উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্নযাত্রায় যা করণীয়
প্রকাশিত : ১৯:১১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
নতুন এ সরকারের মূল অগ্রাধিকার হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত রূপকল্প ২০৪১-এর মাধ্যমে সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশের যে স্বপ্নবীজ রচিত হয়েছে জনমানসে, তার বাস্তব রূপায়ণের ভিত্তিমূল নির্মাণ এখন জরুরি। ২০৪১ সালে প্রায় ১০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও ১৬ হাজার মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে উন্নয়নের এমন এক চূড়ায় যেখান থেকে শোনা যাবে না দারিদ্র্যের দূরতর প্রতিধ্বনিও। অর্থনীতি হবে সেবাপ্রধান ও শিল্পনির্ভর, হ্রাস পাবে দেশজ আয়ে কৃষির তুলনামূলক অবদান। প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে জিডিপির ৩.০ শতাংশে। বাংলাদেশ পরিণত হবে জলবায়ু সহনশীল, পরিবেশগতভাবে টেকসই একটি শিল্প অর্থনীতিতে ও বৈশ্বিক জ্ঞানকেন্দ্রে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় দীর্ঘ মেয়াদি বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এর বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে। সমৃদ্ধ ২০৪১ অভিযাত্রার মধ্যভাগে বাংলাদেশের জন্য রয়েছে আরেকটি মাইলফলক টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০। ২০৩০ সালের মধ্যে এ অভীষ্টভুক্ত একগুচ্ছ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে ২০৩০ সালকে নামাঙ্কিত করা হয়েছে উন্নয়ন জংশন হিসেবে।
এ পর্যন্ত আলোচনা উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনে হবে যদি আমরা প্রেক্ষাপট হিসেবে গত দশ বছরের উন্নয়ন চিত্রের ওপর আলোকপাত না করি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সর্বশেষ প্রতিবেদন (অক্টোবর ২০১৮) অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৩তম বৃহত্ অর্থনীতি। ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতা বিচারে দেশের অবস্থান আরও উঁচুতে ৩১তম। গত এক দশকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রদর্শন করেছে অভূতপূর্ব গতি ও ধারাবাহিকতা। গত এক দশকে গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৩১ শতাংশ। প্রায় ৭.০ শতাংশ গড় নিয়ে সর্বশেষ পাঁচ বছরে প্রবৃদ্ধির এ গতিধারা আরও বেশি বেগবান হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৭.৮৬ শতাংশে। সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচকেও একই ধরনের প্রবণতা লক্ষ্যমান। সমান্তরাল সাফল্যচিত্র অঙ্কিত হয়েছে সামাজিক খাতের সূচকগুলোতেও। বাংলাদেশের এমডিজি সাফল্য এরই প্রামাণ্য দলিল। বলা যায় স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশ এখন উন্নয়ন অর্থনীতির মহাসড়কে ধাবমান। আর এ পথ বেয়েই একদিন বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে তার চূড়ান্ত গন্তব্যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত দেশের মর্যাদায় উদ্ভাসিত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।
মূলত দুটি কারণে সমৃদ্ধির এ পথ নিষ্কণ্টক এবং অনায়াসসাধ্য হবে না লক্ষ্য অর্জন। প্রথমত, অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিধারা অনুযায়ী একটি দেশের অর্থনীতি আকারে যত বাড়তে থাকে, অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ততটাই দুরূহ হতে থাকে। দ্বিতীয়ত, রূপকল্প ২০৪১-এর লক্ষ্যসমূহ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সংখ্যাগতভাবে অনেক বেশি বৃহত্ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এসব লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব নয়; কিন্তু দুরূহ অবশ্যই। এর জন্য প্রয়োজন হবে সার্বিক ও সমন্বিত নিবিড় প্রচেষ্টা, ব্যাপক ও বিশাল পরিসরের উদ্ভাবনী সব কর্মযজ্ঞ। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে সাহসী সব সংস্কার কার্যক্রমের। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পাঁচ বছর হতে পারে সে সব সংস্কারের কাল। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের দৃঢ়তর ভিত্তি নির্মাণের কাল। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সক্ষমতা বৃদ্ধির কাল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণার মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই সংস্কারের শুভ সূচনা করে দিয়েছেন।
রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সংস্কার এখন সময়ের দাবি। কর-জিডিপি অনুপাত দীর্ঘদিন ধরেই ১০ শতাংশের নিচে রয়ে গিয়েছে। সবাই একমত যে উন্নত দেশ হতে হলে এ বৃত্ত ভাঙতেই হবে। পাশাপাশি বাড়াতে হবে কর-বহির্ভূত রাজস্বের পরিমাণ। উন্নত দেশ হবার পথে ব্যাংক খাতের ১০ শতাংশের বেশি অকার্যকর লোনের হার কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। বৃহত্ আকারের ঋণ খেলাপিদেরকে ও জড়িত অন্য সবাইকে কঠোর আইনি শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ভেঙে দিতে হবে এ খাতের ‘সিন্ডিকেট ও কার্টেলগুলো’। এ ক্ষেত্রেও প্রয়োজন হবে গুরুত্বপূর্ণ আইনি সংস্কারের। বাংলাদেশের উন্নত দেশ হবার পথে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৪১ অর্থবছরে সর্বমোট বিনিয়োগ হতে হবে দেশজ আয়ের ৪৬.৯ শতাংশ। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরেই বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০ শতাংশের আশেপাশে আটকে আছে। একই ধরনের চিত্র বিরাজ করছে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও। যার ঐতিহাসিক গড় জিডিপির ১ শতাংশেরও নিচে। অথচ ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন হবে জিডিপির ৩ শতাংশ প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের, সে সময়ের জন্য প্রাক্কলিত জিডিপি হিসেবে এর সংখ্যাগত পরিমাণ হবে বিশাল। সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তির এ ধীরগতির কারণ অনুসন্ধান করলে চলে আসে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের দুর্বল অবস্থান। বিশ্বব্যাংক প্রণীত ব্যবসা কর্মের সহজতা সূচক ২০১৮-তে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৭৭তম। বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে আফগানিস্তান, লিবিয়া, কঙ্গো ও সোমালিয়ার মতো এশিয়া ও আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত কিছু দেশ। তুলনীয় দেশের মধ্যে এ সূচকে ভারতের অবস্থান ১০০তম এবং ভিয়েতনামের ৬৮তম। কেন বাংলাদেশের এফডিআই আড়াই বিলিয়ন আর ভিয়েতনামের ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের উপরে এ সূচক থেকেই তা অনুমেয়।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন ও রপ্তানি বৈচিত্র্য আনয়ন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য কেবল তৈরি-পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগেরও বেশি আসে এ খাত হতে। বলা অত্যুক্তি হবে না যে, এটি টেকসই ব্যবস্থা নয়। ২০৪১ সালের লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশকে আরও নতুন নতুন পণ্যের বাজার সৃষ্টি করতে হবে। চামড়া ও পাদুকা শিল্পের মতো রপ্তানিযোগ্য পণ্যের প্রসারে প্রণোদনা দিতে হবে। সঠিক প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টিতে বন্ডেড ওয়্যার হাউজসহ অন্যান্য প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা সব ধরনের রপ্তানি পণ্যের জন্য একই রকম হতে হবে। এ আলোকে পুনর্বিবেচনায় নিতে হবে দেশের বাণিজ্যনীতিকে। সৃষ্টি করতে হবে বিশ্ববাজারের সঙ্গে অধিকতর সংযোগ এবং গড় ট্যারিফ হতে হবে প্রতিযোগী দেশগুলোর বেশি নয়।
উন্নয়ন প্রক্রিয়ার পরোক্ষ ঋণাত্মক প্রভাব (negative externalities) হিসেবে প্রায়শ বৃদ্ধি পায় অসমতা বা ধনী-গরিব বৈষম্য। গত এক দশকে ধীরগতিতে হলেও ক্রমশ প্রকট হচ্ছে ধনী-গরিবের আয় ও ভোগ ব্যবধান। ২০০৫ সালে আয় সোপানের শীর্ষভাগে অবস্থানকারী ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী মোট জাতীয় আয়ের ২৬.৯ শতাংশ ভোগ করত; অন্যদিকে সর্বনিম্ন ধাপে অবস্থানকারী ৫ শতাংশ ভোগ করত মাত্র ০.৭৭ শতাংশ। বিবিএস এর সর্বশেষ খানা আয় ব্যয় জরিপ (২০১৬) এ দেখা যায় যে সাম্প্রতিককালে পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটেছে। দারিদ্র্য ও বৈষম্য সংশ্লিষ্ট এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার নীতিগত হাতিয়ার ইতোমধ্যেই সক্রিয়। বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের সারকথা ছিল কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের মুক্তির কথা, শোষণ মুক্তির কথা। বঙ্গবন্ধুর এই বাংলায় প্রকট অসমতা ও আঞ্চলিক বৈষম্য থাকতে পারে না।
শ্রমঘন অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তুলনামূলক সুবিধার জায়গা হলো এর জনশক্তি বা জনসম্পদ। শ্রমের প্রাচুর্যের সঙ্গে চলমান জনমিতিক লভ্যাংশের কাল যুক্ত করেছে ইতিবাচক অনুষঙ্গ। রূপকল্প ২০৪১ অর্জনের অন্যতম সহায়ক হতে পারত এ সুযোগ সমষ্টি। কিন্তু বর্তমান শ্রমকাঠামোর নিবিড় পর্যবেক্ষণ এ খাতে সুযোগের চেয়ে চ্যালেঞ্জের দ্যোতনাই বেশি। দেশের জিডিপিতে বর্তমানে কৃষিখাতের অবদান ১৫ শতাংশেরও কম কিন্তু দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশেরও বেশি কৃষির সঙ্গে জড়িত। কৃষিখাতকে এর ধারণ ক্ষমতার তুলনায় বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে যা অন্যখাতে সীমিত কর্মসুযোগের ইঙ্গিতবাহী। আবার দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী হলেও নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার মাত্র ৩৬ শতাংশ যা থেকে সহজেই বোধগম্য হয় যে শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অংশ দেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ অবদান রাখতে পারছে না। শ্রীলঙ্কায় শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ ৭১ শতাংশ। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো ১৫-২৯ বছর বয়সী কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ কোনো রকম কর্ম, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণে নিয়োজিত নেই। বিবিএস-এর এ পরিসংখ্যান শুধু বর্তমান নয় দেশের ভবিষ্যতের জন্যও হতাশার চিত্র প্রক্ষেপণ করে। জনশক্তি রপ্তানিতে অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ বেশ ভালো ফল প্রদর্শন করেছে ২০১৭ পঞ্জিকাবর্ষে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ কর্মোদ্দেশ্যে বিদেশ গমন করেছে, ২০১৮-তেও গমন করেছে ৭ লাখেরও বেশি। গত পাঁচ বছরে প্রবাসী আয়ের গড় বার্ষিক প্রবাহ ছিল প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অধিকাংশ শ্রমিকই নিয়োজিত থাকে স্বল্প দক্ষতা ও স্বল্প মজুরির কায়িক শ্রমে। উন্নত দেশের অভিযাত্রায় প্রয়োজন হবে ব্যবস্থাপনা ও প্রকৌশল সংশ্লিষ্ট দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানির। শুধু বিদেশেই নয় দেশেও প্রয়োজন হবে উত্পাদন-দক্ষ শ্রমশক্তির। আর এর জন্য প্রয়োজন হবে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। সনদসর্বস্ব শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাজার চাহিদাভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় রূপান্তর জোরদার হয়ে উঠছে না। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টেও জোর দেওয়া হয়েছে গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরও নজরদারি ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন হবে।
উচ্চ আয়ের দেশের দিকে বাংলাদেশের অভিযাত্রায় তুলনীয় দেশ হতে পারে কোরিয়া। ১৯৬৯-১৯৮৮ সময়কালে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হতে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে এবং ১৯৮৮-২০০১ সময়কালে মধ্যম আয়ের দেশ হতে উচ্চ আয়ের দেশে অর্থাত্ এশিয়ান টাইগার ইকোনমিতে পরিণত হবার যে পথপরিক্রমা তা বাংলাদেশের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। অর্থনৈতিক বিবর্তনের এ প্রক্রিয়ায় দক্ষিণ কোরিয়া যে সাফল্য প্রদর্শন করেছিল তা বাংলাদেশের জন্য একটি দুরূহ পথেরই ইঙ্গিত করে। উত্তরণের প্রথম পর্যায়ে কোরিয়া গড় বার্ষিক ৮.১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি বজায় রেখে মূলত উচ্চ পরিমাণে পুঁজি গঠনের দিকে জোর দেয়। এসময়কালে শ্রম-সংশ্লিষ্ট উত্পাদনশীলতা (factor productivity of labor) গড়ে প্রতিবছর ৪.২ শতাংশ করে বাড়তে থাকে। আর এ উত্পাদনশীলতার মূল নিয়ামক ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার ঐতিহাসিক উচ্চ সাক্ষরতার হার। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থাকা অবস্থাতেই দেশটিতে সাক্ষরতার হার ছিল ৯৫ শতাংশের বেশি (বর্তমানে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ৭২ শতাংশ, ৪০ শতাংশ শ্রমশক্তি নিরক্ষর)। শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার (labor force participation rate) এসময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতিকে ছাড়িয়ে যায়। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায় ২৮ গুণেরও বেশি। দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে চলক উন্নয়ন-অর্থনিতিবিদেরা চিহ্নিত করেছেন তা হলো দেশটির প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও শক্তিশালী গভর্ন্যান্সের প্রভাব। উত্তরণের পরবর্তী পর্যায়ে দক্ষিণ কোরিয়া উচ্চ শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায় জোর প্রদান করে; বৃদ্ধি করে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতের বাজেট বরাদ্দ। শিক্ষা, গবেষণা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সর্বোপরি মানবসম্পদ উন্নয়নে সরকারের অগ্রাধিকারের ফলে শ্রমের উত্পাদনশীলতা বেড়ে যায় বহুগুণ। রপ্তানি হয়ে দাঁড়ায় পুঁজিঘন পণ্যনির্ভর। আর এসব কিছুর সম্মিলিত প্রভাবে ২০০১ সালে উচ্চ আয়ের দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয় দেশটি।
নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হতে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে দক্ষিণ কোরিয়া সময় নিয়েছে ৩২ বছর (১৯৬৯-২০০১)। একই ধরনের অভীষ্ট অর্জনে বাংলাদেশ সময় নির্ধারণ করেছে ২৬ বছর (২০১৫-২০৪১)। বাংলাদেশের জন্য সময় খুবই স্বল্প, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিতে হবে এক্ষুণি। ভিত্তি বছরের প্রতিটি সূচকেই বাংলাদেশ তত্কালীন কোরিয়ার চেয়ে বেশ খানিকটা পিছিয়ে আছে। কাজেই বাংলাদেশের জন্য ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন অসম্ভব না হলেও কঠিন হবে। তবুও আশা করি, এ বন্ধুর পথ অতিক্রম করেই স্বপ্নদর্শী ও সফল নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। আর এক্ষেত্রে ব্যাপক ও বিশাল পরিসরে আর্থিক খাত ও প্রশাসনিক সংস্কারের বিকল্প নেই। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা কালটি হতে হবে সংস্কারের কাল এবং ২০৪১ এর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার একটি দৃঢ় সোপান।
লেখক: সদস্য (সিনিয়র সচিব) ও অর্থনীতিবিদ, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।