কিন্টা কিন্টের দাসত্বের এক গল্প
প্রকাশিত : ২৩:২৬, ১ জানুয়ারি ২০২০
হলিউডের রুটস চলচ্চিত্রের একটি অংশ- সংগৃহীত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের পুরোটাই রাঁধুনির চাকরি করা এক পুরুষের হঠাৎ খেয়াল হল কিছু লেখা দরকার। জীবনের ৩৮টা বছর কেটে গিয়েছে নানান বঞ্চনায়। সত্যি কিছু লেখা দরকার। কোথা থেকে শুরু করবেন, কিভাবে শুরু করবেন এসব খুঁজে পেতে তিনি আকাশ পাতাল ভাবেন। ভাবতে ভাবতে ধমনীর কথা মনে পড়ল। ধমনীর ভেতরে তির তির করে অনেক রহস্য বইছে, অনেক না জানা কথাও বইছে ।
এরপর পুরুষটি নিজের পূর্ব পুরুষদের খুঁজে বের করতে শুরু করলেন। এক পর্যায়ে দেখা গেল চৌদ্দতম পূর্বপুরুষ ছিল কিন্টে নামের এক ডাকাত! এই ডাকাতের আদি রক্তের ধারা আফ্রিকার গাম্বিয়া থেকে এসেছে। পুরুষ তখন নিউ ইয়র্ক থেকে গাম্বিয়া ছুটে বেড়াতে লাগলেন। এভাবে আটষট্টিবার!
শেকড় খুঁজতে গিয়ে কি পরিমাণ নিপীড়ন, কি পরিমাণ গ্লানি তিনি বের করে আনতে পারলেন নিজেও বুঝতে পারেননি। জুফ্রে গ্রামের মানডিনকা গোত্র। সতেরো শতাব্দী। সেই গোত্রের অবস্থা সম্পন্ন পরিবারে একটা ছেলে হল। কানে আজান দিয়ে তার নাম রাখা হল কুন্টা কিন্টে। রুটস এর গল্পকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র, মিনি সিরিজ অমেরো এবং বিন্টা কিন্টের ছেলে কুন্টা বড় হতে থাকে ধর্ম এবং উপজাতের ছায়ায়। কুন্টার কোরআনে হাতে খড়ি হয়। পরিবার আর গ্রামীণ সমাজের দায় দায়িত্ব নেয়ার দীক্ষা নিতে থাকে একটু একটু করে।
একদিন কাঠখণ্ড খুঁজতে গিয়ে সব এলোমেলো হয়ে গেল। কিশোর কুন্টাকে যখন অমানুষিক যাত্রার ভেতর দিয়ে ১৭৫০ সালের দিকে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয় তখন তার বুকের ভেতর একমাত্র সম্বল হিসেবে সঞ্চিত ছিল আদিপুরুষের শৌর্য সঙ্ক্রান্ত ইতিবৃত্ত। নির্যাতনে নির্যাতনে ঝাঁঝরা হয়ে যায় ক্রীতদাসের শরীর। বুকে বীরত্বগাঁথা তুলে রাখা আছে, তাই পারেনা মেনে নিতে। সে পালায়। বারবার পালায়। আরও একবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর মালিক জন ওয়ালার পায়ের পাতা কেটে নিয়েছিল। এটা শাস্তি। কুন্টা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তার দাসের জীবন শুরু করে। বিয়ে করে বয়সে বড় আরেক ক্রীতদাসী বেল ওয়ালার কে। তাদের দুজন থেকে পৃথিবীতে কিসি আসে। মনিব জন ওয়ালার কুন্টার মেয়ে কিসির নামের সাথে ওয়ালার পদবী জুড়ে দেয়। নিয়ম এটা। অথচ কিসি একটু একটু করে অবকাশ পেলেই বড় হতে থাকে মানডিনকা গোত্রের রক্ত টগবগ করা বন্ধনহীন জীবনের গল্প শুনে শুনে।
কিন্তু জীবন! স্বপ্নের মত গল্পগুলো শুনতে শুনতেই কিসিকে একদিন মালগাড়িতে টেনে হিঁচড়ে তুলে দেয় মনিব। পেছনে জীবন্ত মৃতের মত পড়ে থাকে তার অনন্তকালের দাস পিতা মাতা। চরিত্রহীন মনিব টম লীর শরীর থেকে ছিটকে পড়া সন্তান জর্জ লী কে কিসি ছল ছল চোখে শোনায় তারা একসময় আজন্ম দাস ছিল না। তারা ছিল আফ্রিকার বাতাসে উড়ে বেড়ানো পাখি। মা তার মিশ্র বর্ণের ছেলেকে শোনায়- কালো মানুষের গল্প, আফ্রিকার সূর্য ওঠার গল্প, মানডিনকার গল্প, মুক্ত বিহঙ্গের গল্প!
ধীরে ধীরে আমেরিকার রাজনীতিতে পালের হাওয়া নানান দিকে বইতে লাগলো। নির্মম দাস প্রথার রক্ত মাখা শেকল খুলে ফেলার গল্প চারদিকে। একটা নতুন পৃথিবীর সম্ভাবনা শুরু হতে থাকে। প্রজন্মের গল্প চলতে চলতে গতি হারায় কোথাও । জর্জের ছেলে টম, টম হার্ভের মেয়ে সিন্থিয়া ,সিন্থিয়ার মেয়ে বার্থা, বার্থা আর সায়মন আলেকজান্ডার হেলির রাঁধুনি সন্তানটিই উল্টো পথে হাঁটতে হাঁটতে খুঁজে বের করে ফেলল এমন রক্তে লেখা ঘাস ফুলদের গল্প ।
১৯৬০ সালে অ্যালেক্স হেলি পূর্বপুরুষদের মুখে মুখে সংরক্ষিত তার শেকড়ের গল্পের সন্ধান শুরু করেন। ছিয়াত্তরে প্রথম প্রকাশিত হল শেকড়ের সন্ধান, ‘রুটস: দ্য সাগা অব অ্যান আমেরিকান ফ্যামিলি’
তোলপাড় এনে দিল নিজেদের সভ্য দাবী করা মানুষের বোধের জগতে। উঁচু জাতের মানুষ, উঁচু রক্তের মানুষের নির্মম চেহারা এতটা প্রকট হয়ে বেড়িয়ে পড়েছে! যারা জিতে যায় তারা তাদের মত করে ইতিহাস লিখতে পছন্দ করে। আর যারা বাকি রয়ে গেল, তারাও কিন্তু পৃথিবীকে অবিস্মরণীয় বাস্তবতাকে চেনাতে পারে। আমার কথা না। অ্যালেক্স হেলির কোন এক মন্তব্যের সুর ধরে এমনটা বলাই যায়।
কুন্টারা তাদের অসহনীয় যাতনার কথা পাথরে খোদাই করে লিখেও রেখেছিল। আলেক্স হেলি খুঁজে পেয়েছিলেন সে দীর্ঘশ্বাসগুলো। অসম্ভব পরিশ্রম সাথে নিয়ে অনুসন্ধানে না নামলে লাখ লাখ কৃষ্ণাঙ্গের মত তার অতীতও অন্ধকারেই থেকে যেত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিয়েছিল হতভাগ্য মানুষেরা তাদের কথাগুলো। কতবার ক্ষমতায় আর শক্তিতে চেপে ধরেছে সবল! কতবার ক্লান্তি এসেছিল আগলে রাখায়! কোন উত্তরপুরুষ ঠিক ঠিক একদিন খুঁজে নিতে এসেছিল। তারপর পৃথিবী জেনেছে সভ্যলোকের খেরো খাতায় যারা অসভ্য, তাদের ওপরে চালানো মর্মন্তুদ ইতিহাস! পৃথিবী জেনেছে নিজের অজান্তে বয়ে বেড়ানো ভয়ঙ্কর নিপীড়নের ইতিহাস!
হলিউডের রুটস চলচ্চিত্রের একটি অংশ- সংগৃহীত
পুলিতজার পুরস্কার প্রাপ্ত এই উপন্যাসটি সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্য কর্মের একটি। উপন্যাসের কাহিনী শুরু হয়েছে গাম্বিয়ার উপকূলে জুফ্রে নামে ছোট এক গ্রামে ১৭৫০ সালের বসন্তে। প্রভাতের কিছু আগে অমেরো ও বিন্টা কিন্টে দম্পতির ঘর আলো করে জন্ম নেয় একটি পুত্রসন্তান। গ্রামটিতে তখন অন্ধকার কেটে ধীরে ধীরে ভোর হচ্ছে। মোরগ ডাকছে। আজান দিয়ে ফজরের নামাজের জন্য ডাকা হচ্ছে গ্রামবাসীকে। চারিদিকে শান্তি আর আনন্দের সুবাতাস।
প্রথা অনুসারে জন্মের সাত দিন পর ঢোল বাজিয়ে, খাবার বিতরণ করে, ইমামের দোয়া পড়ার মাধ্যমে, আনন্দ-উৎসবের মধ্যে দিয়ে এই নবাগত শিশুর নাম রাখা হয় তার পূর্বপুরুষ কুন্টা কিন্টের নামানুসারে।
শিশু কুন্তাকে তার মা বিনতে কাপড়ের দোলনায় শুইয়ে পিঠে ঝুলিয়ে নিয়ে যায় কাজ করতে, গাম্বিয়া নদী থেকে আসা খালের ভিতর দিয়ে নৌকায় করে। সাথে গ্রামের অন্য মহিলারাও থাকে। খালটি পূর্ণ নানা ধরণের মাছে, দুপাশের বন ভর্তি হাজারো পাখি ও পশুতে। পাখিরা যখন আকাশে ওড়ে, তখন চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়। বিনতে যখনই নীচু হয়, তখনই পিঠে ছেলের কোমল উষ্ণতার ছোয়া পায়। তাদের ক্ষেতগুলো ভাগ করা পরিবারের সদস্য সংখ্যার ভিত্তিতে। গ্রামের পঞ্চায়েত প্রতিবছর ভাগ করে দেয়। কাজের মাঝে কুন্তা যতবারই কেঁদে ওঠে, বিনতে তাকে ততোবারই মাঠের পাশে ওমোরোর তৈরী করা ছোট্ট ঘরে নিয়ে গিয়ে পরিচর্যা করে।
রুটস’র লেখক অ্যালেক্স হ্যালি- সিএনএন
বাসায় ফিরে ছোট কুন্তাকে নিয়ে পাগলের মত আদর করে তা মা-বাবা ও দাদী। বিনতে তাকে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ায়। গানের কথাগুলো অনেকটা এরকম:
আমার হাসিমুখের সোনাচাঁদ
তোমার নাম একজন আদর্শ পূর্ব পুরুষের নামে
একদিন তুমি হবে নামকরা বীর অথবা শিকারী
কিন্তু তুমি চিরকাল আমার কাছে এই রকমই থাকবে।
গ্রামটিতে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও নারীরা পাশাপাশি কিন্তু আলাদা ঘরে থাকে। কুন্তার বাবা ওমোরো ছেলেকে তার ঘরে নিয়ে এসে তার ছোট্ট হাত দিয়ে প্রিয় সব জিনিসকে স্পর্শ করায়, শুধু তার জায়নামাজ ছাড়া। ছোট্ট শিশুকে শোনায় সে বড় হয়ে কী কী মহৎ ও সাহসী কাজ করবে। তারপর সে ছেলেকে স্ত্রীর কাছে দিয়ে যায়।
কিন্টা কিন্টকে এই দ্বীপেই বন্দি করে রাখা হয়েছিল- সিএনএন
স্বামী ও সন্তানকে বিনতে যতই ভালোবাসুক, সে ওমোরো-কে নিয়ে সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে। এখানকার মুসলিম রীতিতে ছেলেরা দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে এবং অধিকাংশ সময়েই তা ঘটে বাচ্চাকে স্তন্যদানের সময়টায়। বিনতের সেই উদ্বেগের সময়টাও একসময় কেটে যায়। তেরোতম চন্দ্রমাসে বিনতে তার ছেলেকে দুধ ছাড়িয়ে দেয়। (সংকলিত)
এমএস/এসি