একজন মৃত্যু পথযাত্রীর অসিয়তনামা
প্রকাশিত : ১৭:৪৫, ৫ জুন ২০১৮ | আপডেট: ১০:৩২, ৬ জুন ২০১৮
মোহাম্মদ ছাবের অাহমদ। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার মাদার্শা উপজেলার ছাবের অাহমদ পেশাগত জীবনে ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। ৮৫ বছর বয়সে তিনি গত ২৮ মে ( সোমবার) সকাল দশটায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ছয় ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান। ( ইন্নালিল্লাহে... রাজেউন)।
এটুকু মোটামুটি স্বাভাবিক ঘটনা। মৃত্যু যেহেতু সবার জীবনে চিরন্তন সত্য সেহেতু তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু মোহাম্মদ ছাবের অাহমদ- মৃত্যুর বহু অাগেই মৃত্যু পরবর্তী কিছু অসিয়ত নামা লিখে যান। যা মৃত্যুর পরে এখন অনেকের মুখে মুখে অালোচিত বিষয়।
প্রয়াত ছাবের অাহমদের সন্তান চুয়েটে কর্মরত ফজলুর রহমান জানান, মৃত্যুর প্রায় এক বছর আগেই নিজের হাতে লিখে অছিয়ত করে যান মোহাম্মদ ছাবের অাহমদ। ফজলুর রহমান অারো জানান, মৃত্যুর দিন ভোরেও যথারীতি বিছানা ছাড়েন তিনি। এরপর তাহাজ্জুদ নামাজ পড়েন। নিয়মমাফিক কোরআন তেলাওয়াত, দোয়া-দরূদ পড়েন। অভ্যাসমত মদিনা শরীফ জেয়ারত করেন। সবশেষে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমে যান। সকাল ৯টার দিকে নিজের লাগানো গাছ-গাছালির দিকে যান। এরপর বাড়িটাও দেখে নেন একটু। এরপর মাকে ডাকেন। বলেন, সবাই আসো-খারাপ লাগছে। দাফন-কাফনের জন্য সব সময় ১০ হাজার টাকা আলাদা রাখতেন, সে টাকা মা’কে দিয়ে দেন। এসব অবস্থা বুঝতে পেরে মা কেঁদে উঠেন। তিনি ডাকেন চাচা-চাচী, ভাইদের। বাবা একটু স্বল্পস্বরে কথা বলছিলেন। মুখে কলেমা জপতে থাকেন। এরপর ঘুম যাওয়ার কথা বলেন। নিঃশ্বাস কমে আসে। অবশেষে চিরঘুমও চলে আসে। (ইন্নাল্লিাহে... রাজেউন)
মোহাম্মদ ছাবের অাহমদ মৃত্যুর এক বছর অাগে যে অসিয়ত নামা লিখে গিয়েছিলেন তা এখানে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
`‘যদি আমার মৃত্যু ঘটে- উত্তর পার্শ্বের কামরায় যেই ডাইনিং টেবিল আছে- ওই টেবিল ওখান থেকে সরাবে না। টেবিলের রেকসিনটা প্রথমে ওঠাইয়া ফেলবে। আমার কামরার বড় কম্বলটা দুই ভাঁজ করিয়া টেবিলের উপর লম্বা করিয়া বিছাইয়া দিবে-পরে ডাইনিং টেবিলের রেকসিনটা কম্বলের ভাঁজের উপর বিছাইয়া বালিশ দিয়া তার উপরে আমার দেহ শোয়াইবে। চেয়ার-মোড়া ভাজমত থাকিবে-তথা হতে বাহির করিয়া নিয়া যাইবে। জান যাওয়ার পরপর ঠিকভাবে গোসল দিয়া ডাইনিং টেবিলের উপর শোয়াই রাখিবে। পরে সেখান থেকে বাহির করিয়া নিয়ে যাইবে। আমার কথা ঠিকমত পালন-ইহাই আমার অছিয়ত। ইতি-জীবদ্দশায়, ছাবের আহমদ।’’
‘‘ মৃত্যু কখন, কিভাবে হয় তাহা কাহরও জানার বিষয় নয়। তাই আগাম লিখিয়া দিলাম। হা-হুতাশ না করিয়া সবাই দোয়া করিবে। আমার কাফনের জন্য কোন প্রকারের কাপড় কিনিতে হইবে না ( হজ করে আসা কাপড় ও চাদর সংরক্ষণ করেছিলেন)। সাবান, কর্পুর, সুরাম-আতর, একখানা কোরান শরীফ ও একটা বিস্কুট কিনিতে হইবে। কালো রেকসিনের উপর ত্রিপল ভিতরে আছে।’’
‘‘ আমার মৃত্যুর পর খুব বড় করিয়া মেজবানের ব্যবস্থা করিবে না। আমার রূহের মাগফেরাতের জন্য বেশী পক্ষে ৫/৭ পাঁচ-সাত হাজার টাকার মধ্যে সামান্য ডাল ভাতের ব্যবস্থা করিবে। গোসল দেওয়ার লোক, কবর খোঁড়ার লোকদেরকে তৃপ্তিমতে খাওয়াইবে-তার অতিরিক্ত না করার জন্য নিষেধ করিলাম। প্রতিদিন-দশদিন-বিশদিন-ত্রিশ দিনের কোন ফাতেহা করিবে না। চল্লিশ দিনের দিন কয়েকজন মিশকিন, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীকে সামান্য ডাল-ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করিবে সীমিত আকারে।’’
‘‘ নতুন লুঙ্গি, কোর্তা-কাপড়, রুমাল সব আছে। একটা গেঞ্জি কিনিতে হইবে। অব্যবহৃত টুপিও আছে। এক জোড়া স্যান্ডেল কিনিতে হইবে। লম্বা জোব্বা দুইটার মধ্যে একটা মিয়াজিকে দিয়া দিবে। আর কিছু দিবে না। হাতের ব্যবহারের লাঠিটা বাড়ীতে থাকিবে। ইহাই অছিয়ত।’’
‘‘ আমার ছেলেদের প্রতি বলছি-আমার মৃত্যুর পর যতদিন আমার স্ত্রী লায়লা বেগম এই দুনিয়ায় বাচিয়া থাকিবে ততদিন তোমাদের মা যাহাতে কোন প্রকারের অসুবিধার মধ্যে না পড়ে সেই দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখিবে। অবহেলা করিলে তোমাদের অমঙ্গল হইবে-ইহাই আমার অছিয়ত। তোমাদের মা এই বাড়িতে ইচ্ছা করিলে থাকিবে, সুব্যবস্থা করিয়া দিবে, জোর করিয়া এই বাড়ী ত্যাগ করিতে বাধ্য করিবে না।’’
"মুরব্বিগণের মুখে শুনিয়াছি আমার জন্মদিন শুক্রবার। মাঘ মাসে শুক্রবারে ভোররাতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে ফজরের আযান হইয়াছিল। আমার মা খাতুন বিবি’র মৃত্যু ১৯৮৪ ইং সনের কার্তিক মাসের সম্ভবত ১৪ তারিখে সোমবার সকাল ১০টার দিকে। সেইদিনই দাফন হয়েছিল। "
মোহাম্মদ ছাবের অাহমদ- এর সন্তান ফজলুর রহমান জানান, আমার বাবা আলহাজ ছাবের আহমদেরও ইন্তেকাল সোমবার সকাল ১০টার দিকে ঘটে। অর্থাৎ আমার বাবা এবং দাদী, তারা দুজন মা-ছেলে একই সোমবার একই সময় ১০টার দিকে ইন্তেকাল করেন।
অা অা/এসএইচ/
আরও পড়ুন