ঢাকা, রবিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

একজন হিরোর গল্প

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

প্রকাশিত : ১০:৩৭, ২১ জুন ২০২০ | আপডেট: ১০:৪২, ২১ জুন ২০২০

ভাষাসৈনিক আব্দুল গণি ও তার বাড়ি

ভাষাসৈনিক আব্দুল গণি ও তার বাড়ি

Ekushey Television Ltd.

বৌমা আজ তোমার নিউজ দেখলাম। যতবার হয়েছে ততবারই দেখেছি। আমি তো সারাক্ষণ ইটিভি খুলে রাখি তোমার জন্য। শুনে হাসলাম। ৩’শ কিলোমিটার দূর থেকে অনুভব করি ৯০ বছরেরও বেশী বয়সী একজন প্রবীণ মানুষের হৃদয় জুড়ানো ভালবাসা। তিনি আমার গণি ফুপা। 

আমার ফুপা শশুর। তাকে চেনার  পর থেকে, জানার পর থেকে কখনোই তাকে দূরের মানুষ বলে মনে হয়নি আমার। মনে হয়েছে তিনি যেন আমার আরেক বাবা। প্রায় দিনই ফোন দেন তিনি। কী করছি তার খোঁজখবর নেন। কোথায় কোথায় তিনি যাচ্ছেন তা জানান। 

হঠাৎ কিছুদিন তাঁর খোঁজ নেই। বেমালুম লাপাত্তা। এবার আমি ফোন দেই, না পাইনা। অস্থির লাগে। একে ওকে তাকে ফোন দিয়ে খোঁজখবর নেই। একদিন আবার তাঁর ফোন। অনুযোগে বলি, কী ফুপা আপনাকে পাওয়া যায়না ফোনে। বন্ধ থাকে ফোন।

 টেনশন হয়তো। শিশুদের মতো হাসেন, তুমি আমাকে পাবে কী করে বৌমা, আগের ফোনটা তো আবার হারিয়ে ফেলেছি। এটা নতুন। তুমি এই নাম্বারটা রাখো। জানো কয়দিন পরপরই ফোন হারায়। বয়স হয়েছে তো মনে রাখতে পারিনা কোথায় রাখি। ছেলেরা মাঝে মাঝে রাগ করে। কী করি বলো তো? হেসে বলি, আপনি বার বার ফোন হারাবেন সমস্যা নেই। দুজনই দু’প্রান্তে হাসতে থাকি। 

গণি ফুপা একজন ভাষা সৈনিক। ভালো নাম আব্দুল গণি।  রংপুর শহরে ১০ জন ভাষা সৈনিক ছিলেন। ২জন এখনো আলো ছড়িয়ে আছেন ওনি তাদের একজন। আরেকজনের নাম মোহাম্মদ আফজাল। 

১৯৫২ সালে গনি ফুপা ছিলেন রংপুর জিলা স্কুলের ছাত্র। সে সময় ভাষা বাংলা রক্ষায় তিনি ছিলেন সামনের কাতারের সৈনিক। আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে জেলে যান। তবে দমে যাননি একটুও। পাকিস্তানীদের নানা অত্যাচার সহ্য করে দেশের পাশেই ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ায় হুলিয়া মাথায় নিয়ে দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। হাজার প্রলোভনেও টলেননি একটুও। 

আড্ডাপ্রিয় মানুষটির এখন একটাই আক্ষেপ, ফেরুয়ারি এলেই শুধু তাদের খোঁজ নেয়া শুরু হয়। এরপর আর কেউ দেখতেও আসেনা।

ফুপা এ দেশ আর মানুষকে ভালোবেসেছেন। অসম্ভব সাহসী এই মানুষটি একসময় সারা শহর কাঁপিয়েছেন। এখন শরীরে হয়তো পারেন না কিন্তু মনে মনে শহরের যে কোনো নাগরিক আন্দোলনে এখনো তার থাকে মৌন সমর্থন। 

অপিকে আমি প্রায়ই বলি ফুপাকে দেখে ভালবাসা শেখো। রেখা ফুপু, রংপুরে সালমা গালর্স স্বুলের সিনিয়র শিক্ষক ছিলেন। অসম্ভব মেধাবী এই মানুষটি যখন প্রায় দুই যুগেরও বেশী আগে মারা যান তখন থেকে তাঁর স্মৃতি নিয়ে প্রত্যেকটা দিন পার করেছেন গণি ফুপা। বিয়ে করেননি আর। প্রতিদিন নূরপুরে ফুপুর কবরের কাছে যান। পরিষ্কার করেন। 

আমি একদিন গিয়েছিলাম। অবাক হয়ে দেখি একটা পাতাও পড়ে নেই সেখানে। কবরের উপরটা ঝকঝকে। ভেতরটাও নিশ্চয় তাই। তাঁর ভালোবাসার মতোই। সেখানে কোনো খাদ নেই, মিথ্যে নেই, প্রতারণা নেই। পুরোটাই হিরে। 

ফুপু যেভাবে বাড়ি বানিয়ে রেখেছিলেন ফুপা সেভাবেই আজো রেখেছেন। ভাবি কিভাবে সম্ভব? আমরা কি পারি এমন করে ভালবাসতে? আমাদের সর্ম্পকে কত টানাপোড়েন থাকে। নাগরিক ঘেরাটোপে আমরা ছুটতে ছুটতে কত রকমের সম্পর্ক গড়ি। মিথ্যার বেসাতি গড়ে তুলি মনে। মনে এক মুখে আরেক আমাদের। প্রতিনিয়ত অভিনয় করে সম্পর্ক বয়ে চলি। অথচ এই মানুষটা তাঁর ভালোবাসার সেই মুখটাকে মনে করে আজও পথ চলছেন।  সেখানে ক্লান্তি নেই, দীর্ঘশ্বাস নেই, বিরক্তি নেই। আছে শুধুই নিখাদ ভালবাসা। 

খাঁটি মানুষরা যুগে যুগে পথে পথে ছড়িয়ে যান হিরে মুক্তো জহরত। আমরা কজনই বা তার খবর রাখি। যখন বুঝি তখন রবীবন্দ্রনাথের কৃপণ কবিতার মতো চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, তোমায় কেন দেইনি আমার সকল শুন্য করে। 

গণি ফুপা সমাজের কাছে রাষ্ট্রের কাছে কখনোই কিছু চাননি। কখনো বলেননি আমি একজন ভাষাসৈনিক। আমাকে এ দাও, সে দাও। বরং নিজেই দেবার চেষ্টা করেছেন সবসময়। এখনো করোনার সময় বাইরে হাঁটতে যেতে চান তিনি। কথা বলতে চান মানুষের সাথে। খোঁজ নেন চায়ের দোকানদারের সংসারের। কিন্তু তাঁর নিরাপত্তায় স্বজনরা যেতে দিতে না চাইলে অভিমানে ঠোঁট ফুলান। 

আমি তখন দূর থেকে দেখতে পাই যেন আমার আরেক বাবাকে। আলো আঁধারিতে চোখের পানিতে তখন আমার বাবার মুখ, ফুপার মুখ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। 

একবার ফুপা রংপুর থেকে একাই চলে যান গোবিন্দগঞ্জে আমাদের বাসায়। ছিলেন ২দিনের মতো। আমি তখন ঢাকায়। আম্মা হেসে বলেন, তোমার আব্বা আর গণি ভাইয়ের গল্প চলছে সারাদিন। একটু পর পর চা আর ঘর কাঁপানো হাসি। শুনে আমার অকারণ কান্না পায়। বাবারা হাসলে, বাবারা ভালো থাকলে খুশীতে মনে এতো কান্না আসে কেন? 

আমি জানি বাবা দিবসে বাবাকে নিয়ে না লিখে, ফুপাকে নিয়ে লেখাতে দূর আকাশ থেকে বাবা একটুও মন খারাপ করেননি। বরং সাদা আকাশে মেঘের পালক উড়িয়ে হেসে বলেছেন, ‘মা, গণি ভাইকে নিয়ে তুমি কম লিখেছো। জানো, কারমাইকেল কলেজে তিনি সে সময় ছিলেন আমাদের হিরো। হিরোদের গল্প সবাইকে জানাতে হয়।’

বাবা দিবসে সব হিরো বাবাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা!

লেখক: সাংবাদিক

এমবি//


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি