ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ নভেম্বর ২০২৪

‘উত্তমের ফুলশয্যর সময় ট্রাঙ্কের পেছনে লুকিয়েছিলাম’    

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২২:৩৩, ২৪ জুলাই ২০১৮ | আপডেট: ২২:৩৮, ২৪ জুলাই ২০১৮

আমি ওকে উত্তম বলেই জানি। ওর ভাদ্রে জন্ম। আমার আষাঢ়ে। আগে ছিলাম ওর মাসির মেয়ে আর পরে হলাম ওর জ্যাঠতুতো ভাইয়ের বউ। মানে ওর বৌদি। কথায় কথায় টক্কর ঠাট্টা! ও আমায় আহিরিটোলার লোক বলে আওয়াজ দিলেই আমি ওকে ভবানীপুর বলে খেপাতাম! আমি হয়তো বাড়ির কাজে ব্যস্ত, ও এসেই বলে উঠল, ‘নাম রেখেছি বনলতা...’, আমি তৎক্ষণাৎ বলতাম, ‘যে নামেই ডাক তুমি...’।

আমার বিয়ের দু`বছর পর, ১৯৪৮-এ উত্তমের বিয়ে। আমার দশ মাসের বাচ্চা, তাকে এক পিসিশাশুড়ির কাছে রেখে, আর এক ননদকে নিয়ে আমি উত্তমের ফুলশয্যায় আড়ি পাততে গেলাম। উফ! সে কী উৎসাহ আমার। পিসিশাশুড়িকে বলে এসেছিলাম, বাচ্চা কাঁদলেও না ডাকতে। ঘরে চুপটি করে ট্রাঙ্কের পেছনে লুকিয়ে রইলাম। আরে, উত্তমের ফুলশয্যা বলে কথা! দশ বছর বয়স থেকে আমরা একে অপরকে চিনি।    

        বৌদিদের সঙ্গে দেওর উত্তম। বাঁ দিকে রয়েছেন বসুমতী চট্টোপাধ্যায়।

কিন্তু উৎসাহে জল ঢালল ওই বাড়ির এক জন! ট্রাঙ্কের সামনে ধড়াম করে জলের গ্লাস রেখে উত্তমকে ইশারা করতেই ও বুঝে গেল ট্রাঙ্কের পেছনে গন্ডগোল আছে! আমাদের দেখে বলল, ‘‘ওহ, তোমরা পারো! আমার ফুলশয্যা দেখবে তো? বেশ আজ আমি জানলা-দরজা সব খুলে রাখছি। ট্রাঙ্কের পেছনে যাওয়ার কী দরকার? বারান্দা থেকে দেখো সব্বাই!’’ এই ছিল উত্তম।

তবে এত উত্তম, উত্তম করছি, একটা কথা বলি। এই উত্তম নামটা অনেকেই ভাবেন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের পর দেওয়া। তা কিন্তু নয়।  

উত্তমের মায়ের নাম ছিল চপলা। উত্তম যখন জন্মেছিল ওর দাদামশাই তখন ওর মাকে বলেছিলেন, ‘বাহ্ চপি, এ তো উত্তম খবর!’ সেই থেকে ওর নাম হয় উত্তম। আর ভাল নাম অরুণ।

আমাদের সকলের জীবনে, পরিবারে ও আলো হয়েই এসেছিল। এই শ্রাবণ মাস এলেই বুকটা বড্ড চিন চিন করে। অমন দিলদরিয়া মানুষ! কিন্তু...

একটু সামলে নিয়ে আবার শুরু হল স্মৃতির সঙ্গে বাক বিনিময়...  

আমি গুছিয়ে সংসার করতাম। আমার শ্বশুরবাড়িতে লোকজন আসা লেগেই থাকত। কলাপাতার এঁটো নিজে হাতে কুড়োচ্ছি দেখে উত্তমও দেখি হাত লাগাত। কত রকমের কাজ যে ও করতে পারত। আদপে ছিল শিল্পী। বাড়িতে রাশ হবে। উত্তম শোলার পুতুল সাজাতো। মাটির কুঁজোয় চালগুঁড়ো দিয়ে আলপনা দিত। যে কোনও পারিবারিক উৎসবে ও যে কী আনন্দের সঙ্গে যোগদান করত...

দোলের দিন উত্তম বেরিয়ে পড়ত লরি নিয়ে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে নিজে গলা ছেড়ে গান গাইত। শুটিংয়ের ফাঁকে ছুটি পেয়েছে তো সব্বাইকে গাড়িতে তুলে পিকনিকে যাওয়া হত। উত্তম খুশি নিয়ে নিতে পারতো মনভোলানো হাসি দিয়ে। লোকজন, আড্ডা, খাওয়া, গান গিরীশ মুখার্জি রোডের ওই বাড়িটা একটা মানুষের জন্য গমগম করত।

এক দিন বাড়িতে রান্না করছি হয়তো। উত্তম এসে বলল, ‘‘বউদি, আমার গেস্ট এসেছে। একটু কথা বলবে এসো।’’ এটা আমার কাছে নতুন কিছু ছিল না। আমরা তো পাশাপাশি থাকতাম। ও বাড়িতে কেউ এলেই ও আমায় ডাক দিত। আমি খুব কথা বলতে পারতাম যে। আর গৌরী একটু চুপচাপ ধরনের ছিল। তো যাই হোক, গিয়ে দেখি ওমা, সুচিত্রা সেন আর ওর মেয়ে মুনমুন! একটা মজার জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম সে দিন। আশা করি এখানে বললে কেউ আমায় তেড়ে আসবে না। অমন রূপবতী, ব্যক্তিত্বময়ী সুচিত্রা। সে দিন দেখলাম চমৎকার শাড়ির একটু ছেঁড়া। পিনের খোঁচার মতো। হয়তো খেয়াল করেনি। তবে সুচিত্রা ওই বাড়িতে খুব যে আসতে পারত এমন নয়। গৌতমের পাঁচ বছরের জন্মদিনে আর উত্তমের বাবার মৃত্যুদিনে এসেছিল। সে দিন অনেক ক্ষণ ছিল। তখন তো ওদের ‘সপ্তপদী’-র শুট চলছে। আর যে বার এসেছিল সে বার তো উত্তম নিজেই নেই! উফ! কী দিন...সেই চব্বিশে জুলাই।  

পরিবার নিয়ে থাকতে ভালবাসত উত্তম। পরিবারে জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো কোনও ভাই অসুস্থ কানে এলেই তার চিকিৎসার ব্যবস্থা, খরচ, সব কিছুর দায়িত্ব ও নিত। কাউকে মুখ ফুটে চাইতেও হয়নি। আমাদের পরিবারে বিয়ের কথা শুনলেই ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। অন্য দিকে, পরিবারের কোনও মানুষের থেকে এতটুকু সাহায্য পেলে আজীবন সকলের সামনে সেটা স্বীকার করে গেছে।  

প্রথম দিকের কথা, উত্তমের কোনও একটা ছবিতে ঘোড়া চড়তে হবে। উত্তম ঘোড়া চড়তে জানে না। তখন ওর হাতে টাকা ছিল না। আমার দেওর ওকে একশো টাকা দেয়। সেই ঘটনা ‘নায়ক’-এর জন্য ভেনিস থেকে অ্যাওয়ার্ড নিয়ে ফিরেও সকলকে বলেছিল। এইটুকু তো ঘটনা! ক’জন বলে? শুধু কি তাই? উত্তমকুমার মহানায়ক হওয়ার পরেও সকলকে বলত, ‘‘আমি সকলের সাহায্য পেয়েছি বলে এ ভাবে অভিনয় করেছি। আমার পরিবারেই এমন কেউ আছে যে আমার মতো সাহায্য পেলে উত্তমকুমার হতে পারত।’’ আজকের যুগে ক’জন অভিনেতা এমন বলতে পারবেন?

অথচ নিজে যখন ‘ছোটিসি মুলাকাত’ করে আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হল? জানি, সেই সময়টা খুব খারাপ গেছে ওর জীবনে। বলতে দ্বিধা নেই, তখন সুপ্রিয়া ওর পাশে দাঁড়িয়েছিল। পরে যা-ই হয়ে থাক, সুপ্রিয়া ওকে ভালবাসত। ঝগড়াও হয়েছে ওদের।

সিনেমা জগতের মহানায়ক, কিন্তু তাই বলে আমরা পরিবারের কেউ যখন-তখন ওর শুটিং দেখতে চলে যাব, এমনটাও ছিল না। বাড়িতে ফিল্ম নিয়ে আলোচনা বা হামবড়াই, এ সব ওর স্বভাবেই ছিল না। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে বসুশ্রীতে প্রিমিয়ারে যাওয়ার নেমন্তন্ন পেতাম। কিন্তু...

কী বলতে চাইছেন তিনি?

ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তাঁর।

মানুষটা এত করেছে পরিবারের সকলের জন্য। মানুষটাকে নিজের ঘরে কেউ রাখতে পারল না? ফিরিয়ে আনতে পারল না? জানেন এমন মানুষ কেন?

লোকে ওকে পুজো করেছে। ভালবেসেছে। কত মানুষের মনের মানুষ ও আজও! কিন্তু ওর মনের মানুষ ও পায়নি। আজীবন খুঁজেছে। বাড়ি ছেড়ে লোকটা বেরিয়ে গেল। কেউ আটকালো না! কেউ ওকে আনতে গেলে আমি জানি ও নিশ্চয় ফিরে আসত।

কই হল সে সব?

বড় হয়ে ওঠার প্রত্যেকটা ব্যর্থ দুপুর আর নিষ্ফল রাতে যে ছিল আমার বন্ধু, বছরের পর বছর আমার সঙ্গে নিজের স্বামী, কন্যার খুশির মুহূর্তরা এঁটো হাতের গল্পে, হাতে হাত মিলিয়ে নেমন্তন্ন বাড়িতে পরিবেশনের গল্প ভাগ করে নিয়েছি। ওর চলে যাওয়ার জন্য কেঁদেছি, সেই কান্নাকে কখন যেন বিদায় দিয়েছি। হয়তো মন শুকনো রাখার তাগিদেই।

কিন্ত মন কি মানে?

বয়স ফুরনো এই নারীর মধ্যে সন্ধের উত্তম শ্রাবণ হয়ে ঝরে যায়। সূত্র: আনন্দবাজার 

এসি  

 

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি