ঢাকা, রবিবার   ০১ ডিসেম্বর ২০২৪

কবিতা আমার কাছে একটা অবিনশ্বর মায়াবী আশ্রম

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:০৮, ৩০ মার্চ ২০২৪

কবিতার বরপুত্র আসাদ মান্নান জানেন শব্দের ষোলোকলা- শব্দের দক্ষ ক্রীড়নক তিনি। ছত্রিশ ব্যঞ্জনায় তার কবিতার শব্দেরা বাজে অহর্নিশ। পাঠককে করে তোলে মোহাবিষ্ট। সময়ের নদী বেয়ে তার শব্দতরী নোঙর ফেলে সময়াতীতের মহাসমুদ্রে। তার শব্দেরা আছড়ে পড়ে দূর কোনো সৈকতের দুরন্ত জল-কোলাহলে। পাঠক কুড়িয়ে নেয় তার অনুভবের নুড়ি-পাথর। তার হৃৎপিণ্ড যেন পাখি হয়ে প্রাণহীন নগর পাড়ি দিয়ে বসত গড়ে কল্লোলিত স্নিগ্ধ হাওরে।…

সত্তর দশকের অন্যতম শক্তিশালী কবি আসাদ মান্নানের জন্ম ৩ নভেম্বর ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। কাব্যবুননে, ধরনে ও কৌশলগত রীতিতে তার স্বকীয় প্রক্রিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে আসছেন। বাংলা কবিতায় নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেছেন তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। বলতে গেলে তা ঈর্ষণীয়। কবি আসাদ মান্নান একজন সুপরিচিত এবং সুনন্দিত এক নাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ (অনার্স) ও এমএ সম্পন্ন করেছেন। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বসহ, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার, তথ্য মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক, সরকারের সচিব হিসেবে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এবং বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন-এর একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সূর্যাস্তের উল্টোদিকে’ (১৯৮১)। গ্রন্থ সংখ্যা ১৫টি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ (২০২১)-সহ নানান পুরস্কার ও সম্মাননা।

আপনি এখন কী পড়ছেন? 

আসাদ মান্নান: প্রতিদিন আমি কিছু না কিছু পড়ে থাকি; বিশেষ করে এ প্রজন্মের কবিদের কবিতা এবং তাদের কবিতা বিষয়ক গদ্য ও আলোচনা-সমালোচনা। পড়ার টেবিলে এরকম বহু বই পড়ে আছে বহুদিন ধরে। যখন যা মন চায় হাত বাড়িয়ে ওখান থেকে দু-একটা তুলে আনি বিছানায়- শুয়ে শুয়ে পড়ি, পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ি, ঘুম ভাঙলে জেগে উঠি, আবার পড়ি। এতদিন গল্প-উপন্যাস পড়ার জন্য ফুরসত পাইনি। বেশ কিছু উপন্যাস, গল্পের বই অনেক দিন ধরে বইয়ের তাকে এতিম শিশুর মতো পড়ে আছে- ওদের দিকে এতদিন মনোনিবেশ করা যায়নি পেশাগত ব্যস্ততায়। এখন আর সেই ব্যস্ততা নেই- বই-ই আমার নিত্যসঙ্গী। নন্দিত কথাশিল্পী ও নাট্যকার ফেরদৌস হাসানের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘ডাক দিয়ে যায়’, কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল-এর সম্প্রতি প্রকাশিত ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘কারবালা উপাখ্যান’, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের ‘বঙ্গবন্ধু কী চেয়েছিলেন?’, পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত কথাশিল্পী, কবি ও ‘কৌরব’ সম্পাদক কমল চক্রবর্তীর লেখাগুলো পড়ছি। পড়ছি তরুণ কথাশিল্পী ও গবেষক স্বকৃত নোমানের ‘বাংলায় ইসলাম সহজিয়া ও রক্ষণশীল ধারা’ নামের একটি অসামান্য গবেষণামূলক গ্রন্থ। টেড হিউজ ও সিলভিয়া প্লাথ সম্পর্কে লিয়াকত আলী খানের বাংলা ও ইংরেজিতে লিখিত দুটি বইও এ তালিকায় রয়েছে। এর বাইরে ছোটো কাগজে চোখ বুলচ্ছি। বলতে পারেন রসান্ন সময় পার করছি অবসর যাপনের মধ্য দিয়ে।

কবিতা পড়ব কবিতা লিখব, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ পড়ব না, তা তো হয় না! অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাংলা কবিতার এক অনিবার্য অবিনাশী শক্তি ও সৌন্দর্য, এখানে তিনি একক ও অনন্য। তাকে ধারণ করার সামর্থ্য সবাই রাখে না। আমার সাধ্য ও সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে অবুঝ শিশুর মতো আমার অস্তিত্বে ও অহংকারে জড়িয়ে রেখেছি অনুক্ষণ। আর জীবনানন্দ! হ্যাঁ, কবুল না করে উপায় দেখছি না- জীবনানন্দের কবিতা না পড়লে আমার মনে হয় কবিতার সঙ্গে আমার এভাবে সংসার হতো না। 

আপনি এখন কী লিখছেন? 

আসাদ মান্নান: কবিতা লিখছি টুকটাক। আমাদের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে একটা অস্থির সময় গেছে, সে সময় বেশ কিছু রাজনৈতিক কবিতা লিখেছি মনের তাগিদে। এখন চেষ্টা করছি আমার স্বকীয় অনুভবে ফিরে আসতে। প্রায় প্রতিদিন দু-একটা কবিতা লিখতে চেষ্টা করছি; তবে কবিতার জন্য যে ঘোর ও উন্মাদনা দরকার সেটির তীব্রতা মনে হয় কমে আসছে।

নিজে কবিতা লিখছি বলে কবিতার প্রতি আমার টান ও ঋণ একটু তো বেশি-ই হবে। আমার ব্যক্তি জীবনে যা কিছু অর্জন বলা যায় তার সবটুকু কাকতালীয়ভাবে কবিতার জন্য সম্ভব হয়েছে। কবিতা না লিখলে আমার এ জীবনটা হয়তো-বা অন্যরকম হতো। আমার সামান্য কিছু গদ্য আছে; তবে তা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। মনে হচ্ছে বড় ভুল করে গেছি- গদ্যের মহলে যে এক অপরিসীম আলোর ভুবন রয়েছে সেখানে প্রবেশ না-করে। জীবনের এমন কিছু বিষয় রয়েছে যাকে গদ্যে লিখতে হয়- এটা জেনেও শুধুমাত্র নিজস্ব ভাষার দেখা না পেয়ে ওখানে হাত দিতে পারিনি। এ আক্ষেপ আমার থেকে যাবে বোধ হয়!

কবিতা আমাকে কেন এত কাছে টানে? খুবই জটিল প্রশ্ন। একটা সরল বাক্যে যদি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম! প্রেমিক বা প্রেমিকা পরস্পরকে যেভাবে কাছে টানে কবিতাও আমাকে টানে। কবিতাকে ভালোবেসে সবিতাকে দূরে ঠেলে রাখি, আকাশ জড়িয়ে তার ডানার পালকে উড়ে গেছে কত পাখি ও পাপিয়া; তবুও কবিতা অন্তরঙ্গ অসুখের মতো আমাকে আক্রান্ত করে। এ ক্ষেত্রে শব্দই আমার একমাত্র অস্ত্র, যা দিয়ে আমি কবিতার অন্দর মহলে প্রবেশ করে নিরাময় খোঁজি; খুঁজে পাই কবিতাকে- কবিতা আমার কাছে একটা অবিনশ্বর মায়াবী আশ্রম।
ধন্যবাদ আপনাকে।

কেআই//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি