এসএমই খাত পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন সৃজনশীল ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি
প্রকাশিত : ১৭:৪৯, ২৩ জুন ২০২০ | আপডেট: ১৭:৫৭, ২৩ জুন ২০২০
কভিড-১৯ মহামারীর কারণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বাংলাদেশের এসএমই খাত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ খাতের পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন একটি সৃষ্টিশীল ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ও অর্থায়ন প্রাপ্তির জটিলতা নিরসন করা যাবে এবং একুশ শতকের ব্যবসায় প্রেক্ষাপটে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো মোকাবেলা করা যাবে।
মঙ্গলবার (২৩ জুন) রিসারজেন্ট বাংলাদেশ প্লাটফর্ম আয়োজিত ভার্চুয়াল সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। এসএমই খাতের সংকট মোকাবেলায় মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই), ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই), বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) ও পলিসি এক্সচেঞ্জের যৌথ উদ্যোগে গঠিত একটি প্লাটফর্ম রিসারজেন্ট বাংলাদেশ।
সংলাপের অতিথি হিসেবে ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, সিএমএসএমই খাতের জন্য একটি সমন্বিত ডেটাবেজ প্রস্তুত করতে হবে। সিএমএসএমই খাতের প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতাধীন ঋণ সুবিধা পৌঁছাতে সহায়তা করবে একটি পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজ।
তিনি বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয় ও এসএমই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় সারা দেশে সিএমএসএমইদের একটি ডেটাবেজ প্রস্তুত করা সম্ভব। এসএমইকে অর্থনীতির চালিকাশক্তি উল্লেখ করে তিনি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরিতে সমন্বিত উদ্যোগ, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এসএমই খাতের পণ্যে বৈচিত্রকরণ, ঋণ বিতরণে শক্তিশালী মনিটরিং, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও কভিড-১৯-এর কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাঁটাই নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
স্বাগত বক্তব্যে বিল্ডের চেয়ারপার্সন আবুল কাসেম খান বলেন, কভিড-১৯ মহামারীর কারণে বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসএমইরা। এসএমইদের বর্তমান অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হলে বেকারত্ব বেড়ে যাবে এবং অর্থনীতি আকস্মিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তিনি বলেন, কভিড-১৯-এর কারণে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছে এসএমইরা। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে কিভাবে তারা খাপ খাইতে পারে সে বিষয়ে যথাযথ নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। এসএমই খাতের অর্থায়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে পুনঅর্থায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ টুল। তাঁর মতে, এসএমইদের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ ঘটাতে সহায়ক হতে পারে কনসেশনাল লোন, কর অব্যাহতি ও ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন।
সংলাপে ‘কভিড-১৯ ইকোনমিক ক্রাইসিস অ্যান্ড এসএমইজ অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক কিনোট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন বিল্ডের সিইও ফেরদৌস আরা বেগম। তিনি তাঁর প্রেজেন্টেশনে কভিড-১৯ মহামারীর কারণে উদ্ভূত চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, দেশের সিএমএসএমই খাতের ব্যবসায়ীরা মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন। সিএমএসএমই খাতে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অর্থায়ন পেতে সমস্যা পোহাতে হচ্ছে, রফতানি ক্রয়াদেশ বাতিল হচ্ছে, বিক্রিতে বড় ধরনের পতন হচ্ছে এবং বেকারত্ব বাড়ছে। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের শণাক্ত করতে এসএমইদের জন্য ডেটাবেজ তৈরি এবং মাইক্রো ও কটেজ খাতের জন্য সুস্পষ্ট নীতিমালার দাবি জানান তিনি।
সংলাপটি সঞ্চালনা করেন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ। এতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এসএমই উদ্যোক্তা, পলিসি এক্সপার্ট ও প্র্যাকটিশনার বক্তব্য রাখেন।
বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মনজুর হোসেন বলেন, এসএমইরা ব্যবসা থেকে বের হযে গেলে তাদের ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। এসএমইদের রিটেইন্ড আর্নিংস কম হলেও, তারাই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এসএমইদের জন্য সঠিকভাবে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে না। প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। এমএসএমইদের কোনো ডেটাবেজ নেই, এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া তাদের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার স্থাপন করতে হবে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, এমন একটি সময়ে কভিড-১৯ হানা দিয়েছে যখন আমরা বাজার সম্প্রসারণের জন্য কাজ করছিলাম। কভিড-১৯-এর কারণে বাজার সম্প্রসারণ থমকে গেছে এবং একই সঙ্গে কমে গেছে উৎপাদন। এর কারণে কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়ে গেছে। এটি দেশের কর্মসংস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা বাস্তবায়নে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে, কেননা ব্যাংকগুলোর পক্ষে একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের বেশি কিছু করা সম্ভব নয়।
চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম বলেন, সরকার তৈরি পোাশাক খাতের শ্রমিকদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ বিতরণের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। একই ধরনের উদ্যোগ এসএমই খাতে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রেও গ্রহণ করা যেতে পারে।
এমসিসিআই প্রেসিডেন্ট নিহাদ কবির বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের আকারের মধ্যকার বড় ধরনের পার্থক্যকে উপেক্ষা করে প্রায় সময় খাত দুটিকে একই শ্রেনীভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মাঝারি ও বড় ঋণগ্রহিতারা যে ধরনের রেগুলেশন মেনে চলতে সক্ষম, ক্ষুদ্র ঋণগ্রহিতারা সে ধরনের রেগুলেশন মেনে চলতে সক্ষম নয়। ভবিষ্যতে এ বিষয়টিকে বিবেচনায় আনতে হবে।
ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, এসএমই খাতের সংকট মোকাবেলায় খাতটির জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এফডিআইকে উৎসাহিত করতে হবে এবং একটি এসএমই লিংকেজ পলিসির মাধ্যমে এসএমই খাতকে ভ্যালু চেইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তৈরি পোশাক ও তৈরি পোশাকের বাইরের খাতগুলোকে পণ্যের মান উন্নয়ন ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে লেভেল প্লেইং ফিল্ডের ভিত্তিতে কর ও ভ্যাট সংক্রান্ত সুবিধা প্রদান করতে হবে।
ক্রিয়েশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, অনানুষ্ঠানিক এসএমই খাতকে আনুষ্ঠানিক ও প্রথাগত ফিন্যান্সিয়াল চ্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনানুষ্ঠানিক খাতের এসএমইদের শণাক্ত করতে একটি এসএমই ডেটাবেজ প্রস্তুত করতে হবে।
তরঙ্গের সিইও কোহিনূর ইয়াসমীন এসএমইদের সহায়তায় একটি গ্র্যান্ট উন্নয়নে উন্নয়ন সহযোগীদের একটি নির্দিষ্ট প্লাটফর্মে আসার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এসএমই উদ্যোক্তাদেরকে ডিজিটাল মার্কেটিং প্লাটফর্মের সঙ্গে পরিচিত করতে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সাবেক মূখ্য সচিব ও পিকেএসএফের সাবেক প্রধান আবদুল করিম বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের সঠিক ব্যবহার এবং বিএসসিআইসি কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রদানকৃত সুপারিশ শিগগির বাস্তবায়ন করতে হবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসিরুদ্দিন বলেন, এসএমইদের জন্য কর্পোরেট ট্যাক্স ও টার্নওভার ট্যাক্স তুলনামূলক বেশি। দুই ধরনের ট্যাক্সই কমানোর বিষয়ে বিবেচনা করতে হবে। ব্যাংক ঋণের সুদহারও কমাতে হবে। এসএমই ফাউন্ডেশনের ‘ক্রেডিট হোলসেল প্রোগ্রাম’ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। অর্থনীতি পুনরূদ্ধারে এ ধরনের সময়োপযোগী একটি সংলাপের আয়োজন করায় উদ্যোক্তাদের অভিনন্দন জানান বক্তারা।
এসি
আরও পড়ুন