কেন রক্ত দান করবেন
প্রকাশিত : ২১:৫৬, ১৭ এপ্রিল ২০১৯
মানবদেহের একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে রক্ত। রক্তের বিকল্প শুধু রক্তই। চিকিৎসা বিজ্ঞানে আজ পর্যন্ত রক্তের কোন বিকল্প আবিস্কার হয়নি। রক্তের অভাবে যখন কোন মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায় তখন অন্য একজন মানুষের দান করা রক্তই তার জীবন বাঁচাতে পারে। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের এদেশে স্বেচ্ছা রক্তদাতার সংখ্যা খুবই কম।
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় সাত লক্ষ ব্যাগ নিরাপদ ও সুস্থ রক্তের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে মাত্র ২৬ ভাগ রক্ত সংগৃহীত হয় স্বেচ্ছা রক্তদাতার মাধ্যমে। বাকি ৭৪ ভাগ রক্তের জন্য রোগীরা ছুটে যায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ পরিচিতজনদের কাছে। সেখানেও ব্যর্থ হলে তারা পেশাদার রক্ত বিক্রেতার স্মরণাপন্ন হয়। এদের রক্ত নিরাপদ নয়। কারণ আত্মীয় ও পরিচিতজনের রক্ত অনেকে প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং ছাড়াই রোগীর শরীরে দিতে চায় যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকে পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের রক্ত আরো বিপজ্জনক। তাদের রক্ত ব্যবহারের ফলে রোগীর দেহে ঘাতকব্যাধির জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। এজন্য স্বেচ্ছা রক্তদাতার রক্তই সবচেয়ে নিরাপদ।
বাংলাদেশের স্বেচ্ছা রক্তদান আন্দোলন পরিস্থিতি নিয়ে ২ হাজার সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, রেড ক্রিসেন্ট ও এসোসিয়েশন অব ভলান্টারী ব্লাড ডোনার্স, ওয়েস্ট বেঙ্গলে অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালায় উক্ত সংস্থাগুলো তাদের জরিপ উপস্থাপন করে। এতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে প্রতি হাজারে মাত্র ০.৪ জন স্বেচ্ছায় রক্তদান করে। অথচ ইউরোপে প্রতি হাজারে স্বেচ্ছা রক্তদাতার সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০ জন। সুইজারল্যান্ডে এ সংখ্যা বিশ্বের সর্বোচ্চ ১১৩ জন। অথচ বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশে এ সংখ্যাকে প্রতি হাজারে মাত্র ২ জনে উন্নীত করতে পারলে বাংলাদেশের মোট রক্তের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।
রক্তদানের বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। রক্তদান করার সাথে সাথে আমাদের শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয় এবং দান করার দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্ত কণিকা জন্ম হয়ে এ ঘাটতি পূরণ করে। বছরে তিনবার রক্তদান রক্তদাতার লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা বাড়িয়ে দেয় এবং শরীরে আয়রণের ভারসাম্য বজায় থাকে। ইংল্যান্ডের মেডিকেল পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নিয়মিত স্বেচ্ছা রক্তদানকারী দুরারোগ্য রোগব্যাধি যেমন, ক্যান্সার, হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের মতো রোগের ঝুঁকি থেকে প্রায়ই মুক্ত থাকেন। রক্তের কোলেস্টরেল-এর উপস্থিতি কমিয়ে দেহের স্থুলতা কমাতে সাহায্য করে। শরীরের বিপাকক্রিয়ায় অক্সিজেন ফ্রি রেডিকেল তৈরী হয়। এর জন্য আমরা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুড়িয়ে যাই। রক্তদানে এ কেমিক্যাল শরীর থেকে বেরিয়ে গিয়ে শরীরকে বিষ মুক্ত করে। ফলে বয়সের চাপ দেরীতে পড়ে। মুমূর্ষু মানুষকে রক্তদান করে মানসিক পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভ করা যায়। সর্বোপরি রক্তদান মানে নিজের ও পরিবারের দুঃসময়ের জন্য রক্ত সঞ্চয় করা।
এছাড়াও প্রতিবছর সারাবিশ্বে ৩ লাখের ও বেশি নারী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। এদের মধ্যে ২৭ শতাংশ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণজনিত কারণে মৃত্যু হয়। অথচ সময়মতো নিরাপদ রক্ত সরবরাহ করতে পারলে মাতৃমৃত্যু রোধ করা যায়। নিয়মিত রক্তদান মুমূর্ষু মানুষের জীবন বাঁচানোর স্বর্গীয় আনন্দ।
আঠারো থেকে ষাট বছর বয়সী প্রত্যেক সক্ষম নারী-পুরুষ প্রতি চার মাস পর রক্ত দান করতে পারে। রক্তদান ধর্মীয় দিক থেকে অত্যন্ত পুণ্য বা সওয়াবের কাজ।
পবিত্র কুরআনে সূরা মায়েদা’য় বলা হয়েছে,‘‘যখন কেউ কোন মানুষের জীবন রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষা করল’’।
ঋগবেদে বলা হয়েছে,‘‘নিঃশর্ত দানের জন্যে রয়েছে চমৎকার পুরস্কার। তারা লাভ করে আর্শীবাদধন্য দীর্ঘ জীবন ও অমরত্ব’’।
আমাদের দেশে রক্তদান সর্ম্পকে জনমনে ভুল ধারণা, ভয়,অজ্ঞতা ও কুসংস্কার, পরিবারের সদস্যদের বাধা, সুযোগের অভাব, মোটা সূঁচ ভীতি, উদ্ধুদ্ধকরণের অভাব, নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনে সময়মতো রক্ত না পাওয়া, ডোনার কার্ড না পাওয়া, সামাজিক স্বীকৃতির অভাব ইত্যাদি কারণে এদেশে স্বেচ্ছা রক্তদান আন্দোলন প্রতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। অথচ প্রতিবেশি দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অ্যাসোসিয়েশন অব ভলান্টারী ব্লাড ডোনার্স পুরো ভারতের স্বেচ্ছা রক্তদান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। দেশের স্বেচ্ছা রক্তদান আন্দোলনে শুরু থেকে এ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে সন্ধানী, রেড ক্রিসেন্ট, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, বাঁধন, অরকাসহ আরও কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যা প্রয়োজনে তুলনায় অপ্রতুল।
একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন দেশেই পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের রক্ত কেনা-বেচা হয় না। এ সুযোগে অনিরাপদ ও দূষিত রক্ত কেনাবেচার জন্য ঢাকাসহ সারাদেশে গড়ে উঠেছে অবৈধ ব্লাড ব্যাংক বাণিজ্য। এ দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য সকলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। স্বেচ্ছা রক্তদান আন্দোলনে মানুষকে ব্যাপকভাবে সচেতন ও উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। এর মাধ্যমে বন্ধ হবে রক্তের কেনা-বেচা। রক্তের অভাবে কোন মুমূর্ষু মানুষ মারা যাবে না, দূষিত রক্ত নিয়েও দূরারোগ্য ব্যাধিতে কাউকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে না। তাই নিয়মিত রক্তদানের মাধ্যমে আমাদের পরিপূর্ণ সুস্থ থাকা ও প্রাণবন্ত জীবনযাপন নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক- মাসুদ আলম
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।