ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস স্থায়ী সমাধান নয়

প্রকাশিত : ১৯:০৯, ২৯ অক্টোবর ২০১৮ | আপডেট: ১৯:২৬, ২৯ অক্টোবর ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

হৃদ রোগ বর্তমানে বড় একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রোগের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। এই রোগের চিকিৎসায় সাধারণত এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস করা হয়। তবে, এই এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস স্থায়ী সমাধান নয়। 

একসময় মনে করা হতো, হৃদরোগ হয় শুধু ধনীদের। তারা দামি দামি এবং অতিরিক্ত তেল চর্বিযুক্ত খাবার খায় বলে তাদের এ রোগ হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখা গেলো যে, করোনারি হৃদরোগের উপরোল্লিখিত ঝুঁকিগুলো যার জীবনে বিদ্যমান, তারই এ রোগ হতে পারে-সে ধনী গরিব নারী পুরুষ যে-ই হোক, তার সামাজিক অবস্থান যেমনই হোক।

একবিংশ শতকে এসে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান আজ অনেক এগিয়ে গেছে। চিকিৎসাব্যবস্থায় এখন যোগ হয়েছে বিভিন্ন ধরনের উন্নত প্রযুক্তি। হৃদরোগ চিকিৎসার বেলায়ও কথাটা সত্যি। এই চিকিৎসাও রোগীর উপসর্গ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট অনুসারে একেক রোগীর জন্যে একেক রকম। কেউ একজন যখন আমাদের কাছে এসে বলেন যে, একটু হাঁটলে বা পরিশ্রম করলে কিংবা সিঁড়ি বেয়ে উঠলে তার বুক ব্যথা হচ্ছে, তিনি বুকে চাপ অনুভব করছেন, এই ব্যথা আবার ছড়িয়ে যাচ্ছে অথবা দাঁতের গোড়া অবধি বা পিঠে, বাম হাতে যাচ্ছে, তখন প্রাথমিকভাবে আমরা এগুলোকে করোনারি হৃদরোগের উপসর্গ বলেই ধরে নিই।

করোনারি হৃদরোগের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে রোগীকে আমরা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে থাকি। এর মধ্যে প্রথমেই আসে ইসিজির কথা। অনেকেরই ধারণা, ইসিজি স্বাভাবিক তো সবই ঠিক আছে, হৃদরোগ নেই। আমিও একসময় তা-ই মনে করতাম। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে ঠিক তা না। আমার নিজের এই ভুল ভাঙালো এক রোগীর এটেনডেন্ট। আমরা ডাক্তাররা বই পড়ে যা শিখি, কখনো কখনো তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখি রোগী এবং রোগীর এটেনডেন্টের কথা শুনে।

২০০০ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। আমি তখন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে কার্ডিওলজিতে এমডি করছি। একদিন সিসিইউতে ডিউটি করছি। এক রোগীর এটেনডেন্ট এসে বলল, ডা. সাহেব আমার রোগীটা জরুরি বিভাগে আছে, এই তার ইসিজি, একটু দেখে দিন। দেখলাম। বললাম, আপনার রোগীর ইসিজি তো নরমাল, রোগী ভালো আছে। তখন তিনি বললেন, এই নরমাল ইসিজিটাই তো আমার রোগীর একমাত্র সমস্যা। রোগীর ইসিজি সমসময় স্বাভাবিকই থাকে, কিন্তু বুকের ব্যথা কমছে না এবং ডাক্তররা বলেছেন, এটা হার্টের অসুখ, হার্টে ব্লক আছে।

সেদিন খুব অবাক হয়েছিলাম; পরে অবশ্য আমার শিক্ষকদের কাছে জেনেছি, ভালো কার্ডিওলজিস্ট হতে হলে ইসিজিকে অবিশ্বাস করতে হবে। কারণ, শুধু ৪৮ ভাগ হার্ট অ্যাটাক বোঝা যায় ইসিজি দেখে, বাকি ৫২ ভাগ বুঝতে হয় রোগীর উপসর্গ শুনে, এ শোনাটা ফলপ্রসূ হয় কেবল তখনই, যখন রোগীর কথা মনোযোগ দিয়ে এবং মমতা দিয়ে শোনা হয়। তাই চিকিৎসকের কাছে গেলে আগে আপনার শারীরিক অসুবিধাগুলো তাকে বলুন, রোগের উপসর্গগুলো বলুন। কেউ বলতে পারেন যে, ডাক্তার সাহেব কথা শোনেন না, শুনতে চান না। অভিযোগটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্যি। কিন্তু রোগীদের আমি বলি, এর সমাধান খুব সহজ। আপনার কথা যিনি শুনবেন সেই ডাক্তারের কাছে যান। খুঁজে বের করুন।

উপসর্গ বিবেচনার পাশাপাশি ইসিজি ছাড়াও করোনারি হৃদরোগ নির্ণয়ের আছে আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা। যেমন: ইটিটি, ইকোকার্ডিওগ্রাম এবং করোনারি এনজিওগ্রাম। এগুলোর ফলাফল অনুসারে কার্ডিওলজিস্টরা রোগীকে এনজিওপ্লাস্টি কিংবা বাইপাস অপারেশনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সাথে সারাজীবন ওষুধ সেবনের নির্দেশনা তো আছেই।

বাইপাস অপারেশন নিয়েও আমার একটা অভিজ্ঞতা আছে। সেটাও আমি যখন হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে কাজ করছিলাম, সেই সময়কার ঘটনা। একজন রোগী এলেন। তার সব কাগজপত্র আর রিপোর্ট দেখে জানলাম, এনজিওগ্রাম করা হয়েছে এবং হার্টের তিনটা আর্টারিতে একশ পার্সেন্ট ব্লক। তিনটা রক্তনালী একশ পার্সেন্ট ব্লক, মানে পুরোপুরি বন্ধ। লোকটা তাহলে বেঁচে আছে কীভাবে? রোগীর এটেনডেন্ট বললেন, ডাক্তার তাদের বলেছেন যে, রোগীর তিনটা আর্টারিতে একশ পার্সেন্ট ব্লক আছে সত্যি, কিন্তু রিং লাগানো বা বাইপাস কিছুই প্রয়োজন নেই; আল্লার রহমতে তার অটো-বাইপাস হয়ে গেছে (চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, ন্যাচারাল বাইপাস)। আমার সত্যিকারের শেখা শুরু হলো। রোগীর এটেনডেন্টের কাছ থেকে শিখলাম।

পরে জেনেছি, এই ন্যাচারাল বাইপাস ঘটে থাকে কোলেটারাল সারকুলেশনের মাধ্যমে। আমাদের হার্টের চারপাশে বেশ কিছু সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্তনালি রয়েছে। নিয়মিত হাঁটা এবং ব্যায়ামের মধ্য দিয়ে এই পরিপূরক রক্তনালিগুলো সক্রিয় ও কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। হার্টের মূল রক্তনালিগুলোর মধ্য দিয়ে ব্লকেজের কারণে স্বাভাবিক রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে এই পরিপূরক রক্তনালিগুলো প্রয়োজনীয় কাজটুকু চালিয়ে নেয়। মূলত: এটাই ন্যাচারাল বাইপাস।

আসলে হৃদরোগ থেকে নিরাময় ও সুস্থ জীবনযাপনের জন্যে এই নিয়মিত হাঁটা, ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান বর্জন আর টেনশনমুক্ত থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, করোনারি হৃদরোগের প্রচলিত চিকিৎসাগুলো রোগীদের জীবনে কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারছে না। রোগী যে-ই চিকিৎসাই নিচ্ছেন, কিছুদিন পরই ঘুরে-ফিরে আবার সেই একই সমস্যা। আমার পরিচিত এরকম দুজন রোগীর কথা আমি প্রথমেই বলেছি। আবার অন্যদিকে, যারা নিজেদের জীবনের নিয়মকানুন আর অভ্যাসগুলো পাল্টে ফেলেছেন তারা সত্যিই ভালো আছেন, তিনি এনজিওপ্লাস্টি বা বাইপাস করুন আর না-ই করুন।

এ চিত্রটা শুধু যে আমাদের দেশের নয়, সারা বিশ্বের প্রেক্ষাপটেই এটি সত্যি। সন্দেহ নেই, আমেরিকার চিকিৎসাব্যবস্থা বিশ্বের অন্যান্য জায়গার তুলনায় অনেক উন্নত ও সমৃদ্ধ। বাইপাস অপারেশনের শুরুও ওখানেই। ১৯৬৭ সালে আমেরিকার ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকে প্রথম সফল বাইপাস সার্জারি করা হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ৪৫ বছর পেরিয়ে গেছে। বাইপাস তো হরদম হচ্ছে দেশে বিদেশে, কিন্তু তারপর কী অবস্থা? সবাই কি ভালো আছেন?

খোদ আমেরিকার একজন রোগীর কথাই বলি। রোগী আর কেউ নন, আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি উইলিয়াম বিল ক্লিনটন। বুকে ব্যথা হলো। হাসপাতালে ভর্তি হলেন। এনজিওগ্রাম করা হলো। আমেরিকার সেরা সেরা কার্ডিওলজিস্টদের নিয়ে মেডিকেল বোর্ড করা হলো। সিদ্ধান্ত হলো, বাইপাস করতে হবে। করা হলো বাইপাস। ক্লিনটন সুস্থ হয়ে আবার কাজকর্ম শুরু করলেন। কিছুদিন পরই ব্যক্তিগত জীবনে কিছু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লেন। প্রেসিডেন্টশিপ চলে যাওয়ার মতো গুরুতর অবস্থা তৈরি হলো। সবমিলিয়ে ভীষণ এক স্ট্রেসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন।

যাই হোক, ঝামেলা একসময় মিটল ঠিকই, কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। বাইপাসের ছ`বছরের মাথায় আবার বুকে ব্যথা। যথারীতি আবার এনজিওগ্রাম, আবার মেডিকেল বোর্ড। সিদ্ধান্ত হলো রিং পরানোর। রিং পরালেন। এবার জীবনাচার বদলানোর ব্যাপারে তিনি সচেতন হয়ে উঠলেন। তার চুরুট খাওয়ার অভ্যাস ছিল, ত্যাগ করলেন দীর্ঘদিনের এই অভ্যাস। ফ্যাট জাতীয় খাবার আর ফাস্টফুড ছেড়ে দিলেন পুরোপুরি। শুরু করলেন শাক-সব্জি আর ফলমূল খাওয়া। এখন তিনি ভালো আছেন।

শুধু তাই নয়, মেডিটেশন এবং সুস্থ জীবনযাপনের মাধ্যমে করোনারি হৃদরোগ নিরাময়ের পথিকৃৎ ক্যালিফোর্নিয়ার ডা. ডিন অরনিশ। বিল ক্লিনটন দ্বিতীয় মেয়াদে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন হোয়াইট হাউজে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের একজন ছিলেন ডা. অরনিশ। এ থেকেই বোঝা যায়, হৃদরোগ নিরাময়ের জন্যে সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও সুস্থ জীবনাচার অনুশীলনের ব্যাপারে ক্লিনটন নিজে কতটা সচেতন হয়ে উঠেছিলেন।

সুস্থতার জন্যে আসলে এই জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনাটাই সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। কারণ, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি এদিকে দৃষ্টি দেবেন, পৃথিবীর যে দেশেই যত উন্নততর চিকিৎসাই আপনি নেন না কেন, সমস্যা সমস্যার জায়গাতেই থেকে যাবে। তাই হৃদরোগ থেকে নিরাময় ও সুস্থ জীবনের জন্যে স্থায়ী সমাধান যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তার চাবিকাঠি একমাত্র আপনার হাতেই; ডাক্তার আর ওষুধ আপনার সহযোগী মাত্র।

লেখক: হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ।

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি