পর্ব-৪
কবর নিরাত্তার নামে চাঁদাবাজি
প্রকাশিত : ২১:৫৩, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৯:১৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
রাজধানীতে কবর নিরাপদ রাখতে স্বজনদের গুণতে হয় মাসিক চাঁদা। সিটি কর্পোরেশনের আইন অনুযায়ী, কাউকে কবর দেওয়ার দু’বছরের মধ্যে কবরটিতে নতুন কোনো মৃত ব্যক্তির সৎকার করা যাবে না। তবে, সিটি কর্পোরেশনের আইন অমান্য করে একটি অসাধু চক্র ব্যবসার ফাঁদ পেতে বসেছে। স্বজনদের অভিযোগ, কবর সংরক্ষণ রাখতে তাঁদের প্রতি মাসেই কমপক্ষে ৫০০ টাকা করে ঘুষ দিতে হয়।
শুধু তাই নয়, কবরের জায়গা পেতেও তাঁদের গুণতে হয় বড় অঙ্কের টাকা। সিটি কর্পোরেশনের আইনের কোনো তোয়াক্কা না করেই, মৃত ব্যক্তির স্বজনরা ওই চক্রকে মাসিক চাঁদা না দিলে কবর দেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ওই কবরেই নতুন কবর দেওয়া হয়। তাই বাধ্য হয়েই প্রতিমাসে চাঁদা দিচ্ছেন মৃত ব্যক্তির স্বজনরা।
তাদের এমনই একজন রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা আছিয়া আক্তার। গত ১২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২ টার দিকে মিরপুর কবরস্থানে তার স্বামীর কবর জিয়ারত করতে আসেন তিনি। আছিয়া জানান, ১ বছর আগে তার স্বামী মারা যান। এই কবরস্থানে তার স্বামীকে কবর দেওয়ার খরচ বাবদ গুণতে হয়েছে ৩ হাজার টাকা। এই টাকা কবর দেখ ভালের কাজে নিয়োজিত লোকেরা তার কাছ থেকে নেয় বলে অভিযোগও করেন তিনি।
এখানেই শেষ নয়, কবরের চারপাশে বেড়া দিয়ে কবরটি সংরক্ষণ করতে ওই গোরখোরদের আরও ৬ হাজার টাকা দিয়ে হয়। এ ছাড়া কবরের মাটি ভরাট ও সাজসজ্জার জন্য দিতে হয় আরও ১ হাজার টাকা।
আছিয়া এই প্রতিবেদকে বলেন, “ওইসব টাকা দেওয়ার পরেও প্রতিমাসেই আমাকে আরও ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। তারা (দালালচক্র) আমাকে হুমকি দিয়ে বলে যদি প্রতিমাসে টাকা না দেই তাহলে আমার স্বামীর কবর ভেঙ্গে দিয়ে এখানে নতুন কবর দিবে। তাই আমার স্বামীর কবরটা সংরক্ষণ করতে প্রতিমাসে প্রতিমাসে তাদেরকে টাকা দেই “
আছিয়ার সঙ্গে কবরস্থানে আসা তার সন্তান রাসেল বলেন, কবরস্থানের যারা কাজ করেন তাদের খুশি (টাকা দিয়ে) না রাখলে বেশিদিন কবর থাকে না। তাদের খুশি রাখলে কবরে সাইনবোর্ড থাকে, কবরের ওপর সবুজ ঘাস ও পাশে ফুলগাছ লাগিয়ে নিয়মিত পানি দেয়। আর টাকা না দিলে কয়েক মাসের ব্যবধানেই কবর ভেঙে যায়। সেখানে নতুন কবর দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করলে সহজে চিহ্নিত করা যায়, এমন ভালো জায়গায় বরাদ্দ দেওয়া হয়।
মিরপুর কবরস্থানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কবরস্থান জিয়ারত করতে আসা বেশ কয়েকজন মানুষ গোরখোদকসহ অন্যদের (দালালচক্র) হাতে টাকা দিয়ে কবরটা ঠিকঠাক রাখতে অনুরোধ করছেন। মধ্য বয়সের এক ব্যক্তিকে বলতে শুনা যায়, এখন পকেটের অবস্থা বেশি ভালো না। এখন ৪০০ টাকা রাখেন। আগামী মাসে বেশি করে দিবো। এদিকে টাকা পেয়েই কবরের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু করে দেন গোরখোদকরা।
এ বিষয়ে মিরপুর কবরস্থান গোরখোদার কাজ করেন ওহাব আলী। এভাবে মৃতব্যক্তিদের স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা কারো কাছ থেকে জোর করে কোনো টাকা নেই না। মৃত ব্যক্তির পরিবার খুশি হয়ে যা দেন, তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে।
তবে কবরের সৌন্দর্য-বর্ধন, সংরক্ষণ বা মৃত ব্যক্তির সৎকারের বিনিময়ে নেওয়া অর্থকে কোনোভাবেই পারিশ্রমিক বলতে চান না ওহাব আলী। তাঁর ভাষ্য, আমরা অন্য কোনো কাজ করলে টাকা পেতাম। কিন্তু সেখানে কাজ না করে মানুষের সেবায় এগিয়ে এসেছি।
এবিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা এনায়েত হোসেন ইটিভি অনলাইনকে বলেন, সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী অস্থায়ী কবর দুই বছর রাখার বিধান রয়েছে। এবং দাফন বাবদ ৭ শত টাকা দিতে হয় স্বজনদের। আর নিয়ম অনুযায়ী কবর সংরক্ষণ করে সিটি করপোশনের কর্মীরা। তাদেরকে বাড়তি কোনো টাকা দেওয়া বিধান নেই। টাকা নিয়ে কবর রাখা বা ভেঙে ফেলার এমন কোনো অভিযোগ তার কাছে আসেনি বলেও জানান তিনি।
কবরের বেড়া লাগাতে এককালীন ৬ হাজার টাকা নেওয়া ব্যাপারে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের নিয়োগকৃত কর্মী এমন কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলে, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও জানান, গোরস্থানের দাফনকৃত কবরের ওপর কোন প্রকার বাশেঁর খুটি না দেওয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এমনকি চলতি মাসের মধ্যে করবস্থানের সৌন্দর্য্য বর্ধন, ঝোপঝার ও আগাছা পরিস্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
এমজে/টিকে