উপজেলায় একমাত্র জিপিএ-৫ পেয়েও দুশ্চিন্তায়
প্রকাশিত : ২১:২০, ২০ জুলাই ২০১৮
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় এবারের এইচএসসিতে একমাত্র জিপিএ-৫ পেয়েছে কাকলী আক্তার। গৌরবময় এই ফলাফলে অভিভাবকের যেখানে আনন্দ করার কথা সেখানে আরও দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে কাকলীর দিন মজুর বাবার।
মেয়ে ভালো ফলাফল হাতে পাওয়ার পর মেয়েকে মিষ্টি মুখ করার মত টাকা নেই এই দিন মজুরের। শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফেরার পথে মসজিদের মিলাদে পাওয়া একপিস জেলাপি দিয়ে মেধাবী মেয়েকে মিষ্টি মুখ করান তার বাবা।
জানা গেছে, মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় একমাত্র জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী কাকলী আক্তারের পরিবারে তেমন কোন আনন্দ ছিল না। মেয়ের উচ্চ শিক্ষা নিয়ে শঙ্কিত কাকলীর বাবা মা। কলেজের সহযোগিতায় বিনা খরচে লেখাপড়া করে জিপিএ-৫ অর্জন করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতির বদলে চরম হতাশায় নিমজ্জিত কাকলীর পরিবার। এখন লেখাপড়া চালানো নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, চলতি বছর এইচএসসির ফলাফলে জেলার শিবচর উপজেলার ৫টি কলেজের মধ্যে ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী কলেজ ৮৮.৫৯ ভাগ উত্তীর্ণ হয়ে শীর্ষস্থান দখল করে এবং উপজেলার একমাত্র জিপিএ-৫ অর্জনকারী ওই কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী কাকলী আক্তার।
নদী ভাঙ্গনে আক্রান্ত কাকলী পরিবারটির বসবাস উপজেলার পাচ্চরে একচালার একটি ঝুপড়ি ঘরে। কাকলীর পাঁচ ভাই বোন, বাবা হারুন মাদবর দিন মজুর মা তাসলিমা বেগম গৃহিণী। অন্যের জমিতে বাবা হারুনের কামলা (দিনমজুরি) দিয়েই কোন মতে চলে সংসার।
ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় মনোযোগী কাকলী এসএসসিতে পাচ্চর বালিকা বিদ্যালয় থেকে সংগ্রাম করে জিপিএ-৫ অর্জন করে। পরে প্রধান শিক্ষকের সহায়তায় ভর্তি ফি ছাড়াই ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী কলেজ কর্তৃপক্ষ কাকলীকে পড়ার সুযোগ দেন। এমনকি বেতনসহ যাবতীয় খরচ বিনামূল্য করে দেয় কর্তৃপক্ষ।
যাতায়াতসহ বাকি খরচ চালাতে পাশের বাড়ির শিশুদের প্রাইভেট পড়িয়ে নিজেই চালাতো নিজের খরচ। দিনমজুর বাবা খাবার জোগাতেই হিমশিম খাওয়ায় টাকার অভাবে কলেজের মাত্র ৪টি বই কিনতে পারে কাকলী। অন্যের পুরাতন বই হাওলাদ করে পড়তে হয়েছে তাকে। বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকায় দিনের বেলাকেই বেশি বেছে নিতো পড়ার সময়। খাতা ফুরিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় পড়তো বেশি লিখতো কম। যাতায়াত ভাড়া না থাকায় অনেকদিন কলেজে যাওয়া বাদ দিতে হয়েছে তাকে।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথে দেখা যায় কাকলীর বাবা কাজ শেষে খুড়িয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছে হাতে এক পিচ জিলাপী নিয়ে। মসজিদ থেকে দেয়া ওই জিলাপীটাই বাবা না খেয়ে এনেছে মেয়ের ভালো ফলাফলের জন্য।
পাশের বাড়ির সাবেক ইউপি সদস্য বলেন, এমন পরিবেশে থেকে কাকলীর এই ফলাফল সত্যিই অবিশ্বাস্য। এত ভালো রেজাল্ট করেও ওদের বাড়িতে আনন্দ নেই। ভালো জায়গায় ভর্তিতো দূরে থাক ওদের ঢাকায় যাওয়ার ভাড়াও নেই।
কাকলীর মা তাসলিমা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘কামলা দিয়ে ৭ জনের সংসার চালানোই কঠিন। রেজাল্টের পর মিষ্টিও খাওয়াতে পারি নাই মেয়েকে। ভাত জুটানোই কষ্ট। আমাগো সামর্থ্য নাই ওরে পড়ানোর। ও নিজে কষ্ট কইরা এই পর্যন্ত আইছে।’
বাবা হারুন মাদবর বলেন, ‘একদিন কাজ না করলে সংসারই চলে না। ও পড়ছে নিজেরডা দিয়াই। এহন ভাল জায়গায় পড়তে চায়। আমরা কেমনে কি করমু।’
অদম্য মেধাবী কাকলী আক্তার বলেন, ‘কলেজ ও স্কুলের স্যারদের সহযোগিতায় অনেক কষ্ট করেই পড়ছি। উচ্চশিক্ষা নেয়ার আমার খুব ইচ্ছা। কিন্তু আমার মা-বাবাতো পারে না। তাই জানি না কি আছে ভাগ্যে। তবে আমি পড়তে চাই।’
পাচ্চর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সামছুল আলম বলেন, ‘কাকলী অদম্য মেধাবীদের মধ্যেও সেরা। ও এই উপজেলার এবারের একমাত্র জিপিএ-৫ প্রাপ্ত। ওর পাশে সরকারসহ বিত্তবানরা এগিয়ে না আসলে ভবিষ্যত অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। (ওকে কেউ সহযোগিতার জন্য ওদের নিজেদের ০১৯৮৮৩৭১৬৫৮ নাম্বারে অথবা অধ্যক্ষর নাম্বারে ০১৭১৬৩৭৭২৯৬ যোগাযোগ করতে পারেন।)
ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী কলেজের অধ্যক্ষ মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘কাকলী আক্তার অদম্য মেধাবী। ওর পাশে আমরা শুরু থেকেই ছিলাম। সবাই ওর জন্য এগিয়ে আসলে ও অনেক এগিয়ে যাবে।’
কেআই/এসএইচ/
আরও পড়ুন