করোনাকালের স্বার্থপরতা
প্রকাশিত : ১৫:২০, ২৯ মে ২০২০
করোনাকালে আমাদের অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে অথবা ইতোমধ্যে বদলে গেছে। দৈনন্দিন চালচলন থেকে খাদ্য অভ্যাস, আচার ব্যবহার প্রচলিত সব কিছুতেই ধাক্কা লেগেছে। আগামী দিনে আরো কত যে বদলাবে সেটা এখনো পুরোপুরি অনুমান করাই সম্ভব হয়নি। তবে লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, অর্থনীতি, মানুষের জীবনযাত্রা সব কিছুতেই বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে করোনা।
আমরা গর্ব করে বলে থাকি- বাঙালি বীরর জাতি, লড়াই করে টিকে থাকতে একদিন বিশ্বজয়ী করোনা ও আমাদের কাছে হার মানবে। আমরা বলি বাঙালি ধার্মিক, ধর্মান্ধ নয়, সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। মহান স্রষ্টার কাছে বিনীত প্রার্থনা, তিনি যেন এ মহামারির ভয়াবহ ক্ষতি থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেন।
বাঙালি মমতাময়ী, বিনয়ী, মার্জিত, সদাচারী। এগুলো আমাদের ঐতিহ্য গর্বের বিষয়। ১৯৭১ এ মহান স্বাধীনতার আন্দোলনে পরস্পরের সহমর্মিতা আন্তরিকতা আমাদের সামনে জলন্ত উদাহরণ। বাঙালির সবগুলো ঐতিহ্য যেন একমত হয়ে এসেছিল তখন। কিন্তু এবার জাতীয় এ দুর্যোগে এখনো সেই ঐক্য সহমর্মিতা যেন মিলছে না। শুধু আমরা নই, গোটা বিশ্ব যেন কেমন স্বার্থপর হয়ে উঠছে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে আমরা বলছি সামাজিক দূরত্বের কথা। অর্থাৎ সুস্থ থাকতে হলে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখবো। আমরা যেন শুধু নিজে বেঁচে থাকার লড়াই- এ সবাই স্বার্থপর হয়ে উঠেছি। যেখানে মাহমারি ঠেকাতে সবার ঐক্য প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, সেখানে স্বার্থপরের ন্যায় নিজে বাঁচতে সম্পদ সুরক্ষার নিশ্চয়তা খুঁজছি।
রাজনৈতিক নেতা, ধনকুবের, আন্তর্জতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বরা কেউ যেন নিজেকে চিনতে পারছেন না। কেউ কেউ জীবন বাঁচাতে নিরাপত্তায় ব্যস্ত, আবার কেউ সম্পদ বাঁচাতে ব্যস্ত। এসব বিশিষ্ট লোকের চেয়েও ইতিমধ্যে অনেক সাধারণ মানুষ অসাধারণ হয়ে উঠেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বা জীবনে সকল সঞ্চয় মানুষের জন্য দান করে। রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রও যেন একেবারে বদলে যাচ্ছে। এক সময় দেশ গ্রামে সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থল ছিলেন রাজনৈতিক নেতারা। এখন তারা জনগণের জন্য তেমন দায়িত্ব রয়েছে বলে মনে করে না হয়তো। ছিটেফোঁটা যাও আবার করছেন সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা গণমাধ্যমে প্রচারে ব্যস্ত হয়ে থাকেন বেশি। যেমন- এরকম প্রচারের একটা উদাহরণ দিই। দেশের শীর্ষ একজন করদাতা তার এলাকায় কয়েক হাজার পরিবারকে ত্রাণ দিয়েছেন, সেটা কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করেছেন। আবার এ পর্যন্ত অতীতে কোথায় কোথায় ত্রাণ দিয়েছেন সেটাও সবিস্তারের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলা যায়, ত্রাণ দেয়ায় যত টাকা ব্যয় করেছেন বিজ্ঞাপন দিয়েও ত্রাণের চেয়েও কম টাকা ব্যয় করছেন না। এসব ত্রাণ প্রচারকদের ভিডিও, ছবি দেশের টেলিভিশন ও সংবাদপত্র গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে।
ভাবতে অবাক লাগে এই যখন বড় লোকদের অবস্থা, তখন শেরপুরের ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিন জীবনের সকল সঞ্চয় অসহায় মানুষদের জন্য দান করে দিয়েছেন। তবে এটাও সত্য দেশের অনেক ব্যবসায়ী বা সামর্থবান মানুষ গোপনেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে সে চিত্র এখনো খুব বেশি নয়। এর চেয়েও মজার আরেকটা বিষয় সবার নজরে আসার কথা। দেশের সর্বস্তরের ব্যবসায়ীরাই একই সুরে নিজেদের সংকটের কথা বলছেন এবং সরকারের কাছে সহযোগিতার কথা বলছেন। তাদের দাবি, গত তিন মাসে তাদের অনেক গচ্ছা গেছে, তাই সরকারের সহযোগিত না হলে ব্যবসা বন্ধ করে দিবেন। অনেকে আবার ইতোমধ্যে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বড় সংকট এসেছে লোকসান হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা বিষয় তো মনে রাখতে হবে এসব ব্যবসায়ীরা তো এতদিন যথেষ্ট মুনাফাও করেছেন। তাই নিজেদের দায়িত্ব বলে তো কিছুটা নিতে হবে। সব দায় সরকার নিবে আর ভোগান্তি শ্রমিক নিবে এটা কী যথাযথ বিচার হতে পারে? আজকে যদি এ বিপদের সময় সবাই সরকার থেকে নেয়ার ফাঁদ পেতে রাখি তাহলে তো এক সময় সরকারও অপারগ হয়ে উঠবে।
এ প্রসঙ্গে কয়েকদিন আগের পত্রিকায় প্রকাশিত আরেকটা সংবাদের কথা বলি। করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য কয়েকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সরকারের কাছ বড় অংকের অর্থের দাবি করেছেন। জানা যায়, দুইশো শয্যার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিতে সরকারের কাছে মাসে ১৭ কোটি টাকা দাবি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন যেখানে সর্বোচ্চ ব্যয় হওয়ার কথা মাসে ২ থেকে ৩ কোটি টাকা। এর আগে করোনা চিকিৎসার শুরুতে বেসরকারি হাসপাতালগুলো চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দিয়ে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলেছিল। দেশে করোনা সংক্রমণের পরপরই অনেক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান লকডাউন করা হয়। চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য কর্মকর্তাদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। হাসপাতালে সেবা চালু না রাখলে নিবন্ধন বাতিলের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হুমকির পরও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। এতে করে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে অনেক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সব ধরনের রোগীর সেবা দিতে হাসপাতালগুলোকে নির্দেশ দিয়ে একটি আদেশ জারি করে। এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান’র একটি বক্তব্য তুলে ধরছি। তিনি বলেন, ছোট একেকটি ক্লিনিক থেকে বর্তমানে মেডিকেল কলেজ, হাসপাতালসহ বড় বড় হাসপাতালের মালিক হয়েছেন অনেকে। ব্যবসা না হলে এগুলো গড়ে তুলতে পারতেন না। সেই ব্যবসার কিছু টাকা দিয়ে এই দুর্যোগে তারা মানুষের সেবায় এগিয়ে আসতে পারতেন। এর আগে বিদেশি দামী মাস্কের নাম করে দেশীয় নিম্ন মানের মাস্ক সরবরাহের ঘটনাও ঘটেছে।
করোনার আতঙ্ক ও সাধারণ মানুষের নানা রকম ভোগান্তি ও উচ্চবিত্তের পলায়নপরতা বা ব্যবসার মানসিকতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন নানা রকম মুখরোচক গল্প আলোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে লিখছেন এ অবস্থায়ও মানুষের মৃত্যু চিন্তা আসেনি বা মানুষ মরে গেলে এ সম্পদের কী হবে বা কবরে সম্পদ নিতে পারবে কি না।
আমরা ধর্মে বিশ্বাসী। শুরুতে বলেছিলাম আমরা ধার্মিক। আমরা বিশ্বাস করি জীবন চলার পথে দুর্ঘটনা, অসুস্থতা মৃত্যু যে কোন সময় আসতে পারে। কিন্তু মানুষ বেশিরভাগ সময় মৃত্যুর কথা ভুলে যায় বা মনে থাকে না। কিন্তু নিষ্ঠুর করোনা খুব কঠিনভাবে এবার গোটা বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, মানুষ খুবই অসহায়। আর সম্পদও তাকে নিরাপত্তা দিতে পারে না। বা জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। যে সম্পদ নিশ্চয়তা দিতে পারে না, সে সম্পদের জন্য এত মরিয়া হয়ে লাভ কী? আমাদের দেশে প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ মুসলমান। এদের বেশিরভাগ মানুষ রোজা, নামাজ, হজ, যাকাত পালন করে। এদের পোশাক পরিচ্ছদ, দাড়ি, টুপি সবই ঠিক আছে। আবার হারাম আয়, ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়ম করে সম্পদ বানানোও ঠিক আছে। এরা মনে করে যেনতেনভাবে টাকা আয় করে হজ করলে আল্লাহ মাফ করে দিবেন। আজ এ মহামারির সময়ে আমাদের সঠিক বিষয় বুঝার সময় এসেছে। আত্ম প্রবঞ্চনা নয়, বুঝতে হবে ধর্ম কী বলছে, আমরা কী করছি। কোরআন কী বলে ও কোরআনের নির্দেশ অমান্য করে আমরা কী করছি, নবী করিম (সা.) জীবন অমান্য করে কোন মুসলমান ক্ষমা পাওয়ার প্রত্যাশা করা সম্ভব নয়। নবী করিম (সা.) বিদায় হজের দিন স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘হে মানুষ। আমি তোমাদের কাছে দুটো আলোকবর্তিকা রেখে যাচ্ছি। যতদিন এ দুটোকে অনুসরণ করবে, ততদিন তোমরা সত্য পথে থাকবে। এর একটি হলো আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ কোরআন। দ্বিতীয়টি হলো আমার জীবন দৃষ্টান্ত অর্থাৎ হাদীস। হে মানুষ, প্রত্যেকেই শেষ বিচারের দিন সকল কাজের হিসাব দিতে হবে। অতএব সাবধান হও।
পরিশেষে আমার একজন শিক্ষকের কথা বলেই এ লেখা শেষ করবো। তিনি বলেন, ‘মানুষ হিসেবে আপনি পৃথিবীতে এসেছেন, কিছুদিন থাকবেন, তারপর আবার পৃথিবী থেকে চলে যাবেন। আপনার পূর্ব পুরুষরাও পৃথিবীতে এসেছিলেন, তারাও চলে গেছেন। আপনার উত্তরসূরিরা আসবেন, তারাও চলে যাবেন। কোত্থেকে এসেছেন, কোথায় যাবেন তা জানেন না। এই না জানা থেকেই সৃষ্টি হয় শূন্যতা। জীবনের এই শূন্যতাই দূর করেছে ধর্ম। ধর্ম বলে তুমি এসেছো স্রষ্টার কাছ থেকে। কিছুকাল পৃথিবীতে থাকবে। আবার তাঁর কাছেই ফিরে যাবে। পৃথিবী হচ্ছে কর্মস্থল। যেমন কাজ করবে তার কর্মফল তুমি পাবে। সকল ধর্মের মূল শিক্ষাই এক। সকল ধর্ম একই উৎস থেকে উৎসারিত। ধর্মের মূল শিক্ষা হচ্ছে এক স্রষ্টার উপাসনা কর, সবার সাথে সদাচরণ কর আর সৃষ্টির সেবা করা । তাহলেই তুমি পরিত্রাণ পাবে। আর এই দুর্যোগকালে অসহায় মানুষদের সেবা করার বড় সুযোগ আমরা পেয়েছি। যে যেখানে থাকি না কেন অসহায়, অসুস্থ মানুষের সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দিতেই পারি।
অহেতুক সমালোচনা নয়, বা কাউকে আঘাত করতে নয়, চারপাশের পরিস্থিতি দেখেই নিজস্ব উপলব্ধি থেকেই এ লেখা। সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, কারণ বলাতো যায় না করোনায় কখন চির বিদায় নিতে হয়।
লেখক- গণমাধ্যমকর্মী।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।