ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

কিডনি রোগীদের খাবার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:৪৪, ২৯ মে ২০২১

বর্তমানে আমাদের দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা খুবই দ্রুতগতিতে বাড়ছে, তাই এ রোগের ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। কিডনির প্রধান কাজ রক্ত পাম্প করে দেহের বিপাকের বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়া। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইউরিয়া, যা প্রতিদিন ৩০ গ্রামের মতো নির্গত হয়।

এর অর্ধেকটা আসে খাবার থেকে, বাকিটা আসে শরীরের বিভিন্ন টিস্যুর ধ্বংসপ্রাপ্তি থেকে। ৩০ গ্রাম ইউরিয়া নির্গমনের জন্য কমপক্ষে ৭৫০ মিলিলিটার প্রস্রাব তৈরি এবং নির্গত হতে হয়; কিন্তু কিডনি রোগীর ক্ষেত্রে বিশেষ করে একুইট নেফ্রাইটিস হলে নির্গতের পরিমাণ আস্তে আস্তে কমে যায় এবং ইউরিয়া ও অন্যান্য বর্জ্য শরীরে জমা হতে থাকে। এরই অংশ হিসেবে আজকে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (সিকেডি) বা দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগীদের খাবার কেমন হবে তা জেনে নেয়া যাক। এ বিষয়ে কথা বলেছেন, পুষ্টিবিদ সাজেদা কাশেম জ্যোতি।

কিডনিকে পুরোপুরি বিকল না করতে বা আরো ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সঠিক পথ্য বা খাবার নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় । কেননা এই সময়ে রক্তে প্রোটিন, ক্যালরি, ভিটামিন এবং মিনারেলস এর সঠিক ভারসাম্য নিশ্চিত করতে সঠিক ডায়েট বা খাদ্যতালিকা অনুশরন করতে হয়। ডায়েটের উদ্দেশ্য হলো (১) সঠিক পুষ্টিমান বজায় রাখা ও ভারসাম্য রক্ষা করা, (২) কিডনিজনিত বিষক্রিয়া কমিয়ে রাখা (৩) শরীরে প্রয়োজনীয় প্রোটিন ভেঙে যেতে বাধা দেয় (৪) রোগী শরীর ভালো লাগা এবং কিডনি ফেইলুরের বর্তমান অবস্থা থেকে যেন আর খারাপ না হয় (৫) ডায়ালাইসিসের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনা ইত্যাদি। তাই ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (সিকেডি) বা দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগীদের কতটুকু খাবার খেতে হবে এবং পানীয় পান করতে হবে—এটা জানা খুব জরুরি। বিকল হওয়া কিডনি বা বৃক্ক তখন শরীরের বর্জ্য পদার্থগুলো অপসারণ করতে পারে না বিধায় চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শে কিডনিবান্ধব খাবারের দরকার হয়।

সুঠাম স্বাস্থ্যের জন্য খাদ্যের ৬টি উপাদান অপরিহার্য। এগুলো হলো- আমিষ, শর্করা, স্নেহ জাতীয় খাবার, ফল-শাক-সবজী ও পানি, এর পাশাপাশি দুগ্ধজাত খাবার। তবে কিডনি রোগিদের ক্ষেত্রে এর কিছু ব্যতিক্রম ঘটবে।

আমিষ জাতীয় খাবার
আমাদের শরীরের কাঠামো তৈরি হয় আমিষ দিয়ে। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ এগুলোতে প্রথম শ্রেণির আমিষ থাকে। আবার ডাল ও বিভিন্ন বীচি জাতীয় খাবারে আমিষ থাকে যা দ্বিতীয় শ্রেণির আমিষ। দেহে ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলে আমিষ ভেঙ্গে নাইট্রোজেন, ইউরিয়া, ক্রিয়েটিন ইত্যাদি তৈরি হয়। সুস্থ অবস্থায় কিডনির মাধ্যমে এগুলো প্রস্রাবের সঙ্গে নির্গত হয়ে আমাদের বিষমুক্ত রাখে। কিন্তু কিডনি বিকল হয়ে গেলে এগুলো রক্তে জমে রোগীকে অসুস্থ করে তোলে। তাছাড়া অতিরিক্ত আমিষ রক্তে থাকলে তা কিডনির ছাকনির ক্ষতি করে। সেই জন্য দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগিদের আমিষ জাতীয় খাবার কম খেতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ শনাক্ত হওয়ার পর প্রতিকেজি দৈহিক ওজনের জন্য প্রোটিনের প্রয়োজন ০.৫-০.৮ গ্রাম এবং গুরুতর রোগীর জন্য ০.৫ গ্রাম। তাই এক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী প্রানিজ আমিষ হিসেবে মাছ, মুরগীর মাংশ, দুধ, ডিম ইত্যাদি একটি নির্দিষ্ট পরিমানে খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। পাশাপাশি ডাল, বাদাম, কাঁঠালের বিচি, সিমের বিচি ইত্যাদি খাবার পরিহার করতে হয়।

ক্যালরি
আমাদের কার্যক্ষমতার জন্য জ্বালানী প্রয়োজন - এটাই ক্যালরি । আমরা বেশীরভাগ ক্যালরি পাই শর্করা থেকে। ভাত, আলু, সুজি, গম,আটা,ময়দা,ভূট্টা ক্যালরির মূল উৎস। কিডনি রোগিদের যেহেতু ক্ষুধা মন্দা থাকে- অনেকের ওজন কমে যেতে পারে। যাদের ওজন কম তারা প্রচুর পরিমানে এগুলো খেতে পারবে। তবে আলুতে প্রচুর পটাশিয়াম থাকে এক্ষেত্রে একটু সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া পায়েশ , সেমাই, পুডিং, হালুয়া ইত্যাদিও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে খেতে পারবেন। তবে, কিডনি রোগের পাশাপাশি ডায়াবেটিস থাকলে ক্যালোরির পরিমাণ ঠিক করে নিতে হবে এবং মিষ্টি জাতীয় খাবার রক্তে গ্লুকোজের পরিমানের উপর ভিত্তি করে কম বা পরিহার করতে হবে।

স্নেহ জাতীয় খাবার
স্নেহ জাতীয় খাবারে প্রচুর ক্যালরি থাকে। প্রানিজ স্নেহ জাতীয় খাবার- যেমন গরু, খাসীর চর্বি, ডিমের কুসুম, দুধের সর এগুলোতে খারাপ লিপিড থাকে যা রক্তনালীতে বাসাবেঁধে হৃদরোগ, ব্রেন স্ট্রোক বা কিডনি রোগ করে থাকে। এগুলো পরিহার করতে হবে। সয়াবিন তেল, অলিভ অয়েল, সানফ্লাওয়ার, সরিষার তেল পর্যাপ্ত খাওয়া যাবে। চর্বিযুক্ত মাংস পরিহার করতে হবে।

ফল-শাক-সবজী
প্রায় সবধরনের ফল, শাক-সবজি, সালাদ ইত্যাদি খাবার গুলোতে পটাশিয়াম বিদ্যমান। অতিরিক্ত বা কম পটাসিয়াম দুইটিই রোগীর জন্য খারাপ। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে - রক্তের পটাশিয়াম বেড়ে যাবার প্রবণতা থাকে। এক্ষেত্রে মাঝে মাঝে রক্তের উপাদান পরীক্ষা করে দেখে নিতে হয়। সেক্ষেত্রে কম পটাশিয়াম যুক্ত শাক-সবজি - লাউ, চিচিঙ্গা, করলা, সজনা, ডাটা শাক, লাল শাক, কাচু শাক, জিংগা, পেপে ইত্যাদি খাওয়া যাবে। এবং অধিক পটাশিয়াম যুক্ত শাক-সবজি - ফুল কপি, বাঁধা কপি, পালং শাক, কচু, মূলা, পুইশাক, ঢেড়স, গাজর, কাঠালের বিচি, শীমের বিচি, মূলাশাক, লেবুর মত টক জাতীয় খাবার ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। ডাব, কলা, আঙ্গুর একে বারেই খাওয়া যাবেনা, কেননা, এতে পটাশিয়ামের পরিমান বেশি। কম পটাশিয়াম যুক্ত ফল যেমনঃ আপেল, পেয়ারা, পাকা পেপে, নাসাপাতি ইত্যাদি খাওয়া যাবে।

দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
সব ধরনের দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারে ফসফরাস বিদ্যমান। ইউরিয়া বেশি রোগীদের ক্রমান্বয়ে ফসফরাস লেবেল বাড়তে থাকে এবং রোগীর এসিডোসিস হয়। তাই রক্তে ফসফরাস মাত্রার উপর ভিত্তি করে এধরনের খাবার গ্রহণ সীমিত করতে হবে।

লবণ
লবণ বা সোডিয়াম নিয়ন্ত্রিত পথ্য কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। রক্তচাপ, রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা, ইডিমা বা শরীরের পানির পরিমাপের ওপর ভিত্তি করে লবণের পরিমাপ করা হয়। সাধারণত দুই থেকে পাঁচ গ্রাম লবণ নির্ধারণে করা হয় যা নির্ভর করবে রোগীর শারীরিক অবস্থা ও ডায়েটেশিয়ানের ওপর। তবে আলাদা লবণ অবশ্যই পরিহার করতে হবে এবং অতিরিক্ত সোডিয়ামযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। যেমন : চিপস, পাপর, চানাচুর, আচার ইত্যাদি। যা শুধু কিডনি রোগীর চিকিৎসায় নয়, কিডনি রোগ প্রতিরোধেও সাহায্য করে।

পানি 
ক্রনিক কিডনি ফেইলুরে পানি গ্রহণ নিবিড়ভাবে মনিটর করতে হবে। দৈনিক কতটুকু প্রস্রাব হচ্ছে সেই তারতম্যের উপর পানির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। দৈনিক চা, দুধ, পানি সব মিলিয়ে তরলের হিসাব করা হয়। কোনো রোগীকে কতটুকু তরল বরাদ্দ করা হবে তা নির্ভর করবে রোগীর অবস্থার ওপর। শরীরের ইডিমা, হিমোগ্লোবিনের মাত্রা, সোডিয়ামের মাত্রা, ইজিএসআর- এসবের মাত্রার উপর ভিত্তি করে দৈনিক দেড় থেকে তিন লিটার পর্যন্ত পানি খাওয়া যেতে পারে। যদি প্রস্রাব একেবারেই না হয় বা কম হয় তাহলে পানি দেড় লিটারের নিচে সীমিত রাখতে হবে।

একজন বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদের নির্দেশনা অনুযায়ী খাদ্য তালিকা তৈরী করে খাবার খেলে কিডনি রোগ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভাব। দীর্ঘ মেয়াদি ক্রনিক কিডনি রোগী এ ধরনের খাবার মেনে চললে কিডনিকে মারাত্মক জটিলতা থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। কিছুটা এক ঘেয়েমি হলেও ধৈর্যের সঙ্গে সঠিক পথ্য ব্যবস্থাপনা মেনে চলা প্রত্যেক কিডনি রোগীর জন্য একান্ত জরুরি।

[ বি.দ্র. রোগী ভেদে কিডনির পথ্য নির্ধারণে কিছুটা ভিন্নতা থাকে। কেননা রক্তে ইলেকট্রোলাইটসের পরিমাণ, হিমোগ্লোবিনের মাত্রা, ইউরিয়া ও ইউরিক এসিডের পরিমাণ, রক্ত ও ইউরিনে এলবুমিনের পরিমাণ এবং ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা ভেদে পথ্যটিকে সাজাতে হয়। সে ক্ষেত্রে একজন ক্লিনিক্যাল ডায়েটেশিয়ানের পরামর্শ নেওয়া একান্ত জরুরি।]

পুষ্টিবিদ, গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টার
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ডায়েটেটিক্সস এন্ড নিউট্রিশন ট্রাস্ট

এসএ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি