উচ্চশিক্ষায় সংখ্যাগত বিস্তার ও শিক্ষার মান
প্রকাশিত : ১৮:০১, ৩ মে ২০১৮
একটি জাতির উন্নতির জন্য শিক্ষার প্রসার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ গত ছেচল্লিশ বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতিসাধন করেছে। পাশের হার শত ভাগের কাছাকাছি পৌঁছেছে। ছাত্র ও ছাত্রীর অনুপাত সমান বা অনেকক্ষেত্রে ছাত্রীদের অনুপাত ছাত্রদের চেয়ে বেশী। মানুষ এখন পড়ালেখার ব্যাপারে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে শিক্ষার গুরুত্ব আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশী। পাশের সংখ্যা বা হারের দিক বিবেচনায় আমরা অনেক এগিয়েছি। এগুলো সবই ইতিবাচক দিক। যাইহোক, এবার একটু ভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক।
শিক্ষার প্রসার বলতে কী সংখ্যাগত পরিবর্তন বুঝায় নাকি এখানে শিক্ষার মানও গুরুত্ববহ সেটি ভাবার সময় এসেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সংখ্যাগত দিক দিয়ে আমরা যতটা এগিয়েছি মানের ক্ষেত্রে কি ততটা এগিয়েছি ? এখন অনেকের মুখেই বলতে শুনা যায় আগের পড়ালেখটাই ভাল ছিল, এখন পড়ালেখার মান কমেছে। সাধারণের মধ্যে একটা ধারণা প্রতিষ্টিত হচ্ছে যে এখন পড়ালেখার মান আগের চেয়ে খারাপ। পাশের হার এবং ফলাফলকে মনোযোগ দিতে গিয়ে আমরা কি তাহলে মানকে জলাঞ্জলি দিচ্ছি?
শিক্ষার শুধুমাত্র সংখ্যাগত বা হারের বৃদ্ধি শিক্ষা অর্জনের মূল লক্ষ্যের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, শিক্ষার মূল উদ্দ্যেশ্য হল যৌক্তিক ও বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরী যারা একাডেমিক জ্ঞানকে সমাজের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারবে। শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়নের ফলেই তা সম্ভব। শিক্ষার হার যেভাবে চোখে দেখা যায় মান সেভাবে দেখা যায় না। এজন্য, শিক্ষার মান কতটুকু অর্জিত হচ্ছে তা সরলভাবে বলা যায় না। তবে, কিছু বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিলে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। শিক্ষার্থীর একাডেমিক জ্ঞান, অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগের ক্ষমতা ও দক্ষতা সর্বোপরি, শিক্ষার্থীর নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষমতার দ্বারা তার লব্দজ্ঞানের লেভেল সম্মন্ধে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় সংখ্যার দিক দিয়ে শিক্ষার্থীর প্রধান আশ্রয়স্থল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে যার সংখ্যা প্রায় একুশ লক্ষ। এখানকার শিক্ষার্থীরা সংখ্যার দিক থেকে যতটা উপর দিককার মানের দিক থেকে ঠিক তার উল্টো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পাওয়া, প্রাইভেটে ভর্তির সামর্থ না রাখা শেষের সারির শিক্ষার্থীরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় অনার্স অথবা ডিগ্রী (পাস) সার্টিফিকেট কোর্সে। অনেক শিক্ষার্থী শুধুমাত্র নিজের ছাত্র পরিচয় বজায় রাখতে এখানে ভর্তি হয়। সিংহভাগ শিক্ষার্থীকে পার্টটাইম স্টুডেন্ট বলা যায় যারা শুধুমাত্র পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এদেরকে স্টুডেন্ট না বলে `পরীক্ষার্থী` বললে বেশী মানানসই হবে। এমতাবস্থায়, শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে ঠেকে তা ন্যূনতম ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রেরই বুঝার কথা।
লক্ষ লক্ষ `পার্টটাইম স্টুডেন্টদের` উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট প্রদান দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্যের বহিঃপ্রকাশ বৈ কিছু নয়। অথচ, অবস্থাদৃষ্টে আমরা সেদিকেই এগুচ্ছি। ফলে, সংখ্যায় সার্টিফিকেটধারী লক্ষ লক্ষ হলেও `প্রকৃত` গ্রাজুয়েটের সংখ্যা হাতেগোণা। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমাদের গ্রাজুয়েটদের তুলনা করলে পার্থক্যটা স্পষ্ট হবে। সুতরাং, এটা বললে অনৈতিক হবে না যে দীর্ঘমেয়াদে সমাজে একটা শ্রেণী তৈরী হচ্ছে যারা নিজেদের জ্ঞানী/বিদ্বান মনে করছে (সার্টিফিকেট থাকার কারণে) কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা তা নয়।
উচ্চশিক্ষাই যেখানে সকলের জন্য জরুরী নয় সেখানে উচ্চশিক্ষায় সার্টিফিকেটের অবাদ প্রবাহ (মানের প্রতি কম গুরুত্বের ফলে) আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে, তাই নয় কি?
লেখকদ্বয় :
প্রভাষক, সুনামগঞ্জ সরকারী কলেজ, সিলেট ও
প্রভাষক, গ্রিন বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।