৩১ জুলাই ১৯৭১
কামালপুর যুদ্ধ
প্রকাশিত : ১১:১৪, ৩১ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ১১:২৪, ৩১ জুলাই ২০২০
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ময়মনসিংহের উত্তরে (বর্তমানে জামালপুর) সংঘটিত কামালপুর যুদ্ধ এক অবিস্মরণীয় আত্নত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। যদিও শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি ঘাটি দখল করতে সক্ষম হননি কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
ট্যাকটিকালি কামালপুর ঘাটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্থানটি জামালপুর, টাংগাইল ও ঢাকার সংযোগ সড়কের উপর অবস্থিত। পাকিস্তানি বাহিনীর সবচেয়ে দক্ষ ১৪ তম ডিভিশনের সৈন্যরা কামালপুরের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিলেন। লে. জেনারেল নিয়াজীর ভাষায় ‘ভারতের তুরা থেকে ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা অভিমুখী রুটে নদ নদীর প্রতিবন্ধকতা ছিল খুবই কম এবং এটিই ছিল ঢাকা পৌছাতে সংক্ষিপ্ততম রুট’ (দ্য বিট্রায়াল অব ইস্ট পাকিস্তান)। নিয়াজির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ অঞ্চলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর রসদ, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের নিয়মিত কোন ব্যবস্থা ছিল না। যা ছিল তা নিয়মিত দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য ছিল অপর্যাপ্ত। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সরবরাহ পাওয়ার আগ পর্যন্ত হানাদারদের মোকাবিলায় তাই মূলত set piece যুদ্ধের পরিবর্তে গেরিলা পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হত। যার উদ্দেশ্য শত্রু বাহিনীর মনোবল ভেংগে দেয়া ও সরবরাহ ব্যবস্থা বিনষ্ট করা। সে সময় বৃহত্তর সিলেট, ব্রাক্ষণবাড়িয়া অঞ্চলে এই কাজে নিয়োজিত হয় দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়া মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীকে কর্নেল ওসমানি ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে ডেকে পাঠান। ১৩ জুন রাতে আলোচনায় ওসমানি ১ম, ৩য় এবং ৮ম রেজিমেন্ট নিয়ে ব্রিগেড গঠনের কথা জানান। পরবর্তীতে আসামের মানকা চরের গভীর জংগলে জেড ফোর্সের গঠন ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
প্রশিক্ষণ শেষে জুলাই মাসের ৩য় সপ্তাহে মইনুল হোসেন চৌধুরীকে মেজর জিয়া (জেড ফোর্সের অধিনায়ক) কামালপুর ঘাটি ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে সম্মুখ যুদ্ধ করে দখল করার কথা বলেন। তবে মইনুল হোসেন এভাবে বড় আকারে সেট পিস যুদ্ধের পরিবর্তে পূর্বের মত হিট এন্ড রান পদ্ধতিতে আরও কিছুদিন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মত দেন। কারণ মইনের মতে অধিক সজ্জিত পাকিস্তানি ব্যাটালিয়নের সাথে যুদ্ধে সমগ্র ব্যাটালিয়নের যুদ্ধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
তবে ভিন্নমত থাকলেও উচ্চ কমান্ডের নির্দেশ মেনে নিয়ে রেকি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রেকির (reconnaissance) উদ্দেশ্য ছিল আক্রমণ এর দিক নির্ণয়, অস্ত্র বাংকারের অবস্থান ইত্যাদি তথ্য জানা। কিন্তু রেকি করার সময় ২ জন পাক সেনা রেকি বাহিনীর সামনে পরে যাওয়ায় রেকি বাহিনী তাদের আক্রমণ করে মেরে ফেলে ও শত্রুর জি ৩ জার্মান রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে চলে আসে। যা মইনুল হোসেনকে ক্ষুদ্ধ করে কেননা তার উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ অতর্কিতভাবে কামালপুর আক্রমণ করা। যা হোক রেকি করার পর ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন এবং লেফটেন্যান্ট মান্নান আক্রমনের পক্ষে মতামত দেন।
মাটির উপর ম্যাপ একে বিস্তারিত পরিকল্পনার পর ৩১ জুলাই রাত সাড়ে তিন টা আক্রমনের তারিখ ও সময় নির্ধারণ করা হয়। কামালপুরের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল পাকিস্তানি ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট এবং এপিসি এ এফ।
বৃষ্টির জন্য আক্রমনে বাধা সৃষ্টি হলেও ৩১ জুলাই নির্ধারিত সময়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ (বি কোম্পানি ) ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন (ডেল্টা কোম্পানি ) এর নেতৃত্বে দুটি কোম্পানি শত্রুর ঘাটির দিকে ক্ষিপ্র গতিতে অগ্রসর হয়। ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্ত্বে অপর কোম্পানি কে নির্দেশের জন্য অপেক্ষায় থাকতে বলা হয়। আক্রমনের আগে শত্রুপক্ষের উপর গারো পাহাড়ের কাছ থেকে হালকা কামানের গোলা বর্ষণ শুরু হয় সাথে সাথে পাক বাহিনীও পাল্টা কামানের গোলার মাধ্যমে জবাব দিতে শুরু করে।
এ থেকেই সতর্ক পাক বাহিনী সৈন্য ও অস্ত্র ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রমান পাওয়া যায়। শত্রু ঘাটিতে প্রচন্ড যুদ্ধের মাঝে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের অসীম সাহসে আর তার সাথের মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশের প্রচন্ড আক্রমনে পাকিস্তানীদের অবস্থানের একেবারে ভেতরে ঢুকে পড়েন। উনি বলছিলেন ইয়াইয়া খান এখনও এমন বুলেট তৈরি করতে পারেনাই যা মমতাজকে ভেদ করবে যদি মরতেই হয়, বাংলার মাটিতে শহিদ হও!
বাংকারের ভেতর হাতাহাতি এমনকি বেয়নেট ব্যবহার শুরু হয় এবং বীরের মত যুদ্ধ করে সালাহউদ্দিন মমতাজ শহীদ হন। যাকে পরবর্তীতে বীর উত্তম পদকে ভূষিত করা হয়েছিল। কারো মতে উনি ভারী আর্টিলারি শেল এর আঘাতে শহিদ হন। সহযোদ্ধা দের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই যোদ্ধার লাশ আনতে গিয়ে যুদ্ধের মধ্যেই প্রথমে সিপাহি হায়াত আলী ও পরে সিপাহি সিরাজুল ইসলাম শহিদ হন। কিংবদন্তি যোদ্ধা সালাহউদ্দিন মমতাজ ৪ জুলাই ১৯৭১ পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে ছিলেন।
একজন আহত সৈন্যের কাছে সালাউদ্দিন মমতাজ নিহত হবার খবর জানতে পেরে মেজর মইন ওয়ারলেসে ক্যাপ্টেন মাহবুবকে কমান্ড করেন পেছন থেকে আক্রমনের জন্য। কিন্তু ওয়ারলেসে ক্যাপ্টেন মাহবুবের সাড়া না পেয়ে তিনি ছোট গাছের আড়াল (যেখান থেকে উনি সৈন্য পরিচালনা ও নেতৃত্ত্ব দিচ্ছিলেন ) থেকে খোলা জায়গায় চলে আসেন যাতে ওয়ারলেস ভালোভাবে কাজ করতে পারে। কিন্ত হঠাত একঝাক মেশিনগানের গুলিতে তার ওয়ারলেস অপারেটর শহীদ হন। ওয়ারলেস সেটটি অকেজো হয়ে যায়। ফলে তিনি আবারো গাছের আড়ালে এসে চিতকার করেই আদেশ দিতে থাকেন। হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকা ও ভোরের আলো ফুটে উঠায় শত্রুপক্ষের গোলা বর্ষনের মধ্যেই আহতদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা শুরু হয়। মেজর মইন সবাইকে সরে আসার নির্দেশ দেন।
বীরের মত যুদ্ধ করেও শত্রুর জনবল, পাকা ব্যাংকার এবং প্রচন্ড বৃষ্টির কারনে অনেক আত্নত্যাগের পরও সেদিন কামালপুর ঘাটি দখল করা সম্ভব হয়নি। বাংলা মায়ের ৩৫ জন বীর যোদ্ধা শহিদ এবং ক্যাপ্টেন হাফিজ, লেফটেনেন্ট মান্নানসহ আরও ৫৭ জন আহত হন।
পাক বাহিনীরও বিপুল পরিমাণ হতাহত হয়। পাকিস্তানের মেজর সিদ্দিক সালেক তার Witness to surrender গ্রন্থে মুক্তিবাহিনীর ২০০ জন সৈন্য মারা যায় বলে দাবি করেন। এতেই পাকিস্তানিদের ক্ষয় ক্ষতির ভয়াবহতা সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়।
লেখক: ব্যাংকার ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা
এমবি//