ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

কেন শুদ্ধাচার?

পথচারী

প্রকাশিত : ১৬:১০, ৭ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ১৬:৩২, ৭ আগস্ট ২০২১

১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘... সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না- চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এই অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কি না সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সকলকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম আত্মশুদ্ধি করতে হবে।’

২০১২ সালে প্রকাশিত জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল নির্বাহী সারসংক্ষেপের ৪ নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছে- শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ বোঝায়। এর দ্বারা একটি সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্যও বোঝানো হয়। ব্যক্তি-পর্যায়ে এর অর্থ হল কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা, তথা চরিত্রনিষ্ঠা। এই দলিলটিতে শুদ্ধাচারের এই অর্থই গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রতিটি ধর্মই এসেছে মানুষের কল্যাণে। করণীয়-বর্জনীয়ের ব্যাপারে দিয়েছে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা। যার পরিপালনে একজন মানুষ হয়ে ওঠে যথার্থই ধার্মিক আর শুদ্ধাচারী মানুষে।

ব্যবহারিক জীবনে পালনীয় ও বর্জনীয় কাজ, যার প্রতিফলন পড়ে ধার্মিকের দৈনন্দিন জীবনের সকল কর্মকাণ্ডে- তার সবটার গ্রন্থিত রূপই হচ্ছে শুদ্ধাচার। শুদ্ধাচার হলো ধার্মিকের ভূষণ।

ধর্ম কী- সাহাবীদের এই প্রশ্নের জবাবে নবীজী (স) বলেছিলেন, ‘ধর্ম মানে সদাচার!’ আর মানুষ সদাচারী হয় তখনই যখন তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শুদ্ধাচারের চর্চা জারি থাকে।

আসলে কোনো বিশেষ বেশভূষা নয়, একজন মানুষের আচরণই বলে দেয় সে প্রকৃত ধার্মিক কিনা। কারণ একজন ধার্মিক কখনো দুরাচারী হতে পারে না। যে-রকম একজন দুরাচারী কখনোই গণ্য হতে পারে না প্রকৃত ধার্মিক হিসেবে।

ধার্মিক হতে হলে জানতে হবে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় ও করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে আর নিজের জীবনকে পরিচালিত করতে হবে সে আলোকে। বাস্তব জীবনে প্রতিটি কথা, কাজ ও আচরণকে নৈতিকতার কষ্টিপাথরে যাচাই করতে হবে, নিতে হবে অশুদ্ধ আচরণ, কথা ও কাজগুলো পরিশুদ্ধির পদক্ষেপ।

আসলে একজন মানুষ জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় হয় তার আচার-আচরণ দিয়ে। আবার সে বিরক্তিকর বা নিন্দিতও হয় তার আচরণের কারণে। এ-কারণেই ধর্মে শুদ্ধাচারকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত : রসুলুল্লাহ (স) বলেন, ‘শুদ্ধাচার একজন মানুষকে সারারাত ইবাদতকারী আবেদের সমমর্যাদা প্রদান করে।’

অন্যদিকে হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত : রসুলুল্লাহ (স) বলেন, ‘একজন বিশ্বাসী শুদ্ধাচারের মাধ্যমে সারাদিন রোজা পালনকারী এবং সারারাত ইবাদতকারীর সমান মর্যাদা অর্জন করতে পারে।’

এ-থেকেই আমরা বুঝতে পারি ধর্মীয় দৃষ্টিতে শুদ্ধাচারের মর্যাদা কতখানি। তিরমিজি শরীফের একটি হাদীসের মর্মানুবাদ হলো, ‘শুদ্ধাচার শিক্ষাদান সন্তানের জন্যে পিতার শ্রেষ্ঠ উপহার।’

আসলে ভালো জিনিসকে সবাই-ই পছন্দ করে। খারাপকে কেউ পছন্দ করে না। আর ভালো জিনিস শুধু মানুষ না, আল্লাহরও পছন্দনীয়। এ-জন্যে শুদ্ধাচার এত গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিক শক্তি জাগ্রত করার উপায় হলো দৈনন্দিন জীবনে শুদ্ধাচারের অনুশীলন।

যে মানুষের জীবনে শুদ্ধাচারের অনুশীলন আছে তার পক্ষে সম্ভব নয় অন্যায় কোনো কাজ করা। এমন কিছু করা যা নিজের ও অন্যের জন্যে অকল্যাণ বয়ে আনে। বরং চারপাশের মানুষ কিভাবে একটু ভালো থাকে সে ব্যাপারে একজন শুদ্ধাচারী থাকেন সদা সজাগ; আর সে লক্ষ্যে পরিচালিত করে তার সকল কর্মতৎপরতা।

কাজেই ব্যক্তিজীবনে আমরা যত বেশি শুদ্ধাচার চর্চা করবো ততো বাড়বে আমাদের নৈতিক শক্তি। ব্যাক্তি থেকে যা ছড়িয়ে পড়বে জাতি পর্যায়ে। আর নৈতিকতার এই চর্চা-ই আমাদের পৌঁছে দেবে মানবিক মহাসমাজ গড়ার পথে।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি আমাদের ভালো মানুষ হতে হবে। কেবল তাহলেই এই সমৃদ্ধ অর্থনীতির সুফল ভোগ করতে পারবে সকল মানুষ। তা না-হলে কিছু মানুষ রাতারাতি অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যাবে, কোটিপতিতে পরিণত হবে। আর কোটি মানুষ হবে নিঃস্ব।

আসলে নৈতিক শক্তি জাগ্রত না হলে, নৈতিকতা বিকশিত না হলে আর্থিক সমৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষ কোনোদিনও ভোগ করতে পারবে না। কারণ সম্পদশালী মানুষ যখন ধর্মের পথ থেকে সরে গিয়ে নৈতিকতা বিবর্জিত জীবনে চলে যায় তখন মানুষের কল্যাণে ব্যায়ের বদলে মদ জুয়া আর বেলেল্লাপনায় উড়িয়ে দেয় কোটি টাকা। ফল ভোগ করে সামগ্রিক অর্থনীতি, কোটি কোটি মানুষ নেমে যায় দারিদ্রসীমার নিচে।

২০২৫-এর মনছবি বাস্তবায়নে তাই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে নৈতিক সমৃদ্ধিও জরুরী। জরুরী প্রতিটি মানুষের শুদ্ধাচারী হওয়া।
শুদ্ধাচার - এই সময়ে কেন এত প্রাসঙ্গিক?

আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটছে- এটা অনস্বীকার্য। মেধা-মননেও আগাচ্ছি আমরা। কিন্তু পিছিয়ে পড়ছি আচার আচরণ ও নৈতিকতায়। মনুষ্যত্ব ও মানবিকতায়।

বুয়েটে পেটাতে পেটাতে সহপাঠীকে হত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনা নৈতিকতাবর্জিত আধুনিক শিক্ষার পাশবিকরূপকেই আমাদের সামনে তুলে ধরেছিল। গোল্ডেন জিপিএ পাওয়া ছাত্রদের আমরা যে ভালো মানুষ হিসেবে গড়তে ব্যর্থ হয়েছি আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

কড়াইল বস্তির আরেকটি ঘটনা- কিশোর বয়সী ভাই তার আপন ছোট বোনকে হত্যা করেছে, শিশুবয়সী বোনটির কারণে বাবা মায়ের কাছে তার আদর কমে গেছে- এই হিংসার বশবর্তী হয়ে। সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থা কতটা দেউলিয়া হলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।

মনুষ্যত্বহীনতার এমন ঘটনা পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে। তবে এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হলেও তা আসলে আমাদের সমাজের নৈতিকতাহীনতা স্বার্থপরতা আর নৈতিক শিক্ষার অভাবকেই প্রতিপন্ন করে।
সমাজের নৈতিক অন্তঃসারশূন্যতাকে আমরা যদি হিমশৈলের সাথে তুলনা করি তাহলে অমানবিকতার এই ঘটনাগুলো হবে সেই হিমশৈলের শুধু মাথাটুকু!

বিজ্ঞান বলে, আইসবার্গ বা হিমশৈলের ১১ ভাগের মাত্র ১ ভাগ পানির উপরে থাকে। বাকি ১০ ভাগ থাকে পানির নিচে। ফলে পুরো হিমশৈল আসলে কত বড় তা বাইরে থেকে সেভাবে বোঝা যায় না।

তেমনি সমাজে বিরাজমান অনৈতিকতার পাহাড়ও আমাদের চোখে এতদিন ধরা পড়ে নি। কিন্তু করোনা এসে সবার সামনে আমাদের সমাজের অমানবিকতার মর্মান্তিক ছবিটাকে উন্মোচিত করেছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নৈতিক পুনর্জাগরণ কেন এই মুহূর্তে অতি প্রয়োজন।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মানুষ যখনই সীমালঙ্ঘন করেছে, ভ্রান্ত জীবনাচারে ডুবে গেছে, অন্যায় অত্যাচারে নিমগ্ন হয়েছে তখনই স্রষ্টার পক্ষ থেকে নেমে মহামারী এসেছে।

এই মহামারী কখনো এসেছে ভূমিকম্পরূপে, কখনো মহাপ্লাবন, কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর কখনো মহামারিরূপে। অতীতে প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু, কলেরার মতো দুর্যোগ মানবজাতির উপর আঘাত হেনেছে। আর অধুনা গজবের বহিঃপ্রকাশ হলো করোনা অতিমারি।

আমরা যদি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতাম তাহলে এই দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার শুদ্ধাচার অনুসরণ করলে করোনায় এতটা ভোগান্তি নাও হতে পারতো। ব্যক্তি ও পরিবারে শুদ্ধাচারের অনুশীলন থাকলে আমরা বেঁচে যেতাম করোনারোগীদের সাথে প্রিয়জনের কৃত নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার পঙ্কিলতা থেকে।

তরুণ সমাজকে শুদ্ধাচারী করে গড়ে তুলতে শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আসলে হাজার হাজার ধরে এ-দেশে নৈতিক শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষাঙ্গনগুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কালে কালে আমরা পরিবার ও শিক্ষালয় হতে শিখেছি শুদ্ধ মানুষ হতে করণীয় বর্জনীয়ের ব্যাপারে।

কিন্তু এখনকার দুঃখজনক বাস্তবতা হলো গেল বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। কেবল ভালো ফলাফল আর জিপিএ-৫ নিয়েই ব্যতিব্যস্ত স্কুল-কলেজগুলো। শিক্ষার্থীদের নৈতিকতায় ঋদ্ধ করতে না আছে শিক্ষালয়ের প্রয়াস, না আছে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের দিক থেকে সেই প্রত্যাশা বা ইচ্ছা। ফলে নৈতিক জ্ঞানের একটা ভয়াবহ শূন্যতায় ভুগছে শিক্ষার্থীরা।

আবরারকে যারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে- তারই তো সতীর্থ তারা, যারা প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফলের বিচারে দেশ-সেরা মেধাবীদের মধ্য থেকে ছেঁকে বাছাই করা মেধাবী। কিন্তু তাদের মধ্যে নৈতিকতার ঘাটতি কতখানি তা তাদের কাজই বলে দিয়েছে।

তাহলে নতুন প্রজন্ম নৈতিকতা শিখবে কোথায়, কীভাবে? এক কথায় উত্তর- ব্যক্তি প্রয়াসে, স্ব-উদ্যোগে। আর এ-কাজে সহায়ক হচ্ছে প্রকাশিত বই ‘শুদ্ধাচার’। যেখানে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পরিবারে, সামাজিক পরিমণ্ডলে, শিক্ষালয়ে, পেশায়, আচার-অনুষ্ঠানে, হাসপাতালে, যানবাহনে, ফোনালাপে, প্রযুক্তি ব্যবহারে, ইবাদতে অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পালনীয় শুদ্ধাচারের ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়েছে সহজ-সরল ও প্রমিত ভাষায়। ফলে সর্বস্তরের মানুষের পক্ষে সহজবোধ্য হয়েছে এর মেসেজগুলো গ্রহণ, লালন ও পালন।
এসএ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি