ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

একটি এম্বুশ ও বেওয়ারিশ লাশ এবং একজন নবজাতকের গল্প

নাসিম হোসেন

প্রকাশিত : ১৩:৫৬, ৩১ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ১৪:৪৪, ৩১ আগস্ট ২০২০

সময়টা ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম ভাগ। শীতের শেষ বিকালের উষ্ণতাটুকু ধরে রাখতে পানছড়ি জোন অফিসার মেসের বারান্দায় পায়ের জঙ্গল বুট খুলে একটু আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছি। টানা একুশ দিন বান্দরবনে একটি হারানো অস্ত্র উদ্ধারের বিশেষ অভিযান শেষ করে আজই নিজ ইউনিটে ফেরত এসেছি। কোতে সৈনিকরা অস্ত্র জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত প্রায় ৬০ জন সৈনিকের দল দ্রুতই চেষ্টা করছে অস্ত্র জমা দিয়ে মেসে ঢুকতে। ব্যাটালিয়ন সার্জেন্ট মেজরের হাকঢাকে মেসের ঐ জায়গাটি বেশ সরগরম। 

এমন সময় চোখে পড়লো সাদা পোষাকে ডিউটি করা এক আনসার সদস্যকে। গোয়েন্দা কাজে নিয়োজিত সর্বোগামী এক ‘টিকটিকি’। আমি ইশারায় তাকে ডাকি। ও সামনে আসতেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাই। ‘স্যার এডজুটেন্ট রাজন স্যারকে খুজছিলাম একটা সংবাদ দিবো বলে।’
‘আমাকে বলো’- আমি আস্বস্ত করি।
টিকটিকি তার পেটের ভিতরে থাকা ব্রেকিং নিউজটি উগরে দিলো : 
‘২/৩ জনের একটি  সশস্ত্র দল একটি কিলিং মিশন নিয়ে টিএন্ডটি টিলার একটি ঘরে অবস্থান করছে। সন্ধ্যার আধাঁরে প্রতিপক্ষের এক প্রবীণ নেতাকে হত্যা করবে। ঐ গ্রুপের একজন সদস্যই খবরটি ফাঁস করেছে। সেও ওদের সাথে আছে। তার বর্ণনা পাওয়া গেল। অপারেশনের সময় তাকে সেইফ প্যাসেজ  দিতে হবে।’
বলো কি? বাঘের ঘরে ঘোগের বাস?
আর্কিমিডিসের মতো নগ্ন দেহে না হলেও নগ্ন পায়ে ছুটে গেলাম রুমে। মনের মধ্যে ক্রমাগত বেল আইকন বেজে চলছে -‘ইউরেকা’, ‘ইউরেকা’,‘ইউরেকা’।

খুলে রাখা জঙ্গল বুট আবার তার স্থানে ফিরে এলো। ওয়াকিটকিতে ব্যাটালিয়ন সার্জেন্ট মেজরকে দ্রুত একটি ‘সি’ টাইপ পেট্রোল রেডী করতে বললাম। টিকটিকির কাছ থেকে টার্গেটের বিশদ জেনে নিলাম। টিএন্ডটি টিলা জোন থেকে এক কিলোমিটার দূরে পানছড়ি বাজার সংলগ্ন খুব ঘনবসতিপূর্ণ বাঙালি-পাহাড়ি অধ্যূষিত একটি মিক্সড কলোনি। পাড়াটি আমার খুবই চেনা। টার্গেট চিনতে অসুবিধা হলো না।

৫/৭ মিনিটের মধ্যেই বিএসএম হাজির হলো তার টীম নিয়ে। ছোটখাট ব্রিফিং দিলাম। গত ২০/২১ দিন ওরা আমার সাথে ওপারেশন ট্রেজার হান্ট করে এসেছে। ওরা সবাই আমার ‘মোডাস ওপারেন্ডী’ সম্পর্কে জানে। অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধে ওরা ক্ষুধার কথা গেল ভুলে।

যেতে যেতে ভাবছি এতটা সাহস ওরা পায় কিভাবে। জোন সদর থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরের বাজারে ওরা কোন দুষ্কর্ম করে গেলে আমাদের তো মাথা হেট হয়ে যাবে।

দু’দিক থেকে এপ্রোচ করে ‘টার্গেট’ ঘরে পৌঁছেই সজোরে এক লাথিতে দরজার কপাট ভেঙে ঢুকে পরলাম ভিতরে । মূর্তিমান যমদূতের মতো তিন সেনা সদস্য। দেখা মিললো কিলিং মিশনের তিনজনের। সাথে তাদেরই এক গাদ্দার সহযোগীর। অপারেশনে যাবার পূর্বে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি চুয়ানীর মদির নেশায় মগ্ন।

একেবারেই সাদামাঠা এক অ্যাকশন মুভির খণ্ডিত দৃশ্য। ঘরের এক কোনায় বাজারের ব্যাগের ভিতর তিনটি ক্ষুদে অস্ত্র। কিলিং মিশনের সদস্যদের দ্রুত ওপস (ওপারেশন) রুমে আনা হলো। তখনো যেন ওদের বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। পাহাড়ি দারুর (মদ) শেষ চুম্বনটুকু দেওয়া হয়নি। অতঃপর প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে স্বীকার করলো সবই। শীতের এই সন্ধ্যায় কে আর জামাই আদর চায়। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে জোন অধিনায়ক ওদের পুলিশে হস্তান্তর করে দিতে বললেন। কিন্তু আমার মধ্যে ‘উত্তর নালকাটার’ অধিবাসী এই ‘ব্যাডবয়’দের কাছে আরো তথ্য আছে এইরকম একটা ‘সিক্সথ সেন্স’ কাজ করছিল। আমি বললাম, ‘স্যার একটু দেখি’।

খাগড়াছড়ি- পানছড়ি সড়ক সংশ্লিষ্ট নালকাটা আর্মি ক্যাম্পের উত্তরে কয়েক কিলোমিটার দূরের এক পাহাড়ি গ্রাম ‘উত্তর নালকাটা’। এটা সদা বিবদমান দুই পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপের জন্য ‘গোলান হাইটের’ মতোই স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। নিত্যদিন এখানে তাদের আনাগোনা। চাদাঁ আদায়ের বিট। এসব খবর আগে থেকেই জানা ছিল।

ওই এলাকার অধিবাসী হিসাবে ওরা কি কিছু জানবে না? মনের মধ্যে এ রকম একটা প্রশ্ন নিয়ে আবার ওদের সাথে বসলাম। ওরা জানালো ইউপিডিএফ’র  দশ-বারো জনের একটি গ্রুপ প্রায়শই এলাকায় আসে সারাদিন পাড়ায় অবস্থান করে সন্ধ্যায় চলে যায়। কোথা থেকে আসে কোনদিকে চলে যায় তা কেও জানে না।

ওদের কার্যকলাপ, জনবল, অস্ত্র আসা যাওয়ার সময় সম্পর্কে কিছু সাধারণ তথ্য পাওয়া গেল। কিন্তু তা ওদেরকে এম্বুশে ফেলার মতো সুনির্দিষ্ট নয়। তারপরও আজকের সন্ধ্যার সাদামাঠা এই একশন মুভির বাকী অংশটুকুর চিএায়নের জন্য ঐ রাতেই একটি এম্বুশের সিদ্ধান্ত নেই।

অধিনায়ককে জানালাম আদ্যপ্রান্ত সবকিছু। বললাম চান্স ‘৫০:৫০’। উত্তেজনার বশে তিনিও শামিল হবেন জানালেন।

সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলোঃ নালকাটা ক্যাম্প লন্চিং প্যাড। চারজন অফিসারের সমন্বয়ে চারটি বি টাইপ পেট্রল। স্টার্ট টাইম রাত ১২টা।

মধ্য রাতের পর ডিসেম্বরের তীব্র শীতের কামড়কে অগ্রাহ্য করে ঘন কুয়াশার চাঁদর ভেদ করে চারটি গাড়ীর একটি বহর নিয়ে পার্কিং লাইটের আলোর উপর ভর করে বেরিয়ে পরলাম। আজ আমাদের হাতে কারো মৃত্যু পরওয়ানা। শরীরে তাই মৃদু উত্তেজনা।
 প্রিয় জগজিৎ সিং এর একটি গানের কলি উওেজনাকে আরো একটু বাড়িয়ে দিলোঃ
‘আজ কিছু হতে চলেছে
আজ কিছু হতে চলেছে’

নালকাটা ক্যাম্পে এসে দ্রুত চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। ক্যাম্প সংলগ্ন পাড়াগুলি এড়াতে হিম শীতল ছড়ার পানিতে পা ভেজাতে হলো। নিকষ কালো অন্ধকারে পথ চলতে গিয়ে এল এমজি ম্যানগুলো প্রায়ই ধপাস ধপাস করে পরে রাতের নিস্তব্ধতা কে ভাঙছিল।

চরম সতর্কতা ছিলো পথ সংলগ্ন বাড়ির পোষা কুকুরগুলোর নিদ্রা ভঙ্গ নিয়ে। যদি এরা সেনাবাহিনীর টহল দলের উপস্থিতি টের পায় তবে তাদের গগন বিদারী চিৎকার  ফাইভ জি’র চেয়েও দ্রুতগতিতে মঙ্গলগ্রহ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। 

একটি কুকুরের এরকম একটি উচ্চনিনাদ এই টিলা থেকে ঐ টিলায় ‘শেয়ার’ হতে হতে বহু দূরের কোন গ্রাম বা পাড়ায় পৌঁছে যায়। আর এরকম আর্তনাদের অর্থ খুঁজতে শীতের রাতে খুস খুসে কাশিতে ঘুমাতে না পারা পাড়ার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে কৌতূহলী করে তুলে বেড়ার ফাকঁ দিয়ে বাহিরে  ভিউ করতে। যা শত্রু পক্ষের কাছে নানা উপায়ে পৌঁছে যেতে পারে। আপনার সকল প্রস্তুতি পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে এরকম ট্র্যাডিশনাল সিকিউরিটি সিস্টেমের কারণে।

এম্বুশে গোপনীয়তা অন্যতম প্রধান শর্ত। যে কোন মূল্যেই তা রক্ষা করতে হবে। পাহাড়ের ঢালে একটি সরু রাস্তায় এসে পরেছি। তখনই সকলেই তটস্থ হয়ে গেলাম স্বল্প দূরে কিছু টর্চের আলো দেখে। ‘এরা কারা?’ এই প্রশ্ন সবার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি ওদের কাছে আসার। মনে হলো তিনজন লোক কিছু একটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।  
‘শুকর শিকারি নয়তো?’
কেও একজন মন্তব্য করলো।

ওরা টিলা বরাবর উপরে আসতেই বোঝা গেল বিষয়টি কী:
একটি বড় বাশেঁর ঝুড়িতে আধ কাত হয়ে শুয়ে আছে এক নারী। বাশঁ দিয়ে ঝুড়িটাকে দু’দিক থেকে বেধে একটা ‘মেক শিফট’ স্ট্রেচার বানিয়ে তাতে এক প্রসব বেদনায় কাতর নারীকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ‘স্বামী- দেবরের তিনজনের এক ক্ষুদ্রদল’। 
একগাদা প্রশ্ন ওদের দিকে:
‘কোন আদামত তুন তুই এজজ্যস?’
‘মিলিবো  কি হুইয়ে?’
‘হুদু জেবর তু?’

পাহাড়ি চাঁদের ঢাকা তরুণী বধূর অস্ফুট কান্নার মাঝে জানা গেল সন্ধার পর থেকে প্রসব বেদনায় কাতর বধূকে নিয়ে যাচ্ছে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে। ওরা কোন যানবাহন না পেলে হেঁটেই চলবে। যদি বাঁচে তবে ভগবানের কৃপা। 

আমি বিস্ময় প্রকাশ করে বলি, ‘সে তো বহু দূরের পথ।’!
ক্যাম্প থেকে স্পষ্ট ১৬ কিলোমিটার রাস্তা। এতো দূরের পথ পাড়ি দিতে কত ঘণ্টা লাগবে তা সহজেই অনুমেয়। পাহাড়ে এতো রাতে যানবাহনের প্রত্যাশা করা আর স্বয়ং ভগবানের দেখা মেলা একই  কথা।
‘কি খরবো মূই এলান গরীব মানুজ’
অসহায় স্বামীর দিশাহীন উত্তর।
বিরক্তিবোধ করছিলাম ওদের সাথে মুখোমুখি এড়াতে না পেরে। ভাবছিলাম আমাদের অপারেশনের গোপনীয়তা বোধহয় আর থাকলো না। 

আর এই প্রসব বেদনাকাতর নারীর ব্যাথায় নীল হয়ে যাওয়া মুখ আমাদের একটা দোটানায় ফেলে দিলো- 
‘কি করি, কি করি?’
এটা ভাবতে ভাবতেই কে যেন অন্ধকারের মধ্যে বলে উঠলো:
‘স্যার, মেয়েটাকে হসপিটালে না পাঠালে বাচঁবে না’
 সৈনিকদের মধ্যে ‘মাদার তেরেসা’র কণ্ঠ!

আমাদের বয়ে আনা গাড়িগুলো তখনোও সড়কের উপর অপেক্ষা করছে। ওদের উপর আদেশ ছিল আমরা চূড়ান্ত মিলন স্থানে পৌঁছালে আমাদের সংকেত পেয়ে তবেই ফেরত যাবে।

‘ধনঞ্জয়কে অনুচ্চ স্বরে কাছে ডাকলাম। তীব্র শীতেও ওর ঘর্মাক্ত গা। গায়ের শার্টকে কুণ্ডলি পাকিয়ে কাধেঁর উপর রেখে ভার বহনের কাজে লাগিয়েছে। ওর মুশকিল আসানের পথ বলে-‘মূল সড়কে পৌঁছে আর্মির গাড়ি পাবে, ওরা তোমাকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যাবে দিলাম।’ অন্ধকারের মধ্যেও নালকাটা নিবাসী ধনঞ্জয় চাকমার হাসির রেখাটি স্পষ্টই দেখা গেল। 

এবার চারটি দল বিভক্ত হয়ে নিজেদের এম্বুশ পয়েন্টের দিকে রওনা হলাম। এটা একটা অনুমান নির্ভর এম্বুশ প্ল্যান। শত্রু আসতেও পারে নাও আসতে পারে। যে চারটি  আগমনের পথে এম্বুশ পার্টি বসবে তাও ম্যাপ নির্ভর। আগে রেকি করাছিলো না। সঠিক অবস্থানে গিয়েছি কিনা তা বোঝা যাবে ভোরের আলো ফুটলে। 
পরিকল্পনা ছিলো রাতে যতটা সম্ভব পজিশন এডজাস্ট করে খুব ভোরের আলোর অপেক্ষায় থাকবে। 
তিনটি শর্ত: ‘রেডিও সাইলেন্স’, ‘নো লাইট’ এবং ‘নো মুভ’ সবাইকে মানতে হবে। 

সব পাড়াবাসীকে এম্বুশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত  Stay home Stay safe এই বাণী পৌঁছে দিতে হবে। ঘর থেকে বের হতে দেওয়া যাবে না। এই লকডাউনটি করতে হবে ক্রশ ফায়ারের সংক্রমণে কোন নিরীহ পাড়াবাসী যেন আক্রান্ত না হন তা নিশ্চিত করতে। এম্বুশের সময়কাল সকাল ৬টা ৪৫ মিনিট নির্ধারণ করে আমরা ‘রেডিও সাইলেন্সে বা বেতার নিরবতায়’ চলে গেলাম। কুয়াশা হাতড়ে হাতড়ে নিজের অবস্থান নিলাম। এবার অপেক্ষার পালা। 

হঠাৎ করে থেমে যাওয়া শরীরের উপর শেষ রাতের শীত উওর মেরুর তীব্রতা নিয়ে উত্তর নালকাটায় হাজির হলো। অটোমেটিক অস্ত্রগুলি শত্রু আগমনের পথের উপর নিখুঁত নিশানায় রেখে আমাদের কাউন্টডাউন শুরু হলো।

‘টাস, টাস, টাস’ এসএমসি’র একটি নাতিদীর্ঘ বাস্ট ফায়ারে মাধ্যমে আমাদের ভোরের তন্দ্রা ছুটে গেল।
হতচকিয়ে গেলাম, ‘এটাতো আমাদের অস্রের শব্দ নয়।’ আমরা এম্বুশে আছি শত্রু ফাদেঁ আসলে আমাদের অস্ত্রই তো আগে ওপেন করবে। তবে কি আমাদের কোন দল আক্রান্ত হলো? 

পর মুহূর্তেই আমাদের উপদল-২ এর অস্ত্রের গর্জন শোনা গেল। চির পরিচিত একে ৪৭ এবং এলএমজির দ্বৈত গর্জন শুনে ঠাহর করতে পারলাম ওদের অবস্থান ঠিক কোন দিকে।

‘হ্যালো আলফা-১ ফর আলফা-২ ওভার’ রেডিও সাইলেন্স ভেঙে  উপদল-২ এর ওয়ারলেস ওপারেটরকে ক্রমাগত ডাকতে লাগলাম। আলফা-২ নিরুত্তর। 

আমরা আমাদের অবস্থান কিছুটা এডজাস্ট করে উপদল-২ এর কাছাকাছি গেলাম। এরই মাঝে উপদল-৩, এবং উপদল-৪ এর লোকেশন থেকেও গুলির আওয়াজ পেলাম। ওদের বলা হলো উপদল-২ যে রিজ লাইনে আছে সে দিকটাকে ফায়ার দিয়ে আচ্ছাদিত রাখতে। উদ্দেশ্য শত্রুকে এম্বুশ সাইটে আটকে রাখা। এভাবে বিশ পঁচিশ মিনিট ধরে বিভিন্ন অস্ত্রের গুলি বিনিময়ের এক কনসার্ট চললো। 

ততক্ষণ সূর্যের আলো রিজ লাইনের বৃক্ষের মাথা ছুঁয়েছে। কুয়াশার ঘন চাদরে পাহাড়ের পাদদেশটা তখনও ঢাকা। আর এই চাদরের নিচে আছে কর্দমাক্ত জলাভূমি। এখানে প্লানজিং ফায়ারের কারণে আমাদের গুলি ততটা কার্যকরি হয়নি। আর এইটাই ‘উত্তর নালকাটার ব্যাডবয়দের জীবনের আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে দেয়। আরো কিছুদিন বেচেঁ থাকার জন্য আশির্বাদ হিসাবে থাকা কুয়াশার চাঁদরের নিচ দিয়ে ওরা বেড়িয়ে যায় আমাদের পাতা মৃত্যু ফাঁদ থেকে।

না, সকলেই এমন ভাগ্যবান হয়নি। 
সূর্যের আলো আরো প্রখর হলে সকলের তল্লাশিতে পাওয়া গেল এক হতভাগার বুলেট বিদ্ধ লাশ। ‘দলদলে’ মুখ থুবড়ে পড়েছিলো সে। ‘থ্রী নট থ্রী’র গুলি ওর পিঠে বিশাল এক ক্ষত চিহ্ন রেখে বের হয়ে গেছে। ওর এই ক্ষত চিহ্ন আমাদেরও ধাঁধায় ফেলে দিলো এই থ্রী নট থ্রী গুলি কে করলো? সেনাবাহিনীতো এই অস্ত্র ব্যবহার করে না। উপদল-২ এর ক্যাপ্টেন তোফায়েল জানালো ওরা ব্যাডবয়দের পালানোর  রাস্তায় যেসব গুলির খোসা কুড়িয়ে পেয়েছে তার মধ্যে থ্রী নট থ্রী ও রয়েছে।

কিন্ত আপাতত এই ফরেনসিক এনালাইসিস বাদ দিয়ে এই হতভাগার লাশ উদ্ধার এবং তার পরিচয় উদঘাটনে মগ্ন হলাম। ততক্ষণে পাড়াবাসী লকডাউন ভেঙে বের হয়ে আসছে। ‘দাবা’ মুখে নিয়ে ‘গুরুং গুরুং’ আওয়াজ তুলে বৃদ্ধ বৃদ্ধাগণ দরজার চৌকাঠে বসে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো। 
বয়:জৈষ্ঠ্য কয়েকজনকে এনে দেখানো হলো হতভাগার লাশ।

‘মূই ন চিনি’, ‘মূই ন জানি’, ‘মূই ন জানং’। মাথা ডানে-বামে দোলাতে দোলাতে নির্বিকার ভঙ্গিতে দায় সারে। আইডেন্টিটিফিকেশন প্যারেডটি গভীর আগ্রহের সাথে পরিচালনা করছিলো সহযোদ্ধা কোর্সমেট  জিয়াদ। ওদের নির্বিকার ভাবলেশহীন উত্তরে সে তিতি বিরুক্ত-‘ব্যাটা এমন মরা মরলি, তাও আবার থ্রী নট থ্রী র গুলি খাইলি, এখন তোরে কেও চেনেও না, কান্ধেও নিবে না’।

যেন সব দোষ ঐ থ্রী নট থ্রী গুলির, অন্য অস্ত্রের গুলিতে মারা পরলে ওর অমর্যাদা হতো না।
চারজন সৈনিকের কাধেঁর উপর ভর করে এই বেওয়ারিশ ব্যাডবয়কে উপরে তোলা হলো। বাংলা ছবির শেষ দৃশ্যের মতো পুলিশ এসে হাজির হলো।

ততক্ষণে বেলা অনেক গড়িয়েছে সূর্য প্রায় মাথার উপরে। কারোরই সকালে কিছু খাওয়া হয়নি। ক্যাম্পের উদ্দেশে দ্রুত যাত্রা করলাম। উপদল-২ এর লিডার তোফায়েলের কাছে শোনা গেল কেন সকালে ঐ ‘টাস, টাস’ শব্দ আমরা আগে শুনেছি: এম্বুশ অফিসিয়ালি ‘কলড অফ’ হওয়ার মিনিট দুয়েক আগে উপদল-২ এর মূল লক্ষ্যবস্তুর উপর স্হাপিত এল এম জি ম্যান ‘এম্বুশ শেষ’, ‘সব ফকফকা’, ‘সব দেখা যায়’ এমনভাব নিয়ে ফায়ার পজিশনের শায়িত অবস্থা থেকে একটু সরে বসে প্রস্রাব করছিলো। ওরা নিজে থেকেই স্ট্যান্ড ডাউন হয়ে গিয়েছিল।
  
ঠিক তখনই ১২জনের ইউপিডিএফের ঐ দলটি আকাঁবাকাঁ রিজ লাইন ধরে আসছিলো উপদল-২ বরাবর। 
৩০/৪০গজ দূরে থাকতেই ওদের চাদর মুড়ি দিয়ে পথ চলা স্কাউট পথের মাঝ বরাবর সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখে ভড়কে যায়। ও বেটা এল এম জি গ্রুপ কে পিন ডাউন করার জন্য  হাতের স্টেনগান দিয়ে বাস্ট ফায়ার করে।

আমাদের টহল দলও ওদের দেখে কিন্ত শত্রু দেখার পর বেসিক ড্রীল : ড্যাশ, ডাউন, ক্রল, কাভার এন্ড ফায়ার করতে যেয়েই যে সময় ক্ষেপণ হয়েছে তাই ওদের জন্য জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য বয়ে আনে। সেনাবাহিনীর কাছ থেকে একটা ড্রপ ক্যাচে লাইফ পাওয়া ইউপিডিএফ র দলটি উসাইন বোল্টের চেয়েও দ্রুত গতিতে দৌঁড়ে পালাতে থাকে।

বারো জনের দলটি প্রথমে চারিদিকে সেনাবাহিনীর ঘেরাটোপে পরলেও পরবর্তীতে নিজেদেরকে যেভাবে পারে এই কৌশল অবলম্বন করে পালাতে থাকে। চালাতে থাকে লক্ষহীন গুলি। 

ওদের লোকাল নলেজ বা এলাকার অলি-গলি সম্পর্কে জ্ঞান ভালো থাকায় ওরা আমাদের কারেন্ট জাল কেটে বের হয়ে যায়। তবে ঐ হতভাগার কারণে বারোজনের দলটি একটি বেজোর সংখ্যার দলে পরিণত হয়। একটি নিশ্চিত টার্গেট শেষ মূহুর্তে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় আমরা হতাশ ছিলাম।

নালকাটা ক্যাম্পে ফিরে এলাম। সড়ক থেকে মাটির ধাপ কাটা সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। সড়কের ওপাশেই চেক পোস্টের নোয়ানো বাশঁ। এখানেই থামে এ পথে চলাচলকারী সকল যানবাহন। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখা মাত্রই ‘স্যার, নমস্কার স্যার’ ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়াই।

চাঁদের গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে গতরাতের অনাকাঙ্ক্ষিত ‘ধনঞ্জয়’। কাছে এসে হাত কপালে ঠেকিয়ে পুনরায় নমস্কার করে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে - 
‘স্যার, আমার একটা ছেলে হইছে’। 
পানের রসে সিক্ত তার ঠোঁটের দুইপ্রান্ত, অমলিন হাসিতে ভাসছে তার সারা মুখ।
এতক্ষণ পর্যন্ত চিন্তা চেতনা ডুবে ছিল বেওয়ারিশ লাশ আর এম্বুশের ফলাফল নিয়ে। ধনঞ্জয়ের স্ত্রীর কি ঘটেছে তা আর জানা হয়নি।

ধনঞ্জয়ের স্ত্রীকে নিয়ে একটি পিকআপ ছুটে গিয়েছিল সদর হাসপাতালের উদ্দেশে। নালকাটা ক্যাম্পে অবস্থান করা অধিনায়কের নির্দেশে খাগড়াছড়ি রিয়ার ওসি’র সক্রিয়তায় সদর হাসপাতাল দ্রুতই ব্যবস্থা নেয় ধনঞ্জয়ের স্ত্রীর ডেলিভারির। মধ্যরাতে বাংলাদেশের বাস্তবতায় ডাক্তার নার্সের দেখা মেলা কতটা রাজসিক তা গরীব না হলে কেও বুঝবে না। মধ্যরাতে গাড়ি আর ডাক্তার দুটোই ভগবান সম।

ধনঞ্জয়কে দেখে মনে হলো না গতরাতে ওর পাড়াতে যে ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেছে তার কোন রেশ তার মধ্যে আছে। আমরা দুজন মুখোমুখি। আমার হাতে মৃত্যু সনদ। ওর হাতে জন্ম সনদ।
ধনঞ্জয়কে কিছু বলতে হয়। আমি তড়িঘড়ি করে বলি, ‘খুশি হলাম’। 
‘তা কি নাম রাখবে ছেলের?’ আমি কিছু না ভেবেই বলি।
‘কি নাম হলে ভালো হবে স্যার’? ধনঞ্জয় আমার কাছেই জানতে চায়, ‘তু এহান নাম দিলে ভালো অবো’।
‘মৃত্যুঞ্জয়’। আমার ভাবনাহীন উত্তর।
ধনঞ্জয় বিড় বিড় করতে থাকে ‘মৃত্যুঞ্জয়, মৃত্যুঞ্জয়’। 
আমারও ইচ্ছে হচ্ছিলো অদূরে বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে খাগড়াছড়ির মর্গে যাবার জন্য প্রস্তুত ঐ হতভাগার নাম কি তা ওকে জিজ্ঞাসা করি। আমাদের পেয়ে ধনঞ্জয়ের ছেলে গতরাতে মৃত্যুকে জয় করেছে। আর আমাদেরই পাতা ফাদেঁ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে আরেকজন।
এক যাত্রায় দুই ফল। সবই ভগবানের ইচ্ছে।

লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি