একজন সহযোদ্ধার প্রতিকৃতি
প্রকাশিত : ২১:৪০, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০
আজ এমন একজন অফিসারের কথা মনে করছি, যার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া বর্তমান সময়ে একটু বিরলই বটে। ১৯৯১ সালের জানুয়ারী মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। করল্লাছড়ি ক্যাম্পে জড়ো হয়েছি মেজর আমিন পাটোয়ারি (৭ সর্ট কোর্স), ক্যাপ্টেন ইকবাল (১৪ লং) সহ আমরা তিনজন। মাইনীমুখ জোনের দক্ষিণ পশ্চিমের করল্লাছড়ি ক্যাম্পটি শান্তি বাহিনীর নানান তৎপরতার বিরুদ্ধে এক বিরাট প্রতিবন্ধক। আশির দশকে এই ক্যাম্পের অনেক সৈনিক হতাহত হয়েছে। এই ক্যাম্প থেকে মহালছড়ির দিকেই অপারেশন পরিচালনা করা হয়। এখান থেকে অপারেশনে বের হয়ে শান্তি বাহিনীর মুখোমুখী না হওয়ার অভিজ্ঞতা বিরল।
"সার্চ এন্ড ডেস্ট্রয়"- এই ছিলো অপারেশনের লক্ষ্য। তা আমার জন্য সে দিনটা ছিলো "First Day in First Patroll." অতএব অনভিজ্ঞতার কারণে চলার ধারাবাহিকতায় আমার অবস্থান হয় ২য় নম্বরে। খুব দ্রুতই চলছি ছড়ার মধ্যদিয়ে। মেজর আমিনের দল সবার আগে। তাড়াতাড়ি রিজ লাইনে উঠতে হবে। চরম রোমাঞ্চে প্রায় সময়ই উনাকে অতিক্রম করে সামনে চলে যাচ্ছিলাম। আমার ভাবখানা ছিলো 'আমি একাই সব শান্তিবাহিনী ধরে ফেলবো' - একটা বীরপুরুষ বীরপুরুষ উত্তেজনা।
তো রিজ লাইনে উঠতে গিয়ে সম্মুখের স্কাউট পলায়নরত এক সন্দেহভাজনকে দৌড়ে ধরে ফেলে। আর এতেই পুরো পেট্রোলদলের মধ্যে একটা যুদ্ধাংদেহী মনোভাব ছড়িয়ে পড়ে। লুঙ্গী পরা ১৮/২০ বয়সের এই তরুণ সন্দেহভাজনকে নিয়ে আমরা একটা নিরাপদ উচ্চতায় উঠে যাই। ওর দৌড়ে পালানোর পিছনে একটা গল্প সে দাঁড় করায়- ছড়ায় মাছ ধরতে নেমে আর্মি দেখে ভয় পেয়েছে।
তা হতেও পারে, নাও হতে পারে - এই ভেবে ওকে সাথে নিয়েই পুনঃরায় পথ চলা। পেট্রোলের গোপনীয়তার স্বার্থে ওকেও সাথে নিতে হবে। মধ্যদুপুরের বিরতির পর পথ চলা শুরু করতেই শান্তিবাহিনীর একটি অগ্রবর্তী দলের স্কাউটের সঙ্গে আমাদের দলের স্কাউটের হঠাৎ সংঘর্ষে কেপেঁ উঠলো উপত্যকা।
একটা সিংগেল রাউন্ড ফায়ারের পরই একটা লম্বা বাস্ট ফায়ার... ঠা, ঠা, ঠা, ঠা, ঠা। আরো কয়েকটা শর্ট বাস্ট। এবং দুটো গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দ। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মাটিতে শুয়ে পড়ে ভাবছি, কি হলো...? সরু একটা রিজলাইনে সবাই প্রায় এক সারিতে শোয়া।
সামনে গিয়ে দেখি আমিন স্যার, "আহ! শালারা বেচেঁ গেল" পথের বাঁকে একটা মাচাং ঘরের ঝুল বারান্দায় অস্ত্র হাতে পাহারারত সন্ত্রাসী আমাদের টহল দলকে দেখে গুলি করে। স্কাউট জবাব দেওয়ার আগেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নীচে। সন্ধ্যায় পেট্রোল বেসে সকল পর্যালোচনার পর সন্দেহ ঘনীভূত হয় তরুণ বন্দীর ওপর।
মেজর আমিন নিপুণ দক্ষতায় তরুণ বন্দীর কাছ থেকে স্বীকারোক্তি বের করে ফেলেন- শান্তিবাহিনীর একটা ক্যাম্প খুব কাছেই আছে। সে ক্যাম্প থেকে সকালে নীচে ছড়ায় নেমেছিলো মাছ ধরতে আর সবজি যোগাড় করতে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, শেষরাতে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন আমিন স্যার। সবার আগে তরুণ বন্দী, যদি গুলি আসে তবে সেই আগে মোকাবিলা করবে। অতএব সে আমাদেরকে ক্যাম্পের নীচে যেখানে রান্নার কাজ হয়, সে জায়গায় নিয়ে গেল। এখান থেকে খুব সরু এবং খাড়া ঢাল বেয়ে ক্যাম্পের সমতলে পৌঁছাতে হয়। তরুণ বন্দী এবার সতর্ক করলো মেজর আমিনকে, এই রাস্তাটির উপরের শেষ ধাপে একটি এলএমজি, একটি ওয়াই স্টীকের ওপর ফিক্সড লাইনে স্থাপন করা থাকে। ওই এলএমজি’র বাস্ট ফায়ারের সামনে পফলে নির্ঘাত মৃত্যু।
যেহেতু এটা শান্তিবাহিনীর ক্যাম্প নিশ্চিত হওয়া গেছে, তাই চার্জ করার আগে ওটার উপর মর্টার ফায়ার আনার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। শীতের কুয়াশা ডাকা ভোরের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে মর্টারের গোলাবর্ষণে।
আমাদের প্রত্যাশা ছিলো ক্যাম্পের উপর থেকে কোন পাল্টা ফায়ারের। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে বুঝলেন ক্যাম্পটা বোধহয় ওরা ছেড়ে গেছে। প্রথমেই তিনজনের একটি ক্ষুদ্রদল নিয়ে মেজর আমিন উপরে উঠে যান। উপরে উঠে ক্যাম্পের ছড়ানো ছিটানো মালামাল দেখে বুঝলাম ওরা গতকাল বিকালে অথবা সন্ধ্যা রাতে ক্যাম্প ছেড়ে গেছে।
এবার শুরু হলো ক্যাম্পের চারপাশে তল্লাশি। তরুণ বন্দী জানালো- দুটো অবজারভেশন পোস্ট আছে। আমি অতি উৎসাহে তল্লাশীর জন্য ৭/৮ জন সৈনিকসহ বের হয়ে গেলাম। আমার সঙ্গে নায়েক ইউসুফ খান ওরফে সুকুমার রায়। মেজর আমিন সদ্য ধর্মান্তরিত সুকুমারের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন তল্লাশি শেষে যেন আশেপাশের পাড়া থেকে 'গরু-ছাগল-মুরগী' যা পাওয়া যায় তাই কিনে আনে। গত চব্বিশ ঘণ্টা আমরা শুধু চিড়াগুড়ের উপরেই আছি।
আমিন স্যার চাচ্ছিলেন- দুপুরে একটা 'ভালো' খাবার হলে ফেরার পথে সৈনিকদের 'মরাল আপ' থাকবে। এবার তরুণ বন্দীকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওর নাম 'নিউটন'। ওর নাম শুনে আমি অবাকই হলাম! এই পদার্থ বিজ্ঞানী এখানে এই ঝাড়-জংগলে কিভাবে এলো।
মেজর (অব.) আমিন
বিজ্ঞান সম্পর্কে ওর ধারনা না থাকলেও পাহাড়ের অলি-গলি আর ফাকঁ-ফোকর সম্পর্ক ওর জ্ঞানের পরিচয় পাচ্ছিলাম, যখন ও আমাদের ছড়ায় নামিয়ে দেয়। আমি অনেকটা দিকভ্রান্ত হয়েছি বলে মনে হলো। নিউটন অভয় দেয়- এই সামনেই একটা পাড়া আছে। কিন্তু ছড়াতে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিলো- 'আমি ছড়ার মধ্যদিয়ে পথ চলছি, আমি ঠিক কাজটি করছি না'। কিন্তু সুকুমারের মাথায় গরু সংগ্রহের কাজটি প্রবল প্রাধান্য পাচ্ছিলো। তাই সেও ছড়ার মধ্যদিয়ে চলাকে অতটা গুরুত্ব না দিয়ে এগুতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে ছড়া থেকে উঠে আমরা একটি টিলায় উঠতে থাকি। টিলার উপর উঠতেই আমাকে লক্ষ্য করে ছোড়া দুটো গুলি আমাকে মিস করে আমার সামনের মাটিতে আঘাত করে।
বাতাসে ছুটে যাওয়া গুলির হুইসিং সাউন্ড আমার কানের এতই কাছ দিয়ে যায় যে, আমি অনুভব করছিলাম যেন কিছু গরম বাতাস আমার কানে ঢুকে গেছে। মুহুর্মুহু গুলির প্রতিধ্বনিতে প্রকম্পিত হতে থাকে চারপাশটা। আমরা শান্তিবাহিনীর এম্বুশে পড়ে গেছি বুঝতে পেরে আমি ওয়ারলেস অপারেটরকে খুঁজতে থাকি। কিন্তু তখন বুঝলাম আমার সঙ্গে যে ৮ জন সৈনিক আছে তাদের মধ্যে কোন সিগনাল অপারেটর নাই। কাছেই কোথাও যাচ্ছি বলে হাতের ইশারায় যে কয়েকজন সৈনিক আমাকে অনুসরণ করে তাদের মধ্যে কেউই সেট নিয়ে আসে নাই।
এখন কিভাবে বেসে আমাদের পেট্রোলের কাছে খবর পাঁঠাই যে, আমরা এম্বুশে পড়েছি এবং লোকেশন কোথায় তা কিভাবে জানাই? শান্তিবাহিনী অপেক্ষাকৃত উচু টিলা থেকে আমাদের ওপর ফায়ার দিচ্ছিলো। আমরা নীচে, আমাদের গুলি ফুরিয়ে যাচ্ছে- আমরা অনুভব করছিলাম। গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার আগে এবং সাহায্যকারী দল আসার আগেই আমাদের আরেকটু উঁচুতে উঠতে হবে, তা নাহলে ওরা আমাদের ওপর চার্জ করে নীচে নামলে আমাদেরকে করুন পরিণতি ভোগ করতে হবে।
সবাই একসাথে 'আল্লাহ আকবর' ধ্বনি তুলে একটা মরণপণ চার্জ করে বেশ উপরে চলে আসি। এবার আমরা শান্তিবাহিনীর সবুজ পোষাক পরা অনেক ক্যাডারকে দেখতে পাই। ওরা সংখ্যায় প্রায় বিশজনের মতো হবে। আমাদের সবার গুলি শেষ হতে চলেছে। কারো আছে এক ম্যাগাজিন, কারো দেড় ম্যাগাজিন। আমরা গাছের আড়াল থেকে কোন রকমে আত্মরক্ষা করে যাচ্ছি আর অপেক্ষা করছি কেও যেন আসে। মনে নানা দুশ্চিন্তা হচ্ছে- যদি সাহায্য আসার আগেই আমাদের গুলি শেষ হয়ে যায়, তবে কি হবে? কেন সেট আনিনি সে জন্যও অনুশোচনা হচ্ছে।
আমাদের উপর চার্জ করা ঠেকাতে কোন রকমে শান্তি বাহিনীর ওপর টুকটাক ফায়ার করে যাচ্ছি। এভাবে কত সময় পার হয়েছে জানি না, হঠাৎ আমাদের পিছনে টিলার নীচে 'বেবি টাইগার্স, বেবি টাইগার্স ডাক শুনতে পাই। শুনে আমাদের অবস্থান তাদের জানাই।
মেজর আমিন আমাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে পেরে দ্রুত শান্তিবাহিনীর উপর মর্টার ফায়ার দিতে দিতে উপরে চলে এসে তার টীম নিয়ে চার্জ করেন। আমার টীম একটা অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পায়। মেজর আমিন আমাদের সাহস দিতে থাকেন। আমি লক্ষ্য করলাম উনার পায়ে জংগল বুট নেই। খালি পায়ে শুধু অস্ত্রটি হাতে নিয়ে উনি সবার আগে দৌড়েছেন। উনার সারা পায়ে নানা ক্ষত স্থান দিয়ে অঝোরে রক্ত ঝরছে। উনি বিশ্রামরত অবস্থায় যখনই গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছেন তখনই হাতের কাছে রাখা শুধু এসএমজিটিই উনি নিয়েছেন। বুট পরে সময় নষ্ট না করে দ্রুত ছুটেছেন সহযোদ্ধাকে বিপদ থেকে উদ্ধারে।
আমি উনার ক্ষতগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, কত সময়ই আর লাগতো বুট পরে নিতে। কিন্তু উনার সহজাত প্রবৃত্তি উনাকে সে সময়টুকু নষ্ট করতে দেয়নি। সদ্যকাটা বাশেঁর গুড়ি, বেতকাটা অবলীলায় পায়ে দলে সম্মুখে ছুটেছেন গোলাগুলির আওয়াজকে লক্ষ্য করে। উনার মাথায় একটা চেতনাই কাজ করছিলো, আর তা হলো- To save a brother officer.
জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে চারদিকে যে স্বার্থপরতা দেখি তাতে মনে হয়, মেজর আমিনের মতো কোন সহযোদ্ধা এখনকার সময়ে আর তৈরী হওয়ার কতটুকু অবকাশ আছে??? "Brother in Arms" কথাটির অর্থ কি আমি সেদিন বুঝেছিলাম।
এমবি/এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।