ঢাকা, সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

কূটনৈতিক অর্থনীতির সম্ভাবনা ও বাংলাদেশের কৌশল 

প্রকাশিত : ২২:২৫, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

Ekushey Television Ltd.

বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের এখন নতুন পরিচিতি, উন্নয়নশীল দেশ। দারিদ্র্যের শেকল ভেঙে লাল-সবুজের দেশটির দেদীপ্যমান গতি এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। এমন অবস্থার মধ্য দিয়েই আবারও ক্ষমতায় এলো আওয়ামী লীগ।     

দলটির সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে জীবনমানের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্যে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। অভাবনীয় সাফল্যের কারণে মানুষের প্রত্যাশাও বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। তবে প্রত্যাশা পূরণ আর চলমান উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নেওয়াসহ নতুন প্রকল্প গ্রহণে তাই খানিকটা চ্যালেঞ্জও রয়েছে সরকারের।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘ দিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে, একটি দেশের উন্নয়ন ও বিশ্বব্যাপী ভাবমূর্তি তৈরিতে কূটনীতিকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নিজস্ব সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কীয় যোগাযোগ রক্ষা, নতুন যোগাযোগ স্থাপন ও সম্পর্কের উন্নয়ন, দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা অর্জন সাধারণভাবে কূটনীতিকদের প্রধান কাজ। এই কাজের প্রধান অংশ জুড়ে থাকে রাজনৈতিক বিষয়। দেশগুলোর মধ্যে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রদ্ধার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পারস্পারিক যোগাযোগ স্থাপনও প্রচলিত কূটনৈতিক ধারণার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর আওতায় উন্নয়ন সহযোগিতায় ঋণ ও অনুদান, শিক্ষা, ভূ-রাজনীতিসহ নানা বিষয়েই সময়, সুযোগ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী নানা বিষয় নির্ধারিত হয়। সতেরো শতকের গোড়ার দিকে ফ্রান্সের বৈদেশিক নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোকে বোঝানোর ক্ষেত্রে ‘ডিপ্লোম্যাটিক’ শব্দটি ব্যবহার হতো। ফরাসি শব্দ ডিপ্লোম্যাটের ওপর ভিত্তি করে ১৭৯৬ সালে অ্যাডমুন্ড বার্ক ‘ডিপ্লোম্যাসি’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন।

তবে সময় ও পরিস্থিতির আলোকে কূটনৈতিকার ধরণও পাল্টেছে খানিকটা। অর্থনৈতিক কূটনীতি বা Economic Diplomacy এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। যদিও সত্তরের দশকের আগ পর্যন্ত এই শব্দের খুব একটা প্রচলন ছিল না। যাও খুব একটা ব্যবহার করা হতো, তা ছিল মূলত পণ্য আমদানি ও রপ্তানি সংক্রান্ত বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে এখন বিশ্বব্যাপীই ধারণাটা পাল্টেছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ও বাণিজ্য স্বার্থরক্ষায় বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ উন্নয়ন, গৃহীত নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনায় সমন্বয় সাধনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি এই কূটনীতির বড় দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যাতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করে বৈশ্বিক বাণিজ্য সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টাও থাকছে। আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধ অর্জন ও কাঙ্খিত উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি গ্রহণযোগ্য, মানসম্মত ও উপযুক্ত দাপ্তরিক নীতিমালা গ্রহণ এবং এর ভিত্তিতে বিভিন্ন খাতকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টাও করা হয়ে থাকে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পাশাপাশি বাজার সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন স্তরের যোগাযোগ বৃদ্ধি করার ওপর গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। সম্প্রসারণমূলক বাণিজ্য নীতিমালায় প্রতিযোগিতামূলক উপযুক্ত বিধির সমন্বয় সাধনের চেষ্টাও করা হচ্ছে। কাজেই বাংলাদেশের জন্য এখন অর্থনৈতিক কূটনীতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ২০২১ সালের মধ্যে আমাদের যে মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরের লক্ষ্য তা পূরণে অর্থনৈতিক কূটনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশে উন্নীত করা এবং সরকারের নির্বাচনী ইশতিহার অর্জনের লক্ষ্যে তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বও অর্থনৈতিক কূটনীতির ওপরই। একসময় আমাদের কূটনীতিটা ছিল রাজনৈতিক। বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার ধরণ আর সময়ের সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে আমাদের কূটনৈতিক কৌশলও। বলতে গেলে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বাণিজ্য প্রসার, অধিকতর বিনিয়োগ, নতুন নতুন প্রযুক্তি আমদানি ও বিপুল রেমিট্যান্স আয় আর দেশের অব্যাহত উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নিতে কূটনৈতিক অর্থনীতির প্রয়োজন অনস্বীকার্য। তাই সংগত কারণেই নতুন সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতেও এর উপর জোর দিতে হচ্ছে।

২.
উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে যুগোপযোগী কৌশল দাঁড় করিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তরুণদের কাজে লাগিয়ে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে নতুন শিল্পের বাজার তৈরি, ও দক্ষ জনবল তৈরির ক্ষেত্রে মনোযোগী বর্তমান সরকার। আগামী ৫ বছরে দারিদ্র্য বিমোচনে চলমান সকল পরিকল্পনা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি এগুলোকে আরো বড় পরিসরে নিয়ে আসা এখন সরকারের বড় দায়িত্ব। যেন ঘোষিত লক্ষ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৯ শতাংশে নেমে আসে। পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির আধুনিকায়ন ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সম্প্রসারনেও অর্জন হয় সাফল্যের নতুন পালক। ২০২১ থেকে ২০৪১ অর্থাৎ ২০ বছর বাংলাদেশকে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ৯ শতাংশ ধরে রাখার নতুন লক্ষ্য সরকারের। এই সময়ের মধ্যে বিনিয়োগের হার জিডিপি’র ৪০ শতাংশে উন্নীত করার চ্যালেঞ্জও রয়েছে। কাজেই পর্যাপ্ত অবকাঠামো সেবা সরবরাহ করতে হবে। আর সক্ষমতা বাড়াতে হবে রপ্তানি বাজারে। কারিগরি শিক্ষার প্রসার এবং স্কিল ডেভোলপমেন্টের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরির গুরুত্ব রয়েছে। আর স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধি করে দেশের বাইরে পাঠানো যেতে পারে। যাতে করে প্রচুর পরিমাণ বিদেশী রেমিট্যান্স আনা সম্ভব হবে। রপ্তানিতে আরও নতুন বাজার তৈরির বড় সম্ভাবনা রয়েছে। সীমিত সংখ্যক পণ্য ও বাজারের উপর নির্ভর করে রপ্তানি সম্প্রসারণ কঠিন। রপ্তানি বহুমুখীকরণের জন্য খাতভিত্তিক সমস্যাবলি সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য সরকার যে সকল সহায়তা দেয়, তার মধ্যে রয়েছে শুল্ক-কর-মুসক রেয়াত, নগদ প্রণোদনা ইত্যাদির সামগ্রিক কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনে সংস্কার ও সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। জ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্প বিকাশের জন্য শুল্ক-কর সুবিধা ও প্রণোদনা বিশেষ বিবেচনা পাচ্ছে, যা প্রশিক্ষিত তরুণ ও যুবকদের শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট করবে এবং দক্ষ উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের কূটনীতিকদের বড় দায় রয়েছে। এসব সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে আমাদের বেড়ে ওঠা অর্থনীতিকে আরও ছড়িয়ে দিতে চাই বিশ্বের আনাচে কানাচে। এ লক্ষ্যে আমাদের নতুন জোর প্রচেষ্টা কূটনৈতিক অর্থনীতিতে।

একজন কূটনীতিক একটি দেশের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি নিজ দেশের অর্থনীতির প্রসারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। কূটনীতির প্রাথমিক যুগেও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের অন্য দেশে পাঠানো হতো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই, এভাবেই মূলত দেশগুলোর মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্কের সূত্রপাত। আমাদের অ্যাম্বাসাডর ও হাইকমিশনাররাও বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি এখন বাজার সম্প্রসারণ ও বিনিয়ো আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। যিনি যেই দেশে আছেন, সেখানে আমাদের কোন পণ্যটা যেতে পারে, চাহিদা রয়েছে কোন পণ্যের, আবার সেখান থেকেও আমাদের উপযোগী কোনো পণ্য আসতে পারে কি না, তাও আলাপ-আলোচনা করে খুঁজে বের করতে হবে। বিভিন্ন দেশের সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগের সরাসরি মাধ্যম আমাদের মিশনগুলো। তাই জ্ঞানগর্ভ বিতর্ক বা আলোচনার মাধ্যমে দেশের স্বার্থ আদায়ে সতর্ক ও যথাযথ প্রস্তুতি থাকা উচিত। যাতে অন্য দেশগুলোও সন্তুষ্ট থাকতে পারে। বিভিন্ন দেশে আমাদের দূতাবাসগুলোতে হয়তো জনবল সংকট রয়েছে, তা সত্বেও দায়িত্বপালনে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা থাকলে অনেকাংশেই সমস্যা উৎরানো সম্ভব।

৩.
এক সময় বাংলাদেশ ছিল বিদেশি সাহায্যনির্ভর ও ধনী দেশগুলোর দয়ার ওপর নির্ভরশীল। সে অবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে। বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রসার ঘটছে দ্রুত। সারাদেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিল্পায়ন সারাদেশে ছড়িয়ে যাবে যেমন, তেমন তৈরি হবে দক্ষ-অদক্ষ জনবলের কর্মসংস্থানও। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশী মেশিনারীজ যেমন লাগবে, লাগবে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগও। তেমনি উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানির জন্যও লাগবে নতুন বাজার। এ কারণে দেশের বাইরে আমাদের প্রতিনিধিদের দায়িত্বও বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পোশাকশিল্পে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ। চামড়াশিল্পে বাংলাদেশের স্থান প্রথম কাতারে। ওষুধ শিল্পে সৃষ্টি হয়েছে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। আমাদের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বাহারি পণ্য যাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকার নানা দেশে। এসব ক্ষেত্রে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের তৎপরতা বাড়ালে রপ্তানি আয় অন্ততপক্ষে কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। তবে তা সম্ভব হবে তখনই যখন সরকারের নীতিগত অবস্থান বাস্তবায়নে দেশের কূটনীতিকরা তৎপর হবেন। দেশে বিদেশি বিনিয়োগের যে সুবর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে, তা বাস্তবে পরিণত করতে হলেও অর্থনৈতিক কূটনীতিকে কাজে লাগাতে হবে।

৪.
দীর্ঘ মেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি নেওয়া হয়েছে ‘ডেল্টা প্ল্যান- ২১০০’। উন্নত দেশের পথে হাঁটতে হলে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গঠনে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্তত ৯ বা ১০ শতাংশ অর্জন করতে হবে। এ লক্ষ্যে আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের। এরইমধ্যে ভূমিতে ব্যাপক ক্ষয় হচ্ছে। নদীভাঙনের ফলে প্রতিবছর ৫০ থেকে ৬০ হাজার পরিবার গৃহহীন হচ্ছে। বন্যায় অনেক ফসলহানি হচ্ছে। নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। এর বাইরেও বিশেষ করে শহর অঞ্চলে সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, কঠিন বর্জ্য ও আবর্জনা ব্যবস্থপনা, কৃষি জমিতে ব্যাপক রাসায়নিক সারের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মতো চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি উৎপাদক শক্তি না কমিয়ে কীভাবে এসব বিষয় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা যেতে পারে- তার প্রতিফলন ঘটেছে বাংলাদেশের ব-দ্বীপ পরিকল্পনায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ১০০ বছরের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গঠন করা হবে ডেল্টা তহবিল। এই তহবিলের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে বাংলাদেশ সরকার, উন্নয়ন সহযোগী, পরিবেশ ও জলবায়ু সম্পর্কিত তহবিল, বিশেষ করে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) ও সরকারি- বেসরকারি অংশীদারিত্বকে (পিপিপি) বিবেচনা করা হয়েছে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়নের জন্য ২০৩০ সাল নাগাদ জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থায়ন সম্বলিত বাংলাদেশ ডেল্টা তহবিল গঠনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এর মধ্যে ২ শতাংশ নতুন বিনিয়োগ এবং শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় করা হবে। বিপুল এই পরিমাণ অর্থের বড় একটি অংশ আসতে পারে প্রবাসীদের কাছ থেকে। এ লক্ষ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানোর বিকল্প কমই আছে।

আমাদের এখানে ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে নেওয়া, নতুন প্রকল্প গ্রহণ কিংবা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মতো কর্মসূচিতে সরকারের একার পক্ষে অর্থায়ন কঠিন। তাই এ খাতে প্রবাসী বাংলাদেশী আর বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে জোর প্রচেষ্টা শুরু করেছে সরকার। বিদেশী বিনিয়োগ এলে উভয়েরই লাভ। আমাদের জনবলের কর্মসংস্থান হবে, দেশে বাড়বে উৎপাদন। তারাও কম খরচে এখানে উৎপাদিত পণ্য নিতে পারবে। এতে আমাদের রপ্তানি আয়ও বাড়বে। আর, উৎপাদন যত বাড়বে, অর্থের সঞ্চালন হবে আরও বেশি। এতে তাদেরও উন্নয়ন ঘটবে, আরও সমৃদ্ধ হবে আমাদের অর্থনীতিরও।

মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর নানা দেশেই দক্ষ-অদক্ষ জনবলের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। জাপানে তো ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে লোকবল সংকটে। আমাদের জনশক্তির ৪৯ ভাগের বয়স ২৫ বছরের নিচে। আর ৩৫ বছরের নিচে এক তৃতীয়াংশের। এদের কর্মক্ষমতা থাকবে আরও অনেক বছর। যে সংকটে ভুগছে জাপান, চীনসহ পৃথিবীর অনেক দেশই। সেসব দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। আমাদের এখানে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি। কাজেই, বিপুল এই জনসম্পদ বিদেশে রপ্তানি করতে পারলে আমাদের রেমিট্যান্স বহুগুণ বাড়বে। বিভিন্ন দেশে শ্রম বাজার খোঁজার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন সেসব দেশে কর্মরত আমাদের অ্যাম্বাসেডর ও কূটনীতিকরা।

মানবাধিকার নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশেই সরব আলোচনা। আমি বলতে চাই, আমাদের দেশে উন্নয়ন হচ্ছে এখানকার মানবাধিকার। কেননা, মানবাধিকার কেবল কথা বলার অধিকারে সীমাবদ্ধ নয়। মৌলিক চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয়গুলো মানবাধিকারের অন্তর্ভূক্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, অনেক দেশেই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ভোট ব্যবস্থা নেই দীর্ঘ দিন। কিন্তু সেসব নিয়ে উন্নত বিশ্বের খুব একটা আলোচনা নেই। কেননা, সেসব দেশের সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদের উপর উন্নত বিশ্বের অনেকেই নির্ভরশীল। আর, গণতন্ত্রের উঁচু গলা কেবল সিরিয়া, আফগানিস্তান, আফ্রিকার গরীব দেশগুলোতেই। কাজেই, উন্নয়নের ধারা অক্ষুন্ন রেখে মানবাধিকার রক্ষাতেও কূটনৈতিক অর্থনীতির গুরুত্ব অনেক শক্তিশালী।

৫.
সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বলছেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে আমাদের দরকার হবে চার কোটি ৯৮ হাজার ৫০ লক্ষ কোটি টাকা। এই অর্থ কোথা থেকে আসবে? এর জন্য উদ্ভাবনী পথ খুঁজতে হবে। চীন, মালায়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে আমরা দেখেছি যে, সেসব দেশের মানুষ যারা বিভিন্ন দেশে প্রবাসী হয়েছেন, তারা কিন্তু দেশের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তাদের মাধ্যমেই সেসব দেশের বড় বিনিয়োগ এসেছে। সম্প্রতিকালে ভারতেও এটি হচ্ছে। ভারত পরিকল্পিতভাবেই এটি শুরু করেছে। বিদেশে অবস্থানরত সব ভারতীয়দের জন্য সে দেশের সবধরণের সুযোগসুবিধার দ্বার খোলা। বিদেশে তাদের দূতাবাসগুলো ননভারতীয়দের সেবা প্রদানে খুবই আন্তরিক ও পারদর্শী। অর্থাৎ দেশের উন্নয়নেই সেদেশের প্রবাসীরা অবদান রাখছেন। দেরীতে হলেও অবশ্য আমরাও তেমন উদ্যোগ গ্রহণ শুরু করেছি।

আমাদের জনসংখ্যার ১ কোটি ১৬ লাখেরও বেশি লোক বিদেশে কাজ করছেন। এদের মধ্যে এক ধরনের লোক আছে যারা দেশে ফিরে আসবেন, অন্য আরেক ধরনের লোক আছে যারা সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে নিয়েছেন। এই বিরাট সংখ্যক প্রবাসীদের উন্নয়নের স্রোতধারায় নিয়ে আসতে একটি দিন প্রবাসী দিবস পালন করার উদ্যোগ আমরা নিয়েছি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ও অর্থমন্ত্রনালয়ের উদ্যোগে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এটির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের। প্রতিবছর ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসে দেশে। অনাবাসীরা দাতব্যমূলক কাজে সহায়তা করে থাকে, কিন্তু দেখা যায় যে, এখানেও অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকে। সেই জটিলতাগুলোও দূর করতে হবে আমাদের। কোন দেশের কারা কখন বাংলাদেশে আসছেন, তা আমরা ঠিক মতো জানতেই পারি না। অথচ অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞ অনেকেই আছেন বিভিন্ন দেশে। যেমন, একজন ডাক্তার যখন দেশে আসেন, তার কাছ থেকে অন্তত এক সপ্তাহ বিনামূল্যে সেবা নেওয়া সম্ভব। কিন্তু দেখা যায় যে, তিনি কখন আসেন, সেই খবরই আমাদের হাতে নেই। বহু বড় বড় বাঙালি আছেন যারা সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছেন বিদেশে। তাঁরা সেবা ও ট্রেনিং দিতে পারেন আমাদের। এখন বাঙালিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বড় বড় রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। আমাদের বিভিন্ন সংকটের সমাধানে তারা সহায়কের কাজ করতে পারেন। যেমন, রোহিঙ্গা ইস্যু। আমাদের লোকরা আমাদের দেশের হয়ে লবিং করতে পারেন রোহিঙ্গা সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাওয়ার জন্য। অনাবাসী অনেকেই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আস্থা অর্জন করেছেন, কোম্পানীর বড় সাহেব হয়েছেন, তারা একটি সুপারিশ করলে সেটি কাজে আসবে। অন্যদিকে, আমরা যদি সেই সুপারিশটি করতে যাই, সেটি অতখানি গুরুত্ব বহন করেনা। আমাদের এগুলো সংগঠিত রূপে করতে হবে, দক্ষিণ কোরিয়া করছে, ভারত, হন্ডুরাস করছে। আমরা কেন পিছিয়ে থাকবো?
৬.
আমাদের দেশের উন্নয়ন কাজের বেশিরভাগই বাস্তবায়িত হয় আমলাদের হাত ধরে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সরকারের উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন ও সরকারের লক্ষ্য অর্জনে তাদের পরিশ্রমও দিনরাত। আবার, দেশের সংকট নিরসনেও তাদের চিন্তাপ্রসূত নির্দেশনাও সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সিদ্ধান্তগ্রহণে সহায়ক হয়। তবে, এসব কিছুর বাইরেও ‘পাবলিক ডিপ্লোমেসি’ নামে নতুন একটি ধারনার প্রবর্তন করতে চাই আমি। আমাদের স্থানীয় ও জাতীয় সংকট মোকাবেলা ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তি বাড়াতে এই প্লাটফর্ম সহায়ক হতে পারে। এক কথায় বলতে গেলে, দেশের উন্নয়ন কাজ চালিয়ে নেওয়া, ভবিষ্যত পরিকল্পনা গ্রহণ, অপ্রত্যাশিত সংকট মোকাবেলায় ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, চিন্তাশীল, গণমাধ্যম কর্মী, সমাজচিন্তক, রাজনীতি বিশ্লেষক, শিক্ষাবীদ, সিভিল সোসাইটির সদস্য, সরকারি- বেসরকারি উন্নয়ন কর্মী, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়সহ সব স্তরের লোকদের অন্তর্ভূক্ত করতে চাই। প্রবাসীরা তো থাকবেনই। যারা ইস্যুভিত্তিক নানা ক্ষেত্রেই নিজেদের অভিজ্ঞতা ও পড়াশোনার আলোকে পরামর্শ প্রদান করতে পারবেন। যার মাধ্যমে সরকারের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ ও শক্তিশালী হবে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ পৃথিবীতে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরির লক্ষ্যে সম্প্রতি বিশ্বের উন্নতদেশসহ অনেক দেশই এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে শুরু করেছে। আসলে সময়ের সাথে সাথে নিজেদের শক্তিশালী হিসেবে জানান দেওয়ার ক্ষেত্রে দেশগুলোর কৌশলও পাল্টেছে। এখন কেবল দক্ষ সামরিক বাহিনী আর অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষকে দমন করা যায় না। সম্মুখ যুদ্ধের রীতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। এখন বিশ্বব্যাপী চলছে জনমত গঠন ও প্রচার মাধ্যমের দামামা। বুদ্ধিবৃত্তিক আর জ্ঞানগত কৌশলের এই যুদ্ধে বিজয়ী হতে হলে দরকার মেধার যথাযথ ব্যবহার। পাবলিক ডিপ্লোমেসি প্লাটফর্মের মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশীদের মেধার যথাযথ ব্যবহার করে তাদের মাধ্যমে জনমত গঠন, প্রচার-প্রচারণা জোরদার করতে চাই যাতে সরকারের কাজটি সহজতর হয়। এক্ষেত্রে শক্তিশালী দেশপ্রেমিক গণমাধ্যমও দরকার হবে। এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে আশা করছি সব স্তরের মেধাবীদের অংশগ্রহন নিশ্চিত হবে।
৭.
দেশের বাইরে দক্ষ-অদক্ষ জনবল পাঠানো, বাইরে থেকে পর্যটক আকৃষ্ট করা, উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য আমাদের মেধাবীদের প্রেরণ, বিনিয়োগ আকর্ষণ ও বাণিজ্য প্রসার... প্রভৃতি বিষয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয় আছে। রয়েছে সরকারি নানা উদ্যোগও। কিন্তু সব উদ্যোগের সহজে সমন্বয় করতে পারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাই আমাদের সরকারের বেশি জোর থাকবে কূটনৈতিক অর্থনীতিতে। সব দিক বিবেচনায় নতুন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। আগামীতে অর্থনীতির প্রসার ও সরকারের রূপরেখা অর্জনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বড় সহায়কের ভূমিকা পালন করবে- নতুন বছরে তেমনটাই প্রত্যাশা করছি।

লেখক# মন্ত্রী, পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

এসি 

  


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি