ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৫ নভেম্বর ২০২৪

কান ধরানো’র বিচার ও করোনা সংকট

মো. তাজুল ইসলাম

প্রকাশিত : ১৩:২২, ২৮ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ২০:১৪, ২৮ মার্চ ২০২০

কান ধরে ওঠ বস করাচ্ছেন

কান ধরে ওঠ বস করাচ্ছেন

বর্তমানে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস‘র বিচারক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি আইন বিষয়ে গবেষণা করছেন এবং বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় আইন ও বিচার সম্পর্কে নিয়মিত কলাম লেখেন।

আইনে আছে সহস্র অপরাধী ছাড়া পায় পাক কিন্তু একজন নিরাপরাধ লোক যেন অন্যায়ভাবে শাস্তি না পান। বিচার করতে হলে এ জুরিসপ্রুডেন্স মাথায় রাখতে হয়। বিচার করলে শুধু হবে না এটাও দেখাতে হবে যে, সেখানে ন্যায় বিচার হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বা মোবাইল কোর্টের বিচার অতঃপর দেশের দুই জন সিনিয়র সিটিজেনকে কান ধরিয়ে দাঁড় করানোর ছবি তোলার দৃশ্য উপরের ওসব ফৌজদারী বিচারের নীতির সাথে ঠিক যাচ্ছে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব সময় বলতেন, কাউকে যেন মিথ্যাভাবে হয়রানি করা না হয়। সবাই যেন ন্যায় বিচার পায়। 

                                                                   লেখক মো. তাজুল ইসলাম
 মাস্ক না পড়ার দায়ে কিনা তিন বৃদ্ধকে (দেশের সিনিয়র সিটিজেন) কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখলো ভ্রাম্যমাণ আদালত। শুধু তাই নয়, সেই ছবি আবার আপলোড করা হয়েছে সরকারি ওয়েবসাইটে! শুক্রবার (২৮ মার্চ, ২০২০) বিকেলে যশোরের মনিরামপুরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইয়েমা হাসানের ভ্রাম্যমাণ আদালত তিনজন বৃদ্ধ নাগরিককে এ দণ্ড দেন। শুধু তাই নয়, কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজের মুঠোফোনে তার স্থিরচিত্র ধারণ করেন। পরে রাতে এ ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সামলোচনা হয়। 

করোনাভাইরাসের এ প্রাদূর্ভাবে লোকসমাগম যেন না হয় সে বিষয়টি দেখভালের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মনিরামপুর উপজেলার চিনাটোলা বাজারে অভিযানের সময় প্রথমে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে পড়েন দুই বয়ঃবৃদ্ধ। এর মধ্যে একজন বাইসাইকেল চালিয়ে আসছিলেন। অপরজন রাস্তার পাশে বসে কাঁচা তরকারি বিক্রি করছিলেন। তাদের মুখে মাস্ক ছিল না।

গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারি, পুলিশ ঐ দুই বৃদ্ধকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাস্তি হিসেবে তাদেরকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখেন। তিনি নিজে (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) আবার মুঠোফোনে এ চিত্র ধারণ করেন। এরপর একজন বৃদ্ধ ভ্যান চালককেও অনুরূপভাবে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার দণ্ড দেন। এসব ছবি দ্রুতই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই বয়স্ক নাগরিকদের এভাবে সাজা দেয়াটাকে মেনে নিতে পারেননি। এমন দণ্ড ভ্রাম্যমাণ আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পাশাপাশি এই ছবি সরকারি ওয়েবসাইটে আপলোডের পর সংশ্লিষ্টদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটদের মোবাইল কোর্ট আইনের ক্ষমতা প্রয়োগে আরও প্রশিক্ষণ দরকার আছে কিনা তা কর্তা ব্যক্তিরা ভেবে দেখবেন। 

বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের এমন কাজ সকলেই ধিক্কার জানাবেন এবং জানাচ্ছেন। মুরব্বিদের কান ধরিয়ে ছবি তুলে আবার প্রচার করা কোনভাবেই কাম্য নয়। মোবাইল কোর্ট আইন মেনে ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগ হলো নাকি করোনা ভাইরাস ছড়ানো রোধে সচেতনতা সৃষ্টি হলো সে বিষয়টি এখানে সুস্পষ্ট নয়। আগে ক্ষুধার্তদের খাবারের দায়িত্ব নিবে রাষ্ট্র তাহলে দেখবেন কেউ রাস্তায় আসবে না। ঐ ছবিতে দেখা যায় যে নিচে বাজারের ব্যাগ, তারা নিশ্চয় কেনাকাটার উদ্যেশ্যে বাজারে এসেছিল। করোনা ভাইরাস ছড়াতে নয়। 

কান ধরানোর দণ্ডের কথা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট স্বীকার করেছেন বলে গণমাধ্যম জানিয়েছে। তবে সরকারি ওয়েবসাইটে ঐ ছবি কেন দিলেন তা কিন্তু বোধগম্য হয়নি। তবে নাগরিকদের এভাবে কান ধরিয়ে দাঁড় করার বিষয়টি দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আহসান উল্লাহ শরিফী। তার উচিত পুরো বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা করা।

ছবিটি দেখে কেউ নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদ অনুসারে এ শাস্তি সম্পূর্ণ বেআইনি। স্বাধীনতার ৫০ বছরের দাঁড়প্রান্তে এমন অরাজকতা ও বিচারের নামে কাউকে অসম্মান মেনে নেওয়া যায় না। শাস্তি প্রদানকারী ঐ কর্মকর্তা যেই হোক তার বেআইনি কাজের শাস্তি দাবি করা যেতে পারে। বিচারে কখনও কাউকে কান ধরে উঠবস করাইতে নেই। আইনের মধ্যে যতটুকু ক্ষমতা (দায়িত্ব) দেয়া আছে, তার মধ্যেই বিচার কার্যক্রম সীমিত রাখা উচিত। একটা সার্ভিসের যদি কেউ আইনের বাইরে কোন কাজ করে তার দায় সে নিজেই বহন করবে। যারা আইন ভঙ্গ করবে তাদের শাস্তি দেবে সার্ভিস এবং রাষ্ট্র। তবে এটা ঠিক আইনের বাইরে কাজ যে শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই করেন ব্যাপারটা এমন নয়। অনেক সার্ভিসের ব্যক্তিরা এমন কাজ করে থাকেন। এ ব্যাপারটা এমন যে, পরিবারের অবাধ্য ছেলেটা অন্যের বাসার ফল চুরি করে, মারপিট করে এবং সে অপরাধ করলে সবাই বলে এটা স্বাভাবিক কিন্তু সবচেয়ে ভদ্র ছেলেটি যদি সামান্য অপরাধ করে তবেই হয়েছে। প্রত্যেক সার্ভিসেই এরকম কিছু ব্যক্তি আছেন। তারাই সমস্যা তৈরি করেন। এর দায় পুরো সার্ভিস নিবে না।

দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হয়ে মোবাইলে ছবি তোলা আদৌ ঠিক হয়নি। আমার মনে হয়েছে উনি করোনা ভাইরাসের তীব্রতা অনুধাবন করে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখাকে সামান্য কোন শাস্তি মনে করেছেন। কাউকে এভাবে শাস্তি দিলে যে সংবিধান বা বিদ্যমান মোবাইল কোর্ট আইন ও দেশের ফৌজদারী আইন সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করা হয় তা হয়তো তিনি বুঝতে পারেন নাই। যে ম্যাজিষ্ট্রেট বা বিচারক এই ধরণের ‘কান ধরানোর’ বিচার করলেন তিনি তো তার নিজের ক্ষমতা দেয়া মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ ভালো করে পাঠ করে আসতে পারতেন। সেটি তিনি না পড়েই বিচার কাজে নেমে গেছেন। যা ঠিক হয়নি। আইন জানা থাকলে মানতে ও প্রয়োগ করতে সুবিধা হয়। করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে যাক কারও মাধ্যমে সেটিও কিন্তু এই সময়ে একেবারেই কাম্য নয়।
 
লেখক: মো. তাজুল ইসলাম, কলামিষ্ট ও আইন বিশ্লেষক । ইমেইলঃ bdjdj1984du@gmail.com


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি