কাশেম ভাই ও সম্বাদিক
প্রকাশিত : ১৫:৩৯, ১৯ জুলাই ২০২০
প্রায় ত্রিশ বছর পর কাশেম ভাইয়ের সাথে দেখা। শেষবার যখন তাকে দেখি তখন আমি স্কুলছাত্র। আর এখন আমার ছেলে স্কুলে পড়ে। কাশেম ভাইকে না দেখার কারণ, আমরা যখন ছোট তখন তিনি জীবিকার প্রয়োজনে স্ত্রী-সন্তানসহ পাড়ি জমান অন্য জেলায়। কাশেম ভাই আমার পড়শী সম্পর্কের বোনের ভাশুর। সে হিসেবে বেয়াই। সেই বোনের বাড়িতেই এতো বছর পর আবার দেখা। তার চেহারা খুব একটা বদলায়নি। শুধু বয়সের ছাপ পড়েছে। এখানে থাকতে তিনি আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা দলের সদস্য ছিলেন। সে হিসেবে সরকারি চাকরিজীবী। ঘরে আনসারের টুপিসহ খাকি পোশাক পরা তার আবক্ষ একটা ছবি টাঙ্গানো ছিল। ছোট বেলায় খুব আগ্রহ নিয়ে তার পুলিশ পুলিশ ভাবের এই ছবিটা আমরা দেখতাম।
আনসারের চাকরিটা ছিল অনিয়মিত। মাঝে মধ্যে ডাক পড়তো কাশেম ভাইয়ের। কিছু সময় কাজ করার পর আবার বাড়িতে বেকার। রসিকতা করে পাশের গ্রামের শামছু দাদা বলতেন, আরে থোও, থোও, কাশেমেরও একটা চাকরি আর আমি শামছুরও একটা গেরস্থি। কথাটার মধ্যে ক্ষোভ, কষ্ট এবং কটাক্ষ লুকিয়ে আছে। কারণ, চাকরি করেও কাশেম যেমন অভাবী তেমনি অনেক জমির মালিক শামছুও ভালো চাষবাস করতে না পেরে অভাবী।
আমার সেই পড়শী বোন কাশেম ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাকে চিনতে পারছেন না ভাইজান, আমার ভাই অমুক! ঢাকায় থাকে। সাংবাদিক। কাশেম ভাই আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘সম্বাদিক!’ কণ্ঠে অবজ্ঞা ঝরে পড়লো। সহজ হবার চেষ্টা করে বললেন, ছেড়া (ছেলে) তো বড় হয়া গ্যাছে। কিন্তু সম্বাদিকরা তো টাউট বাটপার...!
আমি খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়লাম। অস্বস্তিতে বোনটাও। লোকটা যে ত্রিশ বছর পর বেয়াই হিসেবে ঠাট্টা করছে না তা নিশ্চিত। আমি কিছু বলার আগেই বোনটি লজ্জিতভাবে বললো, ও এই রকম না। ও মানুষের উপকার ছাড়া অপকার করে নাই কোনোদিন।
আমি আহত হতে পারি ভেবে কাশেম ভাইও যেনো একটু লজ্জা পেলেন। তারপর তার অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করতে লাগলেন- শোন ভাই, আমার এলাকার সম্বাদিকদের চরিত্র কেমন! যৌতুকের কারণে বড় মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেরে আধমরা করে পাঠিয়ে দেয় আমার কাছে। আমি খুব অসহায় হয়ে পড়ি। কেউ কেউ পরামর্শ দিলো মামলা করতে। গেলাম। বুঝলাম, ঘুষ কিংবা উপর মহলের হুকুম ছাড়া মামলা করতে পারবো না। কেউ কেউ বললো সম্বাদিকদের জানাও। জানালাম। তাদেরও দাবি টাকা। থানার পরিমাণের তুলনায় এখানে কম লাগায় কয়েকজনকে এক হাজার টাকা করে দিলাম। কিন্তু কোনোই কাজে আসে নাই। জিজ্ঞেস করলে বলে, এই টাকায় নিউজ হয়? টাকা ফেরত চাইলে বলে, তোমার বিপক্ষে যায় এমন নিউজ যাতে না হয় সেটা দেখবো নে। নইলে তো তোমার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে এটা সেটা নিয়ে চলে আসছে এমন নিউজ হয়া যাইতো। তোমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের অনেক বেশি টাকা দিতে চাচ্ছে।
শুনে আমি হতবাক। সম্বাদিকরাও এমন বাটপারি করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। আসলে সবার কথায় আমি তাদের কাছে গিয়েছিলাম। নাইলে তো জানাই হতো না ঘটনা। তা ভাই তুমি কোন পত্রিকার সম্বাদিক?
আমি আমার প্রতিষ্ঠানের নাম বললাম। তিনি যেনো একটু চমকে উঠলেন শুনে। আবারও বলতে লাগলেন, কিছু মনে করো না ভাই। আমি তোমারে উদ্দেশ্য করে কথাডা কই নাই।
সাংবাদিক শব্দটা যিনি ভালোভাবে উচ্চারণ করতে পারেন না, তেমন একজন সহজ-সরল মানুষের কথায় কিছু মনে করার প্রশ্ন আসে না আমার। আমি শুধু ভাবছিলাম, মফস্বলের সাংবাদিকতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। শুধু মফস্বলই বা বলছি কেন, সবখানেই তো আজ একই অবস্থা। সব পেশাতেই ভালোমন্দ মানুষ আছে। তবে মফস্বলে মনে হয় ভালো সাংবাদিক সংখ্যালঘু। নইলে কাশেম ভাইয়ের মতো সাধারণ কম শিক্ষিত একজন মানুষের সাংবাদিক সম্পর্কে এত বাজে ধারণা জন্মানোর কথা নয়। অথচ সাংবাদিকতা সবচেয়ে মহৎ পেশার মর্যাদা রাখার কথা।
আমাদের কথার মাঝখানে ভগ্নিপতি নাজিমদ্দিন ভাই এসে হাজির। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। কবে বাড়িতে এলাম জানতে চাইলেন। তারপর পরিবারের সবার কুশলাদি জেনে ব্যস্ত হলেন আপ্যায়নে। এরই মধ্যে আলোচনার বিষয় তার কর্ণগোচর হলো। এক পর্যায়ে সেও বক্তা হিসেবে আবির্ভূত হলো। বর্ণনা করলো আমি মফস্বলে সাংবাদিকতা করার সময় কীভাবে তাকে সহযোগিতা করেছিলাম। সেটা শেয়ার করবো আগামী পর্বে, ইনশাআল্লাহ।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, নিউজরুম এডিটর, একুশে টেলিভিশন, ঢাকা।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।