরে তিনি ঐ গ্রন্থে “গ্রেট মেরিট” খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই শুরুতে মাইকেল বেশ ক্ষুন্ন হলেও অচিরেই অভিমানের প্রাচীর ভেঙে বন্ধুতার স্পর্শ পায় তাঁদের সম্পর্কে। সে যা হোক, পর পর তিনটি চিঠি… চিঠিগুলো পাওয়ার পর বিদ্যাসাগর তৎক্ষণাৎ অর্থ সাহায্য পাঠালেন। অবশ্য দেশে ফিরেও মাইকেলের অমিতব্যায়ী স্বভাবে বিন্দুমাত্র ছেদ পড়ল না। বন্ধু-আড্ডায়, পান-ভোজনে দেদার অর্থ ব্যয়ে পিছপা হতেন না মোটেও। অন্যদিকে, মানুষের দুর্দশায় পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাস বিপদে ফেলে বিদ্যাসাগরকে। ফলত ক্রমশই দেনায় ডুবে গেলেন তিনি। নিতান্তই নিরুপায় হয়ে তিনি মাইকেলকে দুর্বিষহ অবস্থার কথা জানিয়ে চিঠি লিখেন এবং দায়মুক্তির অনুরোধ জানান। বোহেমিয়ান জীবন যাপনে অভ্যস্থ হলেও শেষতক নিজের দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন মাইকেল। নিজের সবটুকু বেচে দিয়ে বিদ্যাসাগরকে দায়মুক্ত করেন। 

৪. ধ্রুব সত্য হচ্ছে-সময় প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। আবার এও সত্য যে এসব পরিবর্তন কিছু দৃশ্যমান, অধিকাংশই অধরা। সময় আবর্তের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে হতে নিজেকে বারবার যেমন অতীত প্রমাণিত করে, একইভাবে সময় চিহ্ন রেখে যায়। আর তাই যাপিত জীবনে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটে। কে জানে, হয়তো চারপাশে ঘটে চলা এমন ঘটনাগুলোই সত্যিকারের গল্প কিংবা মিথ্যা গল্প! তবে এসব আপনার-আমার গল্প, রাজা-রানীর গল্প, সুন্দর-অসুন্দরের গল্প! হোক গল্প কিংবা সত্য, পৃথিবী অবিশ্বাস্য সুন্দর। আর কেবল ঈশ্বরই সেই চির সুন্দরের সমঝদার! 

তথ্য তালাশ
১. Natwar-Singh, K. (2014). One Life is Not Enough: An Autobiography. New Delhi: Rupa Publications.
২. রায়, অ. ও ভট্টাচার্য, অ. (২০২০) । মাইকেল বিদ্যাসাগর সংবাদ। কলকাতাঃ এসভিএফ।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি