ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে’

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ২০:০১, ১ ডিসেম্বর ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

বিজয়ের মাস এসো গেলো- আজ পহেলা ডিসেম্বর। উনপঞ্চাশ বছর আগে ১৬ ডিসেম্বর ন’মাসব্যাপী একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম স্বাধীনতার লাল সূর্য্যকে। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। সে বিজয় শুধু একটি ভূখন্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর- সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি ইতিহাসের। সে বিজয় তো সীমাবদ্ধ নয় একটি দিবসে- তা অনুরণিত প্রতিদিন, প্রতি পলে, প্রতি প্রাণে।

স্বাধীনতার একটি অন্তর্নিহিত মাত্রিকতা আছে, তবে স্বাধীনতা কোনও বিমূর্ত ধারণা নয়। অন্যদিকে বিজয়েরও একটি বহি:মাত্রা আছে, কিন্তু বিজয় তো বোধের। সুতরাং বিজয় বা স্বাধীনতা শুধু উদযাপনের নয়, চেতনারও। এবং সেই চেতনা ধারণ করতে হবে বর্ষব্যাপী, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে- যারা ১৯৭১ দেখেছি, তাদের এবং যারা দেখেনি, তাদেরও।

আমরা যারা বিজয় দেখেছি, তাদের একটি অংশ সেই চেতনাকে ধারন করে রাখতে পেরেছি। কিন্ত সেই সঙ্গে এটাও তো সত্য যে আমরা অনেকেই সেই চেতনা বিস্মৃত হয়েছি, এবং আমাদের কেউ কেউ বেপথুও তো  হয়েছি। স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখেছে, কিন্তু স্বীকার করে নি, তাদের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের চেতনাকে আমরা যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সাক্ষী, তাদের জন্য নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হবে।

আসলে পুরো প্রেক্ষিতটি অনেক বেশী তাৎপর্য্যপূর্ণ আমাদের তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যারা বিজয় দেখেনি। তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনেছে, কিন্তু দেখেনি। মু্ক্তিযুদ্ধ তাদের কাছে হয়তো একটি কল্পকাহিনী, বিজয় তাদের কাছে সুদূর অতীতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তরুণ প্রজন্মের একটি আবেগী কিংবা একটি বস্তুনিষ্ঠ যোগ সবসময় নাও থাকতে পারে। 

কারণগুলো সঙ্গতই- হয়তো কেউ তাদের বিষয়টি ঠিকভাবে বলেনি, কিংবা তাদের পাঠ্যক্রমে তা অনুপস্থিত থেকেছে বা বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ অবস্থায় বিভ্রান্তিমূলক ধারণারও জন্ম হতে পারে সহজেই।

বেদনার সঙ্গে বলতে হয় যে, আজকের বাংলাদেশে এ অবস্থাটির কমতি নেই এবং সেটা শঙ্কাজনক। এ প্রবণতা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধারণ করবে না বিজয়ের সত্যিকারের চেতনা, জানবে না মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। ভবিষ্যতের দিনগুলোতে আমাদের জাতি সত্ত্বার অহংকার, আমাদের ঐতিহ্যের ইতিহাস, আমাদের চেতনার ভিত্তি বিলুপ্তির পথ এ প্রক্রিয়া প্রশস্ত করে দেবে।

কিন্তু এ চেতনার শিক্ষা, এ ইতিহাসের জ্ঞান বিমূর্তভাবে কিংবা দার্শনিকভাবে হয় না। নানান প্রতীকীর ব্যবহার, নানান বাস্তব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে। এই যেমন, বিলেতের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মারক পপি ফুলের নকশা থেকেই লন্ডনে বিজয়ফুলের কল্পনাটি এসেছিলো বাংলাদেশের বিজয়কে স্মরণ করতে।

বিজয়ফুলে বিজয় স্মরণ ধারণাটির ব্যপ্তি বিস্তৃততর ও গভীরতর। মৌলিকভাবে বিজয়ফুল আমাদের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পরে বাঙ্গালী জাতির ঐতিহাসিক বিজয়ের এক উজ্জ্বল প্রতীক এবং স্মারক- এর মাধ্যমে আমরা আমাদের বীর মুক্তিযাদ্ধাদের এবং তাঁদের অবদানের কথা স্মরণ করি। আমাদের  প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাই তো এক একটি বিজয়ফুল। 

বিজয়ফুলে বিজয় স্মরণ একটি পন্থাও বটে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের কথা বলতে পারি- বিশ্ববাসীর কাছে। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও তাঁদের শেকড়ে নিয়ে যেতে পারি। সেইসঙ্গে আমরা সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে পারি। সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে চেনানোর জন্যে এবং বিদেশীদের কাছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় ব্যাখ্যার জন্যেও তো এ প্রক্রিয়ার তুলনা নেই।

বিজয়ফুলে বিজয় স্মরণ প্রক্রিয়া মানুষের সঙ্গে মানুষকে সর্ম্পৃক্ত করে যৌথ চেতনার সৃষ্টি করে। অবাক মানি যখন দেখি, ছোট-বড় সবাই মিলেমিশে কত সহজে বিজয়ফুল বানায়- কেমন করে শিশুরা তা বানানো শেখে, কেমন করে পরিবারের সবাই মিলে গোল হয়ে এ কাজে মত্ত। সঙ্গে সঙ্গে চলে গল্প- দেশের, ইতিহাসের, মুক্তিযুদ্ধের। তারপর সে পুষ্প পরা হয় পোশাকের ওপরে বুকের বাঁ পাশে। সেটা শোভা পায় বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের ১ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত।

আজ এই প্রতীকী বিজয় ফুলের আরও একটি বড় ভূমিকা আছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় চার নীতি আমরা বিস্মৃতপ্রায়- ভূলুণ্ঠিতও বয়েছে কোনও কোনও নীতি। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও মানুষের মুক্তির চেতনা। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের সার্বিক মুক্তি এবং সেই লক্ষ্যে স্বাধীনতাকে তিনি দেখেছিলেন আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে। বিজয় ফুলের পাঁচটি সবুজ পাপড়ির চারটি সেই চার নীতি- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায্যতা হিসেবে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক হতে পারে। পঞ্চম পাপড়িটি বোঝাক না কেন রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে? আর মাঝের লাল সূর্যটি? ওটা প্রতীকী হয়ে থাকুক মানবিক মুক্তির। 

প্রশ্ন জাগে- কেন একদল প্রবাসী মানুষ পাগলপারা হয়ে বিজয়ফুলের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমার মনে হয়, এর পেছনে তিনটে কারণ ছিল। প্রথমত: এ মানুষগুলোর প্রত্যেকেই এক টুকরো বাংলাদেশ তাঁদের হৃদয়ে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন। সুতরাং সময় যখনই যেখানে তাঁদের নিয়ে গেছে, তাঁরা যেভাবেই পারেন, ঐ টুকরোটিকে ছড়িয়ে দিতে চেয়ছেন চারদিকে সবার মাঝে। 

দ্বিতীয়ত: এঁদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম এবং একাত্তরের সন্তান। সুতরাং তাঁরা সবসময়েই চেয়েছেন যাতে আমরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভুলে না যাই এবং ঐ বীরদের যথাযথ স্বীকৃতি ও যোগ্য মর্যাদা দেই। 

তৃতীয়ত: তাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন যে আমাদের মুক্তিযদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস জাগরুক থাকুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। তাঁরা সচেষ্ট ছিলেন যাতে প্রবাসে আমাদের ভবিষ্যৎ সন্তানেরা তাদের শেকড় হারিয়ে না ফেলে।

দেশের বাইরে এ জাতীয় উদ্যোগ একটি অঙ্গীকার থেকেই জন্ম নেয় এবং অনাবাসীরা এভাবেই দেশের জন্যে কিছু একটা করেন। এসব সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল চিন্তা-ভাবনা ও কাজের কোনও তুলনা নেই। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কিংবা বিজয়ফুল এ জাতীয় দু’টো উদ্যোগ। অনাবাসীদের নানান কর্মকান্ডে দেশের প্রতি তাঁদের অনন্য ভালোবাসা এবং দেশের জন্যে কিছু একটা করার ইচ্ছেটাই মূর্ত হয়ে ওঠে। এসবের মাধ্যমে বিদেশও দেশকে চিনতে পারে। বিদেশের এ সব কর্মকান্ড প্রশংসিত ও সমর্থিত হওয়া উচিত। বিদেশে যারা এ জাতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তাঁদের এমন কর্মকান্ডের স্বীকৃতি বড় দরকার। 

শেষের কথা বলি। বিজয়ফুলে বিজয় স্মরণ ধারণ করে আছে আমার দেশ, তার ইতিহাস, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার ঐতিহ্য আর মূল্যবোধ আর আমি ধারণ করে আছি সে প্রক্রিয়া সারা বছর আমার হৃদয়ে - ওটাই তো আমার অঙ্গীকার।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি