ঋতু পরিবর্তনজনিত অসুস্থতায় ডায়াবেটিক রোগীদের করণীয়
প্রকাশিত : ১৯:০০, ১৮ আগস্ট ২০১৮ | আপডেট: ১৭:৩৭, ২০ আগস্ট ২০১৮
ডা. উম্মে সালমা
ঋতুর পরিবর্তনকালে মানুষ ছোটখাট অসুখে (সর্দি, কাশি, জ্বর, ডাইরিয়া ইত্যাদি) আক্রান্ত হয়, যা সাধারণত দ্রুত সেরে যায়। তবে কখনো কখনো এসব ছোটখাট অসুস্থতা গুরুত্ব না দিলে মারাত্মক আকারও ধারণ করতে পারে। যা কোনো কোনো সময় মৃত্যুঝুঁকিও তৈরি করে।
এখন বর্ষাকাল। এই সময়ে সাধারণত বিভিন্ন জ্বরের প্রকোপ বেড়ে যায়। এছাড়া ডায়রিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিসের প্রকোপও বছরের বিভিন্ন সময়ে বেড়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে একজন ডায়াবেটিক রোগীর করণীয় কী সেটা জানা থাকা খুব জরুরি।
বর্ষাকালে বিভিন্ন ধরনের জ্বর যেমন ভাইরাস জ্বর, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ অনেক বেড়ে যায়। ভাইরাস জনিস জ্বর সাধারণত ৭ দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সেরে যায়। এই জ্বরে তেমন কোনো জটিলতা দেখা যায় না। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে শরীরে রাশ দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গু মূলত একটি ভাইরাস জনিত জ্বর যার বাহক হচ্ছে এডিস মশা। আক্রান্ত মশা কোরো সুস্থ ব্যক্তিকে কামড় দিলে এই জ্বর হতে পারে। এডিশ মশার প্রজনন ক্ষেত্র হচ্ছে জমে থাকা পরিষ্কার পানি। এই জ্বরও সাধারণত কোনো ধরনের জটিলতা ছাড়াই সাত দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা দেখা দিতেও পারে।
রক্তের প্লাটিনেট অনেক বেশি কমে যাওয়ার শরীরের বিভিন্ন স্থানে (দাঁতের মাড়ি, নাক, চামড়ার নীচে, পায়খানা ও প্রস্রাবের সঙ্গে) থেকে রক্তক্ষরণ জনিত ডেঙ্গু শক সিনড্রোম তৈরি হতে পারে। যাতে রোগীর শরীরে তীব্র পানিশুন্যতা দেখা দেয় এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। ডেঙ্গুর জটিলতা দেখা দিলে অবশ্যই রোগীকে নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দিতে হবে।
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত জ্বর এবং এই জ্বরের বাহক এডিস মশা। এই জ্বরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সারা শরীর, অস্থি অস্থি সন্ধিতে তীব্র ব্যথা অনুভুত হয়। যার কারণে রোগী অনেক সময় চলাফেরা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
এই জ্বরও সপ্তাহখানেকের মধ্যে পুরোপুরি সেরে যায় তবে কারো কারো ক্ষেত্রে অস্থি ও অস্থি সন্ধির ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এছাড়াও শিশু, বয়স্ক রোগী, গর্ভবতী মহিলা, ডায়িবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে এই জ্বর কখনো কখনো হৃৎপিন্ড, কিডনী, স্নায়ু, চোখে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
করনীয়
যেকোনো ধরনের জ্বরের ক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রোগীর শরীর স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি দিয়ে বারবার মুছে দিতে হবে। সম্ভব হলে আলো বাতাস পরিপূর্ণ কক্ষে রোগীকে রাখতে হবে। প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। সহজপাচ্য খাবার অল্প অল্প করে বার বার খাওয়াতে হবে। প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ রোগীকে খাওয়ানো যাবে তবে অন্য কোনো ওষুধ বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাওয়ানো যাবে না।
মনে রাখতে হবে ভাইরাসজনিত জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই।
ডায়রিয়া
ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হলে শরীর থেকে পানি ও দরকারী লবন বেরিয়ে গিয়ে অনেক সময় শরীরে পানি শুন্যতার সৃষ্টি হতে পারে। পানিশুন্যতা রোধ করার জন্য রোগীকে বার বার খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। এছাড়াও চালের গুড়ার স্যালাইন, ডাবের পানি সহ অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার রোগীকে খাওয়ানো যাবে।
মনে রাখতে হবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ডায়রিয়া ২/৩ দিনের মধ্যে ভাল হয়ে যায় এবং এক্ষেত্রেও অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই। অসুস্থতাকালীন ডায়াবেটিক রোগীদের যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে মুখে খাওয়ার ওষধ বা ইনসুলিন বন্ধ করা যাবে না। বাসায় গ্লুকোমিটার থাকলে এই সময় রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করতে হবে। অনেক সময় গ্লুকোজ বেড়েও যেতে পারে বা কমেও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
অসুস্থ অবস্থায় খাওয়ার রুচি কমে যাওয়ার কারণে অনেক সময় রোগী পরিমাণমত খেতে পারে না। যার কারণে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনেক কমে গিয়ে `হাইপোগ্লাইসেমিয়া` হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
এক্ষেত্রে ওষুধ বা ইনসুলিনের মাত্রা কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে তবে সেটা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে। রোগীকে অল্প অল্প করে বার বার খাওয়াতে হবে। নরমভাত, খিচুড়ি, সবজি বা মুরগীর ঝোল, স্যুপ জাতীয় খাবার সাথে প্রচুর পানি বা তরল জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে।
অসুস্থ অবস্থায় সব ধরনের ব্যয়াম বন্ধ রাখতে হবে এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
টাইফয়েড
এটি একটি ব্যাকটেরিয়া জনিত জ্বর। এই জ্বরের জীবানু খাদ্য ও পানীয়র মাধ্যমে ছড়ায়। জ্বরের তীব্রতা ও স্থায়ীত্ব অন্যান্য জ্বরের চেয়ে বেশী হয়। এক সপ্তাহের বেশী যদি জ্বর থাকে সেক্ষেত্রেও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। টাইফয়েড শনাক্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খেতে হবে।
জন্ডিস
হেপাটাইটিস বা জন্ডিস মানে হচ্ছে লিভারের প্রদাহ। এটি একটি ভাইরাস জনিত রোগ। বেশ কয়েক ধরনের ভাইরাস দিয়ে জন্ডিস হতে পারে। তবে খাদ্য ও পানীয়র মাধ্যমে যে ভাইরাসটি ছড়ায় সেটি হচ্ছে হেপাটাইটিস - এ।
আমাদের দেশে এ ধরনের জন্ডিস বেশী হয়। জন্ডিসের জন্য কোনো ওষুধ খেতে হয় না। একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া, বিশুদ্ধ পানি পান করা ও পরিপূর্ণ বিশ্রাম নেওয়া। তবে ডায়াবেটিক রোগীরা যারা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে মুখে খাবার ওষুধ খায় তাদের ক্ষেত্রে ওষুধ বন্ধ করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইনসুলিন গ্রহণ করতে হবে। তবে জন্ডিস পুরোপুরি সেরে গেলে অাবারও মুখে খাবার ওষুধ নেওয়া যেতে পারে। যেহেতু ডাইরিয়া, জন্ডিস, টাইফয়েড খাদ্য ও পানীয়র মাধ্যমে ছড়ায় কাজেই সব সময় বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার পানি পান করতে হবে। তাছাড়া পঁচাবাসি খাবার, রাস্তার পাশের খোলা খাবার, সস্তা হোটেলের খাবার পরিত্যাগ করতে হবে।
লেখক: ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল
আআ / এআর /