কাস্টমস দিবসের দৃষ্টিপাত : নিরাপদ হোক সীমান্ত
প্রকাশিত : ১৮:৪৭, ৩১ জানুয়ারি ২০১৯
আন্তর্জাতিক কাস্টমস দিবস। অনেক ঘটা করে দিবসটি উদ্যাপন হচ্ছে দেশব্যাপী। সবার অংশগ্রহণে সকালে শোভাযাত্রা ও বিকেলে সেমিনার আয়োজন এর মূল আকর্ষণ। প্রকাশনা, ক্রোড়পত্র প্রচার এবং টেলিভিশনে আলোচনা দিবসের নানা দিক।
এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে—‘অবাধ বাণিজ্য, ভ্রমণ এবং পরিবহনের জন্য ঝগঅজঞ সীমান্তব্যবস্থা’। এই ধারণাটি আধুনিক কাস্টমসের প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশসহ ১৮৩টি সদস্য-সংবলিত বিশ্ব কাস্টমস সংস্থা (ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশন) প্রতিবছর দিবসটি পালনের জন্য ২৬ জানুয়ারি নির্ধারণ করেছে।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ের মধ্যে চারটি দিক নিহিত আছে এবং তা আধুনিক কাস্টমসের স্বরূপকে ধারণ করেছে। এর প্রথমটি হলো ‘এস’ বা নিরাপদ
(Secure)| এর দ্বারা আসলে সীমান্তকে নিরাপদ রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেক অপরাধের বৈশ্বিক সংযোগ থাকে। বিশ্বায়নের যুগে পণ্যের পরিবহন ও যাত্রীর গমনাগমন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এক দেশের অন্যের ওপর নির্ভরতা আগের তুলনায় স্ফীত হয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের ভিত ও সচলতা দৃঢ় হয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি বেড়েছে অপরাধজগতের আনাগোনা। পাল্টেছে অপরাধের ধরনও। এমন অনেক অপরাধ আছে, যার পরিকল্পনা হয় এক দেশে, অর্থ ও ক্ষতিকারক পণ্য (অস্ত্র, বিস্ফোরক ও রাসায়নিক দ্রব্য) আসে অন্য দেশ থেকে, আর সংঘটিত হয় আরেক দেশে। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় বিভিন্ন দেশে বসবাসরত অপরাধীচক্র নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে এ কাজটি করার সুযোগ নিচ্ছে। এসব অপরাধের মধ্যে সন্ত্রাস উল্লেখযোগ্য। গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করেছে।
সীমান্তের প্রহরী হিসেবে কাস্টমসের ভূমিকায় এই নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। যেহেতু অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভরতা বর্তমান বিশ্বে একটা বাস্তবতা এবং তা অগ্রাহ্য করা যাবে না, তাই সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নিরাপদ হিসেবে গড়ে তোলাটা সময়ের দাবি। বিশ্ব কাস্টমস সংস্থার সমন্বিত ও নিজস্ব উদ্যোগে নানামুখী আধুনিকায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন চলছে বাংলাদেশ কাস্টমসে। বিশেষ করে চোরাচালানের মাধ্যমে অস্ত্র, বিস্ফোরক, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ও পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকিস্বরূপ পণ্যসহ নানা অপরাধ প্রতিরোধ গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। এরই মধ্যে
Programme Global Shield, Small Arms and Light Weapons (SALW) and Advance Passenger Information (API) and Passenger Name Record (PNR) নামের কিছু উদ্যোগের বাস্তবায়ন চলছে। এ ছাড়া নানা ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি (যেমন Raman Spectometer, Back Scatter X-Ray Machine) যুক্ত হয়েছে এবং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব কাস্টমস সংস্থার আয়োজনে নিরাপত্তামূলক আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অভিযানে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ কাস্টমস। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাইলো এপির ‘অপারেশন আইরিন ১ ও ২’। এ ছাড়া দেশীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পুলিশ, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, র্যাবসহ অন্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে সীমান্ত নিরাপদ করার জন্য। স্বর্ণ, মুদ্রা ও মাদক পাচার রোধে কার্যকর আইন প্রয়োগ করছে বিমানবন্দরসহ কাস্টমস স্টেশনগুলোতে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, ‘এম’ বা পরিমাপযোগ্য (Measurable)| এর দ্বারা বাংলাদেশ কাস্টমস যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা যেন শিগিগরই দৃষ্টিগোচর হয়। সরকারের অর্থ খরচ করে নানা কর্মসূচি নেওয়া হলেও এর ফলাফল ইতিবাচক করার দায়িত্বটা কাস্টমস কর্তৃপক্ষেরই। প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা প্রদান ও উদ্দেশ্য অর্জন কতটা সফল হয়েছে, তা নির্দিষ্ট করাটা গুরুত্বপূর্ণ। সময়াবদ্ধ ক্রমাগত উন্নয়ন সাধন বাংলাদেশ কাস্টমসের এখন বড় দায়িত্ব। সময়ে সময়ে পরিচালিত ‘টাইম রিলিজ স্টাডি’র মাধ্যমে দেখা হচ্ছে, কোথায় কোন সমস্যা হচ্ছে এবং এতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
তৃতীয়টা হচ্ছে, ‘এ’ বা স্বয়ংক্রিয় (Automated) ব্যবস্থা চালু করা। বহুসংখ্যক পণ্য ও যাত্রীকে উত্তম সেবা দেওয়ার জন্য প্রায় প্রতিটি দেশে প্রযুক্তিনির্ভর স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশ কাস্টমসও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড নামের ইন্টারনেটভিত্তিক এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে বেশ আগে থেকেই। এর মাধ্যমে যেকোনো ব্যবসায়ী যেকোনো স্থান থেকে তার আমদানি বা রপ্তানীকৃত পণ্যের ঘোষণা দাখিল করতে পারছেন। সে অনুযায়ী শুল্কায়নও সম্পন্ন হচ্ছে। বর্তমানে এটি আরো সম্প্রসারণের উদ্যোগ এগিয়ে চলছে। অনলাইন পেমেন্টে এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কাজটি হচ্ছে। এর ফলে একদিকে স্বচ্ছতার বিষয়টা যেমন নিশ্চিত হচ্ছে, তেমনি দ্রুত সেবাপ্রাপ্তি ঘটছে।
চতুর্থ বিষয়টা হচ্ছে ‘আর’ বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনানির্ভর (Risk Management Based)। বিশ্বায়নের যুগে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি যেমন বাড়ছে, তেমনি যাত্রীর গমনাগমনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে অনুযায়ী কাস্টমসের বাড়তি জনবল ও সম্পদ বাড়ানো সম্ভব নয়। তাই উত্তম চর্চার অংশ হিসেবে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে এগিয়ে নিতে হবে। এই চর্চা অনুযায়ী সব পণ্য ও যাত্রী ঝুঁকিপূর্ণ নয়। শুধু ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করাটা গুরুত্বপূর্ণ। নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ড এবং গোপন তথ্য অনুযায়ী ওই সব ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য বা যাত্রী কাস্টমসের তল্লাশির আওতায় আসবে।
শেষ বিষয়টা হলো, ‘টি’ বা প্রযুক্তি নির্ভরতা (Technology Driven) চালু করা। এটি আধুনিকায়নের অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক অনুষঙ্গ। অন্যান্য দেশে পণ্য পরীক্ষায় নানা ধরনের প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ কাস্টমসেও এসব প্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরসহ বিভিন্ন স্টেশনে চালু করা হয়েছে কনটেইনার স্ক্যানিং মেশিন। ডগ স্কোয়াড ও হিউম্যান স্ক্যানিং মেশিন চালুর উদ্যোগটিও বিবেচনাধীন রয়েছে।
এ সবকিছুই করা হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাত্রীসেবা সামনে রেখে। এর মূল দর্শন হচ্ছে সময় ও খরচ বাঁচিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা। আমদানিপণ্যের খালাসের সময় বাঁচাতে পারলে ‘লিড টাইম’ কমানো যাবে, অন্যদিকে তাদের পণ্যটি সময়মতো গন্তব্যে সরবরাহও নিশ্চিত হবে।
তবে পণ্য খালাসে জড়িত শুধু কাস্টমসই এককভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা নয়। সঙ্গে রয়েছে বন্দর, বিএসটিআই, কোয়ারান্টাইন, পরিবহনসহ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান। তাদেরও একটা একক প্ল্যাটফর্মে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে একটা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ‘ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো’ নামের এজাতীয় কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে আমদানিকারককে তাঁর আইনি বিধান অনুযায়ী আর অন্য জায়গায় দৌড়াতে বা সময়ক্ষেপণ করতে হবে না। এক জায়গায় বসে এবং দ্রুত সেবাটি হাতের কাছে পাওয়া যাবে।
অতীতে রাজস্বনির্ভরতাই ছিল কাস্টমসের অন্যতম কাজ। বিশ্ববাস্তবতায় নিরঙ্কুশ রাজস্বনির্ভরতা থেকে সরে এসে বাণিজ্য সহায়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে কাস্টমস। নানামুখী আধুনিকায়নের মাধ্যমে নিরাপদ ও আইনসিদ্ধ বাণিজ্য ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করাটা হচ্ছে নতুন কাস্টমসের দৃষ্টিপাত।
লেখক : কমিশনার অব কাস্টমস ও ভ্যাট, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক
moinul.khan@customs.gov.bd
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।