ঐতিহ্যের মুরাদপুর-৫
প্রকাশিত : ১৬:৩৭, ২৯ আগস্ট ২০২০
প্রসঙ্গ সীতাকুণ্ড আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, আমার গর্ব।
সিক্সটি নাইনে প্রথম ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম এই স্কুলে। আগেই জানিয়েছিলাম, প্রথম দিন আমি দশ/পনেরো মিনিট দেরিতে উপস্থিত হওয়াতে ক্লাশ টিচার চশমা এবং কপালের মাঝখান দিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: বাড়ী কোথায়? রেল লাইনের পুবে না পশ্চিমে? ভ্যাবাচ্যাকা আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম ক্লাশের উপস্থিত ছাত্ররাই সাক্ষ্য দিচ্ছে রেল লাইনের পশ্চিমে স্যার। স্যার ডুকতে দিলেন।
স্যারের ভাবনা রেললাইনের পূর্ব পাশের ছেলেগুলো (অধিকাংশ হিন্দু) বজ্জ্বাতের হাড্ডি। পশ্চিম পাশের ছেলেগুলো (অধিকাংশ মুসলমান) অপেক্ষাকৃত ভালো! স্যার নিজেও কিছু রেললাইনের পুর্ব পাশের মানুষ। তিনি স্কুলের সকলের প্রিয় শিক্ষক বাবু সুরেন্দ্র কুমার। আমার এই প্রিয় স্যারকে আমরা বেশিদিন পাইনি। সম্ভবতঃ ঐ বছরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমরা স্কুলের প্রায় সকল ছেলেরা উনার বাড়ী গিয়ে উনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি।
ষষ্ঠ শ্রণীতে ভর্তির সিরিয়াল অনুযায়ী আমি ছিলাম বি সেকশনে। ফাইনাল পরীক্ষার পর উঠলাম সপ্তম শ্রেণিতে এ সেকশনে। ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন জনাব রফিক স্যার। গোপ্তাখালীর ভোংগাখানের বাড়ী, সীতাকুণ্ডের প্রেমতলায় সকল ভাইবোন নিয়ে তিনি থাকতেন। তাঁর ভাগীনা মুহম্মদ মঞ্জুরুল হক (প্রকৌশলী, মাহমুদাবাদ বাড়ী) আমাদের সেকেন্ড বয় ছিল। সপ্তম শ্রেণির সান্মাষিক পরীক্ষায় তিনি তার ভাগীনাকে অত্যন্ত মহব্বতের সাথে একশ তে একশ সতেরো নাম্বার দিয়েছেন ইংরেজিতে। তখন কোন কোন স্যার পরীক্ষার খাতা কেটে নাম্বার যোগ না করেই স্কুলে ছেলেদেরকে দিয়ে বলতেন তোমরা যোগ করে নাও। এই যোগ করতে গিয়েই এই বিপত্তি ধরা পড়লো! অত্যন্ত সহজ, সরল ও নিরহংকারী এই শিক্ষক ছিলেন সকলের প্রিয়। রাস্তার পাশ দিয়ে খুবই আস্তে আস্তে হাটতেন, যার সাথে দেখা হতো তারই কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। আমাকেও অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আজীবন এই স্কুলেই কাটিয়ে দিলেন। বিয়ে করেছেন অনেক দেরীতে, প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সে। মাশাআল্লাহ, যতদূর জানি তাঁর সন্তানেরা আজ বেশ প্রতিষ্ঠিত। মহান আল্লাহ তাদের হেফাজত করুন।
প্রধান শিক্ষক জনাব খাইরুল ইসলাম স্যার।
মাষ্টার ‘কাহাকে’ বলে? জনাব খাইরুল ইসলাম স্যারকে দেখে এক নজরে হৃদয়ে এবং মননে একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়, হ্যা এদেঁরকে মাষ্টার বলে। আমার জীবনের সফল এবং শ্রেষ্ঠ মাষ্টারের উদাহরণ হলেন জনাব খাইরুল ইসলাম স্যার। আমাদের সময়ের সীতাকুণ্ড আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। অত্যন্ত ঋজুভংগিতে এটেনশান হয়ে পিছনে হাত দুটো ধরে তিনি নিরবে বিচরণ করতেন স্কুলের পশ্চিম থেকে পূর্ব হয়ে একদম সর্ব দক্ষিণে। কখনো কখনো হাতে একটা বেত থাকতো, কখনো না। কিন্তু হাটার ভংগি ছিল একই। সারা স্কুল তাঁর ভয়ে কাঁপতো সারাক্ষণ। সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুরের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। আমি একদিন টয়লেটে যাবার জন্য বেরিয়েই উনার মুখোমুখি হয়ে গেলাম। আমি পিছন পিছন আসছি এটা তিনি বুঝতে পেরে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় যাবো, টয়লেটের কথা বলাতে তিনি দাঁড়িয়ে আমাকে যাবার ইশারা করলেন, আমি হাফ ছেড়ে বাচঁলাম।
ইংরেজি বিষয়ে তাঁর মতো শিক্ষক তখন আর কেউ ছিলেন বলে আমাদের জানা ছিল না। নাইন টেন এর ইংরেজি নিতেন তিনি। সম্ভবতঃ ৬৯ কি ৭০ সালে এসএসসির ফাইনালে একসাথে ৪০ জন ছাত্র ইংরেজিতে রেফার্ড পেয়ে গেলো। এটা ছিল একদম অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা সীতাকুণ্ড আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে জন্য ! এ নিয়ে স্কুলময় একটা চাপা উত্তেজনা এবং অভিভাবক মহলে বিরুপ প্রতিক্রিয়া হলো। এর কিছুদিন পর তাঁকে এই স্কুল ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। এর পর পরই তিনি যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হাই স্কুলে। কথিত আছে, তিনি উক্ত বিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দেয়ার সময় প্রশ্নকর্তাগণ (যারা সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ প্রফেসর/ শিক্ষক ছিলেন) তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কিভাবে এখানে দরখাস্ত করার মতো ভুল করলেন! উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেনঃ আমি একা একটা ভুল করে এখানে দরখাস্ত করেছি, কিন্তু আপনারা এত বিজ্ঞজন হয়ে কিভাবে এই ভুল চোখ এড়িয়ে গেল আপনাদের! এই ভুল থাকা সত্ত্বেও আমাকে ইন্টারভিউ এর জন্য ডাকলেন কেন? তাঁর চাকুরি সেখানে হয়ে গেলো এবং শেষ পর্যন্ত সেখানেই তিনি তাঁর শিক্ষকতা জীবন শেষ করেছেন। মহান আল্লাহ আমার এই মহান শিক্ষককে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা করে দিন ।
আরেক প্রধান শিক্ষকঃ জনাব ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী স্যার।
জনাব খাইরুল ইসলাম স্যার চলে যাবার পর জনাব ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী স্যার প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি মুরাদপুরের বাসিন্দা এবং তখন তিনি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত, শিক্ষা বিভাগের উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা। তাঁকে স্কুল প্রতিনিধিগন জোর করে ধরে স্কুল চালাবার দায়িত্ব প্রদান করেন। আজীবন কর্মসূত্রে তিনি ছিলেন চিটাগং এর বাইরে। তাই তাঁর কথা বলার ভংগী ছিল অন্যরকম, অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির তিনি ইংরেজি ক্লাস নিতেন। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন শিক্ষকের শিক্ষক, তাই তাঁর লেকচার আমরা ধরতে পারতাম না। ফলস্বরূপ আমরা ইংরেজিতে পেতাম ৫/১০, এই রকম। সর্বোচ্চ নাম্বার উঠতো ১৫/২০। এসএস সির আগে আমরা তাঁর ইংরেজিতে কেউ কখনো ৩৩ পাইছি কিনা আমার মনে পড়ে না।
(যদি আপনাদের পছন্দ হয় তবে চলবে...)
এমবি//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।